ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

শরিয়ত বাউলের ওপর আঘাত বাঙালী সংস্কৃতির ওপর আঘাত

প্রকাশিত: ০৭:১৩, ২৩ জানুয়ারি ২০২০

 শরিয়ত বাউলের ওপর আঘাত বাঙালী সংস্কৃতির ওপর আঘাত

একটা বিষয় বারবার আমাদের সেই পুরনো প্রশ্নের মুখোমুখি করে- বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধ শুধু নয় বাঙালীর ভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতি ধ্বংস করার শত্রুগোষ্ঠী এখনও স্বাধীনতার ঊনপঞ্চাশ বছর পরও ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়ন করার উদ্দেশ্যে নতুন প্রজন্ম জন্ম নিচ্ছে কেন? অবশ্য এটা পুরাণ যুগ থেকেই চলে আসছে। যদিও মানবসভ্যতা এগিয়ে যাচ্ছে অথচ সুর- অসুরের প্রাচীন লড়াইটাও চলছে অব্যাহতভাবে। দুনিয়ার দেশে দেশে মানুষ দেখছে ধর্মান্ধ, গোঁড়া, কট্টরপন্থার উত্থান হচ্ছে। তাদের বাধা দিচ্ছে মানবতাবাদী, প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষিত গোষ্ঠী। বর্তমানে প্রায় সব দেশে ধর্মান্ধ গোষ্ঠী, হত্যা যাদের একমাত্র হাতিয়ার, তাদের আগ্রাসী হামলায় শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয় বা আফগানিস্তান নয়, ইউরোপ, আমেরিকা এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র্যে ক্লিষ্ট আফ্রিকার দেশে দেশে এই ঘৃণা প্রচারকারী হত্যাকারীদের হাতে প্রাণ হারাচ্ছে শত শত নিরীহ গ্রামবাসী, স্কুলের কিশোরী-কিশোর, নারী, পুরুষ, শিশু! এটি মানব সভ্যতাকে বিলুপ্ত করার একটি পদক্ষেপ। অন্যদিকে উন্নত দেশের নেতাদের প্রকৃতি সংহারক পদক্ষেপের ফলে পৃথিবী আজ প্রায় মৃত্যুমুখে পতিত। কিন্তু বাংলাদেশে বাঙালী জাতির বিশাল উত্তরাধিকার বিপুল লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির যে ভান্ডার রয়েছে, যা যুগ যুগ ধরে আমাদের গর্বের লালন সাঁই, শাহ আব্দুল করিম, হাছন রাজা, দুরবিন শাহসহ অসংখ্য লোকসঙ্গীতকার, বাউল ফকিরদের মাধ্যমে টিকে আছে, তার মূল শক্তি হচ্ছে মানবতাবাদ, ধর্মীয় ভেদাভেদহীন অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ দর্শন ও আচরণ। আমাদের অহঙ্কারের নাম যেমন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তেমনি সবচাইতে বড় গর্বের নাম লালন সাঁই, শাহ আবদুল করিম, হাছন রাজাসহ সব বাউল-ফকির দলের অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী দর্শন। আমাদের সৌভাগ্য, তরুণ প্রজন্মের সঙ্গীত শিল্পীদের কাছে বাউল-মারফতি-মুর্শিদী গানের অনুশীলন নতুনভাবে জনমনে উদারতার শিক্ষা প্রচার করছে। এটিই আমাদের জন্য সঠিক পথ, যা তরুণ প্রজন্ম উপলব্ধি করে নিজ জাতির সত্তা আবিষ্কারে মনোযোগ দিয়েছে। কিন্তু হঠাৎ একজন বাউল গায়ক শরিয়ত সরকারকে তার ধর্মান্ধতাবিরোধী বক্তব্যের জন্য পুলিশ গ্রেফতার করেছে। অথচ সরকার ধর্মান্ধতায় আক্রান্ত জেহাদী জঙ্গীবাদীদের দমনে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে উগ্র জঙ্গীবাদ নির্মূলের জন্য দেশে-বিদেশে প্রশংসিত! শরিয়ত সরকারের সঙ্গীত পরিবেশনার মধ্যে তিনি বলেছেন, ‘ইসলামে গান-বাজনা নিষেধ করা হয়নি। যদি কেউ কোন ধর্মীয় গ্রন্থে এ নিষেধাজ্ঞাটি দেখাতে পারে তবে আমি গান ছেড়ে দেব।’ আমরা নবীর উপদেশে দেখতে পাই, তিনি খাদ্য কেনার পর যদি একটি পয়সা উদ্বৃত্ত থাকে তাহলে ফুল কিনতে উপদেশ দিয়েছেন। তাছাড়া, যে বুড়ি তাঁর আসা-যাওয়ার পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখত, কদিন তাকে না দেখতে পেয়ে তাকে অসুস্থ দেখে সেবা দিয়েছেন, এ গল্পও পড়েছি। তাছাড়া, তাঁর অসামান্য বাগ্মিতা, বাস্তব জ্ঞান ও দূরদৃষ্টির প্রমাণ মেলে তাঁর বিদায় হজের ভাষণে। মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় শুরু থেকেই কট্টরপন্থী ইসলামের জন্ম হয়েছিল। প্রকৃত অর্থে আমাদের দেশে ইসলাম ধর্মটি এসেছে পারস্য থেকে আসা সুফী সাধকদের মাধ্যমে, যারা ছিলেন উদার অসাম্প্রদায়িক ইসলামের প্রচারক। তুরস্কের সুফী জালালউদ্দীন রুমি ভারতে শুধু মুসলমান নয়, হিন্দুসহ সব ধর্মের শিক্ষিত মানুষের কাছে অতি সম্মানীয় কবি, যার ভক্তের সংখ্যাও অনেক। তার রচনার অনুবাদের পাঠকপ্রিয়তা অনেক উচ্চে। এছাড়া, শেখ সাদী, হাফিজ, ফেরদৌসী- তাদের রচনার ভক্ত উপমহাদেশব্যাপী। তাদের পাশে পীর হিসেবে পশ্চিমবঙ্গে, পূর্ববঙ্গে যারা বসতি স্থাপন করেন তারা উদার মানবিক অসাম্প্রদায়িক, সেবাধর্মী ইসলামই প্রচার করেছেন। এ কারণে হিন্দু-বৌদ্ধ অধ্যুষিত দেশে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে অগণিত নিম্ন শ্রেণীর, নিম্ন দরিদ্র নারী পুরুষ। পীরদের ধর্মের বাণী প্রচারের বাইরে বড় একটি কাজ ছিল রোগের চিকিৎসা দেয়া। সেটি পানি পড়া, থালা পড়া, তাবিজ, কবচের মাধ্যমে করা হতো। তারা কখনও জমিদার বা সামন্ত রাজাদের মতো অত্যাচারী ছিল না। বাংলাদেশের একটি অনন্য সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য উদার ভেদাভেদহীন মানবিকতার দর্শন। শ্রী চৈতন্যের অনুসারী, বৈষ্ণব মতাদর্শী ও সুফী মতাদর্শী সাঁই, ফকিরদের মাধ্যমে সমাজের সাধারণ জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ক্রমশ এই ধারাটি পরিপুষ্ট হয়ে ওঠে। এমনকি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায়, গানে এই ভেদাভেদহীন অসাম্প্রদায়িক ভাবধারাটি অন্যতম ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর অনন্যসাধারণ প্রতিভার একটি বড় দিক এই যে, তিনি বাঙালীর এই ভেদাভেদহীন অসাম্প্রদায়িক মানবিকতাপূর্ণ সাংস্কৃতিক সত্তাটি উপলব্ধি করেছিলেন, যা তাঁর আগের, পরের কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, তাঁর কোন সহকর্মী উপলব্ধি করতে পারেননি! এটি তাঁর মধ্যে প্রোথিত এক বিরল উন্নত বোধ। ভাবলে বিস্মিত হতে হয়, গান-বাজনা-সঙ্গীত-সাহিত্যের চর্চা তাঁর পারিবারিক পরিবেশে খুব বেশি না থাকা সত্ত্বেও তাঁর প্রিয় গান, কবিতা, প্রবন্ধ ছিল! তাঁর পুত্র-কন্যারা একই সঙ্গে গান, বাজনা আবার খেলাধুলাকে ভালবেসেছেন। সুতরাং আমরা একজন গান গাওয়া মানুষকে তার দ্বারা ইসলামকে উদার ধর্ম হিসেবে বক্তব্য দেয়ার কারণে যে ব্যক্তির ধর্মীয় অনুভূতি ক্ষুণœ হয়েছে বরং সেই ব্যক্তিকেই কট্টর বলে গণ্য করতে হবে নাকি! যে ব্যক্তি উদার অসাম্প্রদায়িক ধর্ম সহ্য করতে পারে না সে তো অবশ্যই কট্টর। এদের সঙ্গেই তো সহজিয়া বাঙালীর লড়াই। এই লড়াই আমরা ব্রিটিশ যুগে ব্রিটিশ দ্বারা উস্কে দেয়া ধর্মান্ধ পীরদের মধ্যেও দেখেছি। আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা সৃষ্ট লাদেন, আল কায়েদা, তালেবান