ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ভাষা

প্রকাশিত: ০৯:৪৪, ২৪ জানুয়ারি ২০২০

বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ভাষা

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫) বাঙালীকে কেবল ভাষাভিত্তিক জাতি-রাষ্ট্র উপহার দেননি, তিনি জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে বাংলা ভাষায় ভাষণ দিয়ে (১৯৭৪) এ ভাষাকে আন্তর্জাতিক ভাষার মর্যাদা দিয়েছেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তাঁর মহাকাব্যিক ভাষণে বাঙালী উদ্দীপিত হয় মহান মুক্তিযুদ্ধে। বঙ্গবন্ধুর শতাধিক ভাষণের অডিও সিডি থেকে বাছাই করা ৬৭টি ভাষণের শ্রুতিলিপির গ্রন্থরূপ ওঙ্কারসমগ্র (২০১৭)। গ্রন্থভুক্ত ভাষণগুলোর আলোচনায় আসবে তাঁর রাজনীতির ভাষাও। এতে করে জানা যাবে তাঁর ভাষা-দর্শন তথা জীবনদর্শন। বক্তৃতার ভাষা-শৈলী বিশ্লেষণে উন্মোচিত হবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও তাঁর দেশপ্রেমের চেতনা। যে-চেতনা বিতাড়িত করবে বাংলা ভাষার প্রতি বঞ্চনা, ফলে বাংলা ভাষা মাতৃভাষার আসনে থেকেও সর্বস্তরে রাষ্ট্রভাষার আসনে আসীন হবে সগৌরবে। ভাষণ এবং ভাষা দুটি শব্দের-ই উৎপত্তি সংস্কৃত ধাতু ভাষ্ থেকে। অভিধানে ভাষণ শব্দের প্রাথমিক অর্থ : উক্তি, বাক্য বা বচন। বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান-এ ভাষণ মানে : ১. ভাষা, ২. কথন, ৩. কথা ও ৪. বক্তৃতা। যদিও বর্তমানে বিবৃতি বা বক্তৃতা অর্থেই ভাষণ শব্দটি বাংলায় বহুল প্রচলিত ও অভিধানসিদ্ধ। বর্তমান প্রবন্ধে বক্তৃতা অর্থেই ভাষণ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। বলাবাহুল্য বঙ্গবন্ধুও ভাষণ দিতে গিয়ে-বক্তৃতা করার কথাই বলতেন। তবু ১৯৭১ সালে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে তাঁর ঐতিহাসিক বক্তৃতা ৭ মার্চের ভাষণ হিসেবেই বহুল পরিচিত এবং আলোচিত। অভিধানে ভাষা শব্দের প্রাথমিক অর্থ ভাব প্রকাশক উক্তি বা সংকেত। তবে বর্তমান আলোচনায় ভাষা বলতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের (১৯২০-১৯৭৫) বিভিন্ন ভাষণের বাচনভঙ্গি, তাঁর ব্যবহৃত শব্দাবলী-বাক্য-বাক্যাংশ ও তাঁর নিজস্ব ভাব প্রকাশের রীতি বা শৈলী (স্টাইল) বিবেচিত হবে। অর্থাৎ, ভাষণের ভাষাশৈলী বিশ্লেষিত হবে। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব-আমি বাঙালী, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’ বাঙালী জাতীয়তাবাদের প্রেরণায় সৃষ্ট বাংলাদেশের ভাষা-পরিস্থিতি অনুধাবনের জন্য তাই বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ভাষা সম্পর্কে ধারণা থাকা আবশ্যিক মনে হয়। এছাড়াও এ আলোচনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আরও শাণিত করে পাঠকের উপলব্ধিকে নতুন মাত্রায় উন্নীত করবে। বাগ্মী জননেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন সম্মোহন সৃষ্টিকারী ভাষণকার। ভাষণদানকারীকে বাংলা ভাষার অভিধানে বলা হয় ভাষণকার বা বক্তৃতাকার। বাংলা ভাষায় আগেকার দিনে বক্তৃতা বিশেষ্যপদকে ক্রিয়া বানাতে ‘বক্তৃতা করা’ মিশ্রক্রিয়া লেখা হতো। অক্ষয়কুমার দত্ত’র ভাষায় পাওয়া যায়: ‘তিনি অধিকসংখ্যক ভাষায় সৎপ্রণালীর সহিত লিখিতে ও বক্তৃতা করিতে পারিতেন’ (অক্ষয় ১৮৪২)। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বক্তৃতা বিশেষ্যপদের সঙ্গে দেয়া ক্রিয়া যোগ করে সংযোগমূলক মিশ্রক্রিয়া ‘বক্তৃতা দেয়া’ বানিয়ে বক্তব্য রাখা অর্থে লিখলেনÑ ‘এ বিষয়ে বক্তৃতা দেয়া বৃথা’ (রবীন্দ্রনাথ ১৮৯৪)। রবি ঠাকুরের সাহিত্যিক প্রভাবে প্রমিত বাংলায় এবং পশ্চিমবঙ্গের আঞ্চলিক ভাষায় বক্তৃতা দেয়া ক্রিয়াপদটি বহুল প্রচলিত রূপ লাভকরে। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে কলকাতার কথ্যভাষার ক্রিয়ারূপটি ব্যবহার করেননি। তিনি তাঁর ভাষণে ব্যবহার করলেন প্রাচীন বাংলার সাধুভাষা রীতির ও পূর্ববাংলার বা বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষায় বহুল ব্যবহৃত বুলিভান্ডার থেকে নেয়া বক্তৃতা করা ক্রিয়াপদটি ক. আমি আজ বক্তৃতা করতে পারব না। ...আজ আমি আর বক্তৃতা করতে পারছি না। একটু সুস্থ হলে আবার বক্তৃতা করব (১০/০১/১৯৭২, ঢাকা, পৃ. ১৯-২৪)। খ. আমি আমার সহকর্মীদের বলি তোরা আমারে আর বক্তৃতা করতে বলিস না। সত্যিই আমি আজকাল বক্তৃতা করতে পারি না (১৬/০২/১৯৭২, পাবনা, পৃ. ৩৮)। গ. আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি, ...অন্য অন্য জায়গায় অনেকে বক্তৃতা করেন (০৩/০৭/১৯৭২, কুষ্টিয়া, পৃ. ১০৮)। ঘ. ভাইয়েরা ও বোনেরা আমার, বক্তৃতা করার আমার কিছুই নাই। ...আমি বক্তৃতা করতাম যে, ভুঁড়িওয়ালা যদি আল্লাহ্ আমারে দিন দেয় তোমাদের ভুঁড়ি আমি কাইটা দেব। ওই ভুঁড়ি আমি কাইটা দিচ্ছি। আমি বক্তৃতা করতাম যে, ...আমি এখন বক্তৃতা করা ভুলে গেছি (২৬/১২/১৯৭২, যশোর, পৃ. ১৮৮ -১৯৩)। ঙ. তাই আপনাদের কাছে আমার কিছু সময় নিয়ে বক্তৃতা করা দরকার (১৮/০৩/১৯৭৩, ঢাকা, পৃ. ২৭৫)। চ. আমরা যে ফাইভ পার্সেন্ট শিক্ষিত সমাজ আমরাই হলাম দুনিয়ার সবচেয়ে খারাপ পিপল। আর আমরাই করি বক্তৃতা আমরাই লিখি খবরের কাগজে (২৫/০১/১৯৭৫, ঢাকা, পৃ. ৩৩৮)। ছ. আমি বক্তৃতা করলাম (০৮/০৩/১৯৭৫, টাঙ্গাইল, পৃ. ৩৪৯)। অবশ্য মাঝে মধ্যে বক্তব্য দেয়া মিশ্রক্রিয়া কিংবা ভাষণ বিশেষ্যপদটিও ব্যবহার করতেন ক. বেশি সময় আমি বক্তব্য দিতে চাই না (২৬/০৬/১৯৭২, নোয়াখালী, পৃ. ৯৩)। খ. এ ভাষণ বাঙালী জনগণের জন্য, আজ আমি দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে আপনাদের সামনে দাঁড়িয়েছি (১৮/০৮/১৯৭৪, ঢাকা, পৃ. ৩০৩)। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণ শুরু করতেন ‘ভায়েরা আমার’ সম্বোধন করে। তবে ১৬ জানুয়ারি ১৯৭২ ঢাকায় বক্তৃতা শুরু করতে গিয়ে প্রথম ব্যবহার করেনÑ ‘আমার ভাইয়েরা ও বোনেরা’। এর পর ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ ঢাকায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ শুরু করতে ব্যবহার করেনÑ ‘দেশবাসী ভাই ও বোনেরা আমার’। এখানে বঙ্গবন্ধুর আন্তরিকতা ও অন্তরঙ্গ-আত্মীয়তাবাচক শব্দ ‘ভাই-বোন’ ব্যবহার খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি প্রিয় দেশবাসীকে নিজের পরিবারের সদস্য ভাই ও বোন বলে সম্বোধন করে তাঁর ভাষণ শুরু করতেন। আর ১৯৭১ সনের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৭৫ সালের ৮ মার্চ পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি ভাষণ শেষ করেছেন ‘খোদা হাফেজ’ বা ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে এবং ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে। অথচ বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাযজ্ঞের পরেই খন্দকার মোশতাক আহমদ জাতির উদ্দেশে বেতার ভাষণ শেষ করেন ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিয়ে। এর কিছুদিন পরেই নির্দেশ আসে বেতারে ‘খোদা হাফেজ’ বলা যাবে না, ‘আল্লাহ হাফেজ’ বলতে হবে; কেননা, খোদা আরবী নয় ফারসী শব্দ। এভাবে এদেশের মানুষের মন থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম-নিশানা এমনকি তাঁর ব্যবহৃত প্রতিটি শব্দও মুছে দেয়ার ঘৃণ্য চেষ্টা হয়েছে। অন্যভাবে বললে, এই শব্দগুচ্ছের মধ্যে একটা উদার অসাম্প্রদায়িক চেতনা মিশে আছে, যা রক্ষণশীল-ধর্মান্ধ ও পশ্চাৎপদ-পাকিস্তানপন্থীরা মেনে নিতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ মার্চের ভাষণের শেষে ‘খোদা হাফেজ’ বা ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলেননি। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে ভাষণ শেষের আগে তিনি বলেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এখানে একটি বাক্যে চারবার ‘সংগ্রাম’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন বক্তা। সংগ্রাম সংস্কৃত ভাষা থেকে আগত বাংলা শব্দ। পনেরো শতক থেকে ব্যবহৃত এই শব্দের আভিধানিক অর্থ-যুদ্ধ (সং), আন্দোলন (সং), বিপ্লব (সং)। এর আরও কিছু প্রতিশব্দ বাংলায় প্রচলিত আছে, যেমন-রায়ট (ইং), দাঙ্গা (ফা), লড়াই (মুন্ডারি, অস্ট্রিকজাত হিন্দি), সমর (সং) ইত্যাদি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু একবারও অন্য কোন শব্দ ব্যবহার করেননি। যুদ্ধ, লড়াই বা সমর শব্দ ব্যবহার করলে বক্তাকে যুদ্ধ ঘোষণার অভিযোগ দেয়া যেত, বিপ্লব ব্যবহার করলে, তাকে বিপ্লবী বা বিদ্রোহী বলে দমন করা যেত। সংগ্রাম এখানে সুনির্দিষ্ট অর্থে বক্তার সুনির্বাচিত শব্দ। প্রতিটি বাঙালী বুঝল যুদ্ধের ঘোষণা; পাকিস্তানীরা ভাবল আন্দোলন। আমরা জানি, আন্দোলন মানে আলোড়ন বা খোঁজাখুঁজি। ভাষার জন্য বাঙালীর ভাষা-আন্দোলন, কিন্তু মুক্তির জন্য সংগ্রাম। শহুরে মানুষ বইপত্রে মুক্তিযুদ্ধ লিখলেও, গ্রামের সাধারণ মানুষ কিন্ত এখনও ‘মুক্তি সংগ্রাম’-ই বলেন। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল প্রসঙ্গে আমার মা প্রায়ই সিলেটি ভাষায় বলেন- ‘সংগ্রার্ম বর্ছ র্ত জন্ম’। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী পক্ষের লোকজন ১৯৭১ সালকে বলেন ‘গন্ডগোলের বছর’। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী দলের মুখপত্র দৈনিকের নাম যদিও ‘সংগ্রাম’, তবে আজও আলবদরের বংশধররা মুক্তি কথাটি মুখে আনেন না। খুব কৌশলী হলে তাঁরা স্বাধীনতার কথা বলেন। অথচ ঐ একটি বাক্যের দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়- এখানে বক্তার কাছে পরিষ্কার-স্বাধীনতা আসলেই সংগ্রাম শেষ হয়ে যাবে না, মুক্তির সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। কেননা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও লক্ষ্য যে ওই। তাই তো ২৩ মার্চ ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু তাঁর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে দেয়া সংক্ষিপ্ত এক কাব্যিক ভাষণে বলেন- ‘দরকার হয় আরও রক্ত দেবো, কিন্তু বাংলার মানুষকে আর পরাধীন থাকতে দেবো না। আপনাদের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত আমার সংগ্রাম চলবে’ (পৃ. ১৮)। এই ভাষণেও বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ও মুক্তির কথা বলেছেন। বাঙালীকে রক্তদানের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন। অথচ আক্ষরিক অর্থে মনে হয় তিনি মুক্তিযুদ্ধে আহ্বান জানানোর প্রমাণ অদৃশ্য করে রেখেছেন তাঁর ভাষাশৈলীর মুন্সিয়ানায়। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন মুক্তির লক্ষ্যে। তাঁর রাজনৈতিক দর্শনও তা-ই। স্বাধীন দেশে ভাষণ দিতে গিয়েও তিনি তা বার বার বলেছেন- ‘আমি রাজনীতি করেছিলাম আমার সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তির জন্য। এখন আমার রাজনীতি মুক্ত হয়েছে। আমার অর্থনীতি মুক্তি প্রয়োজন। এইটা না হলে স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে’ (২৮/০৬/১৯৭২, সিলেট, পৃ. ১০০)। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী’র ভাষায় বলতে হয়- ‘মুক্তি। মুক্তির ওই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই একাত্তরের যুদ্ধ, ...যুদ্ধের পেছনে যে-চেতনা সেটা মুক্তির, যে-মুক্তির একটা সংজ্ঞা পাওয়া গেছে চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে। ...এল দূরবর্তীদের শাসন তখনই সম্ভব হয়েছে মূলনীতির সংশোধন। মুক্তির জায়গায় এসেছে স্বাধীনতা। ...জনগণ সংগ্রাম করেছে কিন্তু মুক্তি পায়নি। ...কিন্তু মুক্তির সংগ্রাম চলছে। সরবে নয়, নীরবে। তাকে চলতেই হবে, নইলে আমাদের ভবিষ্যত কী, দাঁড়াবার জায়গা কোথায়?’ এই দাঁড়ানোর জায়গার জন্যই আমাদের জানতে হবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ভাষাশৈলী। কেননা এ কেবল ভাষা কিংবা শব্দমাত্র নয় এযে মুক্তির চেতনা। ৭ মার্চের ভাষণেও তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ্।’ এই ইনশাল্লাহ্ আরবী অব্যয়ের ব্যবহার বঙ্গবন্ধুর বেশ কয়েকটি ভাষণে পাওয়া যায়- ক. ইনশাল্লাহ্ বাংলা রাষ্ট্রভাষা হয়েছে। ...ইনশাল্লাহ্ রক্ত যখন দিতে শিখেছি, বাঙালী তার দাবি আদায় করবে (২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১, ঢাকা, পৃ. ১১-১৩) খ. ইনশাল্লাহ্ সোনার বাংলা একদিন সোনার বাংলা হবে (২৬ জুন, ১৯৭২, নোয়াখালী, পৃ. ৯৪) গ. ইনশাল্লাহ্ যদি আপনারা সুষ্ঠুভাবে কাজ করেন, আবার সোনার বাংলা হাসবে, আবার মানুষ পেট ভরে ভাত খাবে, আবার মানুষ সুখী হবে, (৩ জুলাই, ১৯৭২, কুষ্টিয়া, পৃ. ১০৪)। এখানে লক্ষণীয়, বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা এই আরবী অব্যয় ব্যবহার করে কেবল জোর নিশ্চয়তাই প্রদান করেননি, এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের পবিত্র ধর্মীয় ভাষার শব্দ ব্যবহার করে তাঁদের মধ্যে আশাবাদ জাগাতে চেয়েছেন। এমনকি ধ্বংসের ভাষিকচিত্র তুলে ধরে ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়েও ভরসার বাণী শোনান; দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় নিয়ে ঘোষণা করেন: ‘গুদামের চাল ধ্বংস করেছ, রাস্তাঘাট নষ্ট করেছ, বাস-ট্রাক পোড়ায়ে দিয়েছ, পোর্টের মধ্যে জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছ। রেললাইনকে ধ্বংস করে গেছ। সব করে গেছ। কিন্তু একটা জিনিস করতে পার নাই ভুট্টো সাহেব। সেটা হলো বাংলার মানুষের ইমান আর বাংলার মানুষের শক্তি। মানুষের শক্তির সামনে কেউ দাঁড়াতে পারে না’ (৩ জুলাই, ১৯৭২, কুষ্টিয়া, পৃ. ১০৪)। এই মানুষের প্রতি ইমান বা বিশ্বাসই তাঁকে অসাম্প্রদায়িক করেছে, মানবিক করেছে, সর্বোপরি মানুষের মুখের মিশ্রভাষা বা আরবী-ফারসী-ইংরেজী-সংস্কৃত মিশ্রিত বাংলা ভাষা ব্যবহারে প্রেরণা দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু ইসলামিয়া কলেজে পড়াশোনার কয়েক বছর কলকাতায় ছিলেন। এ ছাড়া বাকি সময় কাটিয়েছেন গোপালগঞ্জে কিংবা ঢাকায়; আরও স্পষ্ট করে বললে পূর্ব বাংলায় বা বর্তমান বাংলাদেশে। তাঁর রাজনীতিও বাংলাদেশের মানুষের জন্য। সুতরাং, তাঁর ভাষণের দর্শকশ্রোতাও বাংলাদেশের সাধারণ মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত খেটে খাওয়া জনসাধারণ। ফলে প্রমিত বাংলায় ভাষণ দিতে দিতেই আচমকা তিনি ব্যবহার করতেন বাংলাদেশের মানুষের কথ্যভাষার ক্রিয়াপদগুলো। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহযোগী অধ্যাপক প্রশ্ন রেখেছেন: বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে বলেন- ‘দাবায়া রাখতে পারবা না’; যদি পুরা ভাষণ নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় দিতেন, তা হলে কি খুব ভাল হতো? আসলে প্রশ্নটা হওয়া উচিত এই রকমÑ কোন বিশুদ্ধ আঞ্চলিক ভাষায় কি এই ভাষণ হতে পারত? আমার তো ধারণা, পারত না। কোন অন্যরকম জনগোষ্ঠীর সামনে অন্য কোন পরিস্থিতিতে সম্পূর্ণ আঞ্চলিক ভাষায় কোন মহাকাব্যিক ভাষণ হতেও পারে।’ আসলে বঙ্গবন্ধু কোন আঞ্চলিক ভাষায় ভাষণ দেননি। কোন ভাষণের কোন একটি পূর্ণ বাক্যও বাংলাদেশের নির্দিষ্ট কোন আঞ্চলিক ভাষায় উচ্চরণ করেননি। কেবল কিছু ক্রিয়াপদ তাঁর বজ্রকণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে- পূর্ববাংলার মানুষের কথ্যভাষা থেকে উঠে এসে। তাঁর তর্জনীর মতো নিঃসঙ্গ-স্থির-তীব্র একেকটি ক্রিয়াপদ যেন- ক. আমাদের বাংলাদেশের ভায়েরা, বোনোরা রক্ত দিয়ে দেখায়ে গেছে (২১/০২/১৯৭১, ঢাকা, পৃ. ১১)। খ. ৭ কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না। ...তাদের বেতন পৌঁছায়া দেবেন। ...যাতে মানুষ তাদের মাইনাপত্র নিবার পারে (০৭/০৩/১৯৭১, ঢাকা, পৃ. ১৬)। গ. কিন্তু আমি জানতাম আমার বাঙালীকে কেউ দাবায় রাখতে পারবে না। ...আপনারা, আমি দেখায় দিবার চাই দুনিয়ার কাছে যে শান্তিপূর্ণ বাঙালী রক্ত দিতে জানে, (১০/০১/১৯৭২, ঢাকা, পৃ. ১৯-২১)। ঘ. সেই রাত্রে আপনাদের ঘরবাড়ি সব জ্বালায়া দেয়া হয়। ...ছোট ছোট কুঁড়েঘর বানায়ে আছে ...সেগুলোও ... লোকগুলো পোড়ায়ে দিয়েছিল (১৬/০১/১৯৭২, ঢাকা, পৃ. ২৫)। ঙ. আমি যাবার সময় তাদের অস্ত্র দেবার পারি নাই। ...মনে করেছিল বন্দুক দিয়েই বাংলাদেশকে দাবায়া রাখবে (০৫/০২/১৯৭২, কলকাতা, পৃ. ২৯Ñ৩০)। চ. টাকা-পয়সা সোনা-রূপা যা ছিল চুরি কইরা দস্যুর দল বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে গেছে। ... পশ্চিমাদের রাস্তা দেখায়া নিয়া আমার গ্রামকে গ্রাম জ্বালায়ে দিয়েছে, (১৬/০২/১৯৭২, পাবনা, পৃ. ৪০-৪১)। ছ. আজিজ তুমি যদি বেঁচে থাকতা দেখতা বাংলাদেশ আজ স্বাধীন (২৯/০৩/১৯৭২, চট্টগ্রাম, পৃ. ৫৫)। জ. আমি আমার ৭ কোটি লোকেরে যাবার বেলায় কিছুই দেবার পারি নাই। ...বিশ্বাস করেন যেদিন আমি পাকিস্তান থেইকা ফিরা আইসা, আমার ইচ্ছা ছিল না যে আমি প্রধানমন্ত্রী হই। ...আমার শতকরা ৬০ জন পুলিশকে মাইরা থুইয়া গেছে। ...আমি মিথ্যা কথা বলে আমি মানুষকে ধোঁকা দিবার পারব না। ...যাতে চাটার দল যাতে চাটা না খাইতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখবেন (০২/০৪/১৯৭২, ঠাকুরগাঁও, পৃ. ৬১-৬৬)। ঝ. জানি না মনকে বুঝ দিতে পারি না, ...আমি চিন্তা করলে শিহরিয়া উঠি। ...তোমার জিন্নাহ সাহেব বাইচা থাকতেই ৪৮ সালে আমি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করেছি। ...তুমি মানবা না? তোমার চৌদ্দপুরুষ মাইনা বইসা রইছে। ...আমি তো আসমান থাইকা পড়ি নাই (১০/০৪/১৯৭২, পাবনা, পৃ. ৮৫-৯১)। ঞ. আল্লাহ যদি বাঁচায় রাখে ভুট্টো সাহেব, বাংলার মানুষকে আমি বাংলায় ফিরায় আনবো, আপনি রাখতে পারবেন না। ...আর কিছু কিছু রাজাকার আলবদর, যারা আমার লোকেরে মারছে, তারা পলায়া পলায়া বেড়াচ্ছে এবং জায়গায় জায়গায় সুযোগ পাইয়া আবার কাছিমের মতো মাথা বাইর করছে (২৬/০৬/১৯৭২, নোয়াখালী, পৃ. ৯৪-৯৭)। ট. চিন্তা কইরেন না। খাবার কিছু পৌঁছায়া যেভাবে হয় দেয়া হবে (২৮/০৬/১৯৭২, সিলেট, পৃ. ১০১)। ঠ. বাংলার মানুষকে খাওয়াইয়া বাঁচাইবার জন্য (০৩/০৭/১৯৭২, কুষ্টিয়া, পৃ. ১০৪)। ড. এমন কোন দ্বীপ ছিল না, যে দ্বীপে আওয়ামী লীগ কর্মীদের নিয়ে আমি রিলিফের কাম করি নাই এবং খাওয়া আর কাপড় পৌঁছাই নাই (১৬/১২/১৯৭২, ঢাকা, পৃ. ১৭১)। ঢ. আপনাদের আমি ভাত দেবার পারি নাই। ...