এবং পরে আইএস-এর মধ্যে দেখেছি। বাংলাদেশী বাঙালীর ভাষা ও সংস্কৃতির বিরোধিতা ’৪৭-এ, ৫২-তে, ৬২-তে, ৬৪-তে, ’৭১-এ, ২০০১-৬-এ এবং এরপর যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর ফটো নিয়ে সৃষ্ট তা-বে, খালেদা-তারেক নির্দেশিত জঙ্গী বাংলা ভাইসহ শতাধিক জঙ্গীর বোমা-গ্রেনেড হামলা, হিন্দু নির্যাতন, হত্যা, পেট্রোলবোমা দ্বারা যান চালক-যাত্রী হত্যা, পরে একের পর এক বিজ্ঞানমনস্ক ব্লগার, তরুণ লেখক, প্রকাশককে হত্যা, গুলশান ক্যাফেতে বাংলাদেশের উন্নয়নে সহযোগী বিদেশী বন্ধুদের হত্যা দেখেছে শান্তিপ্রিয় বাঙালী। অর্থাৎ ওরা, ঐ অসুরেরা আছে এবং নিরীহ সুর-সাধক গায়ক শরিয়ত সরকারকে ভ্রান্ত ব্যাখ্যা দিয়ে আঘাতও করেছে। কিন্তু কথা হচ্ছেÑ সরকার কি গায়কের বক্তব্যকে একজন জঙ্গী সাম্প্রদায়িক ব্যক্তির ইচ্ছায়, কট্টরপন্থীর অভিযোগকে গুরুত্ব দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার পক্ষে দাঁড়াবে? নাকি মৌলবাদী সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে উদার মানবিক ইসলামের পক্ষে বক্তব্য দানকারী গায়কটির পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করবে? আমার বিবেচনায় আইসিটি এ্যাক্টটি ঘৃণা প্রচারকারী, জঙ্গী মৌলবাদ প্রচারকারী এবং উদার ইসলামের পক্ষের ব্যক্তির বিরোধিতাকারীকে দন্ডদানের জন্যই ব্যবহার হতে পারে। সরকারকে এ প্রসঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, সেই ২০০১ থেকে যখন খালেদা-নিজামী-তারেক জঙ্গী জন্মদান করে তাদের রাজনৈতিক শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করছিল, তখন কিন্তু তারা শুধু কবি হুমায়ুন আজাদকে আঘাত করেনি, তারা আঘাত করেছে হিন্দু, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিকারী শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুন, বিরোধী দল আওয়ামী লীগের বহু নেতা-কর্মী-সমর্থক, বাউল গোষ্ঠী, যাত্রাপালা, সিনেমা হল, গ্রাম্যমেলার ওপর! এমনকি একজন কিশোর, যে যাত্রায় বাঁশি বাজাত, তাকেও হত্যা করে মাঠে ফেলে রেখেছিল! ব্রিটিশ হাই কমিশনার, সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ কিবরিয়াসহ ২১ আগস্টে তারা তাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য শত্রুদের ওপর চরম হামলা করেছিল- এ কথা বাঙালী যেন ভুলে না যায়। বাউল গ্রাম্য নিরীহ গায়ক শরিয়তের দ্রুত মুক্তি এবং সাম্প্রদায়িক অভিযোগকারীর বিচার করতে হবে। সরকারকে প্রকৃত দেশপ্রেমিক ও দেশদ্রোহীকে চিহ্নিত করে দেশদ্রোহীর, বাঙালী সংস্কৃতির বিরোধীদের বিচার ও শাস্তি প্রদান করে বাঙালী সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে হবে। কেবল এ পথেই দেশের স্বাধীনতা ও মানবিক লোক সংস্কৃতিকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী সরকার অবশ্যই অসাম্প্রদায়িক মানবিক ইসলামের সমর্থকদেরকেই সুরক্ষা দেবে- এটাই জাতি প্রত্যাশা করে। শরিয়ত বাউলকে দ্রুততম সময়ে মুক্তির দাবি মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী, অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল মানুষের দাবি। নিশ্চয়ই সরকার দ্রুত এ দাবি বাস্তবায়ন করে বাঙালীর জাতিসত্তাকে শত্রুমুক্ত করবে। লেখক : শিক্ষাবিদ
×