আমার ফিফটি পারসেন্ট আর্মিকে মাইরা ফালাইছে। ...প্রাইমারি স্কুল টিচার ভাইরা, কয়েক মাসের মধ্যে আপনারা সরকারী কর্মচারী হইয়া যাইবেন। ...কন মিয়ারা কয় টাকা খাজনা দেছেন? কয় টাকা ট্যাক্স দিছেন? (২৬/১২/১৯৭২, যশোর, পৃ. ১৮৯-১৯৩)। ণ. মেরে হত্যা করে গাছে টাঙায় রেখেছিল। ...এরা মনুষ্যত্ব হারায় ফেলাইছে। ...দেখেন নাই যে মাইয়া লোকরে মাইরা গাছে টানায় রাখছে? ...ভোটের গন্ধ পাইলেই এক দল লোক দাঁড়ায় যায়। যদি তারপরে আবার না দেয় বিসমিল্লাহ কইয়া বিছানা কইরা শুইয়া পড় তাতেও আপত্তি নাই (০২/০১/১৯৭৩, পিরোজপুর, পৃ. ১৯৪-২০১)। ত. যেই ভোটের গন্ধ পাইছে সব আবার আইসা দাঁড়ায় গেছে। ...হ্যাঁ আগে মাঝে মাঝে জেলে যাইয়া একটু বিশ্রাম হইত (০৩/০১/১৯৭৩, বরগুনা, পৃ. ২০৮-২০৯)। থ. একটা মানুষ, আপনারা কেন দুর্নীতি করেন আমাকে বুঝায়া বলেন তো। ...আমি তো তিনবার আমাকে ফাঁসি দেয়ার নেছে। ...আর আমার দরজার কাছে কবর কইরা আমার মাথা কিনতে পারে নাই। ...কিন্তু আল্লাহ আমাকে বাঁচায় এনেছে (০৮/০৩/১৯৭৫, ঢাকা, পৃ. ৩৪৮-৩৪৯)। বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত এসব ক্রিয়াপদগুলোর ব্যবহারকে আমলে আনা হয়নি আজও। অথচ বাংলা ভাষানীতি প্রণয়নে কিংবা বাংলা ভাষা-পরিকল্পনা করতে জাতির জনকের ভাষাদর্শন ও ভাষা-শৈলী গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা হতে পারত। আটষট্টি হাজার গ্রাম নিয়ে গড়ে ওঠা যে বাংলাদেশ, সে দেশের শহুরে মানুষের ভাষায় তথা প্রমিত ভাষায় ভাষণ দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বার বার মিশ্রশব্দ ও সমার্থক শব্দ ব্যবহার করেছেন। যেমন- ‘দুনিয়ার ইতিহাসে স্বাধীনতার সংগ্রামে এত লোক আত্মাহুতি, এত লোক জান দেয় নাই’(১০/০১/১৯৭২, ঢাকা, পৃ. ২০)। এখানে আত্মাহুতি তৎসম শব্দের সমার্থক জান আরবী শব্দ। এভাবে শহর-গ্রামকে মিলিয়ে দিতে তৎসম-আরবী শব্দকেও তিনি একই পঙ্ক্তিতে বসিয়েছেন অনায়াসে। যেমন- ক. ‘...কলগুলোকে রাষ্টীয়করণ করা হয়েছে। কাজ করতে হবে। এগুলোর উৎপাদন করতে হবে। প্রডাকশন বাড়াতে হবে’ (২৯/০৩/১৯৭২, চট্টগ্রাম, পৃ. ৫৮)। খ. ‘ইওর সার্ভিস নো লংগার রিকোয়ার্ড-আপনার চাকরি আর দরকার নাই’ (০৫/০৪/১৯৭২, ময়মনসিংহ, পৃ. ৭৪)। গ. ‘ তোমাদের জন্য আমার শুভেচ্ছা রইল। তোমাদের জন্য আমার স্নেহ রইল। তোমাদের জন্য আমার ভালবাসা রইল’ (০২/০৯/১৯৭৪, ঢাকা, পৃ. ৩১০)। ঘ. ‘৭ মার্চ আমি বাংলার মানুষকে ডাক দিয়েছিলাম, ২৫ মার্চ বাংলার মানুষকে হুকুম দিয়েছিলাম’ (০৮/৩/১৯৭৫, টাঙ্গাইল, পৃ. ৩৪৬)। এভাবে কখনও বাংলায় বলে আবার ইংরেজীতে বলেন, কখনও ইংরেজীতে বলে আবার সহজ বাংলায় বলেন। আবার বাংলায় ডাক দেয়ার কথা বলেই আরবি হুকুম দেয়ার কথা বলেছেন। মানুষকে তাঁর ভাষণের সঙ্গে সক্রিয় করতে ভাষণে তিনি ওয়াজ কিংবা আড্ডার ঢং ব্যবহার করেছেন- ক. ‘... জাতিকে গঠন করার সংগ্রামে আপনরা আমার সঙ্গে আছেন কি না, হাত তোলেন, আমি দেখতে চাই। হাত নামান। হাত নামান, হাত নামান, ঠিক আছে’ (০৩/০৭/১৯৭২, কুষ্টিয়া, পৃ. ১০৬)। খ. ‘তোমাদের কাছে আমি জানতে চাই, আমি কঠোর হয়ে যদি এই সমস্ত দুর্নীতিকারীদের চরমভাবে দমন করি, তোমরা আমাকে সাহায্য করবা কি করবা না? আমার উপর তোমাদের আস্থা আছে কি নাই? আমি দেখতে চাই। হাত তুলে আমাকে দেখাও’ (১৬/১২/১৯৭২, ঢাকা, পৃ. ১৭০)। গ. জনসাধারণ ভাইয়েরা ও বোনেরা, আমি যদি শক্ত হাতে এগুলোরে দমন করি, আপনারা আমাকে সাহায্য করবেন কি না হাত তুলে ওয়াদা করেন। দুই হাত তুলেন’ (২৬/১২/১৯৭২, যশোর, পৃ. ১৯০)। ঘ. ‘আমার উপর আস্থা আছে কি না? দুহাত তুলে আপনারা আমাকে দেখায়ে দেন’ (১৮/০২/১৯৭৩, মৌলভীবাজার, পৃ. ২৪০)। এভাবে জনগণের সঙ্গে ভাষণের মাধ্যমে সংযোগ স্থাপন করা অন্যকথায়, ভাষণকারের সঙ্গে ভাষণের দর্শককে সম্পৃক্ত করবার কৌশল বঙ্গবন্ধুর ভাষা- শৈলীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অনুকার শব্দের ব্যবহারও বঙ্গবন্ধুর ভাষণে প্রচুর। যেমন- ‘এর মধ্যে কোন কিন্তু ফিন্তু নাই’ (পৃ.৩২, ৩২১)। ‘গদি-ফদি আমি চাই না’ (পৃ.৬৫)। ‘ফুটফাট চুপচাপ ফুঁসফাঁস করেন’ (পৃ. ৯৬)। ‘ দেশের জন্য কাজ কর, বড় বড় বক্তৃতা-ফক্তৃতা বাদ দাও’ (পৃ. ১০১)। অস্ত্র টস্ত্র (পৃ.১০৫), শহরে ফহরে (পৃ. ১০৬), চোর চোট্টা (পৃ. ১০৮), বুইঝা সুইঝা চল (পৃ. ১৬৮), ‘আমার কাছে দাবিদুবি নাই। আমি ওই প্রধানমন্ত্রী-টধানমন্ত্রী মানিটানি না’ (পৃ.১৯১), ভিক্ষা-টিক্ষা (পৃ. ১৯৮), হত্যা-ফত্যা (পৃ. ১৯৯) , কারখানা-ফারখানা (পৃ. ২০১)। ফাঁসি-টাঁসি, কবর-টবর (পৃ. ২০৮), দাবায়ে-দুবায়ে (পৃ. ২৩৮), উল্টা-পাল্টা (পৃ.২৩৯), তাই ছেলেরা নকল আর চলবে-টলবে না’ (পৃ. ৩৪৭), ‘ভয়-টয় আমি করি-টরি খুব কম’ (পৃ.৩৪৯), কিন্তুটিন্তু নাই (৩৫০)। দ্বিরুক্ত শব্দ ব্যবহারও তাঁর ভাষণের লক্ষণীয় শৈলী- ‘গটর গটর মদ খাইয়া পড়ে থাকেন আর ইসলাম ইসলাম করেন’ (পৃ. ৯৫)। ‘এখনও ঘুচুর ঘুচুর ফুচুর ফুচুর বন্ধ হয় নাই’ (পৃ. ১৯৯)। এসবের ব্যবহার ভাষণের ভাষাকে যেমন শ্রুতিমধুর ও ব্যঞ্জনাময় করেছে তেমনি বক্তব্যকে করেছে সহজ ও প্রাণবন্ত। শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ কিংবা আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি’ কবিতার মতো বঙ্গবন্ধুর ভাষণেও এই ধাঁচের বাক্যের বারংবার ব্যবহার পাঠক- শ্রোতাকে নাড়া দেয়। তাঁর ভাষণের ভাষায় এই কাব্যিক পুনরাবৃত্তির নমুনা প্রচুর দেখা যায়- ক. ‘ভুলে যেয়ো না, এই বাংলা তিতুমীরের বাংলা। ভুলে যেয়ো না, এই বাংলা সূর্যসেনের বাংলা। ভুলে যেয়ো না এই বাংলা নেতাজি সুভাষচন্দ্রের বাংলা। ভুলে যেয়ো না এই বাংলা ফজলুল হকের বাংলা। ভুলে যেয়ো না এই বাংলা সোহরাওয়ার্দীর বাংলা’ (০৫/০২/১৯৭২, কলকাতা, পৃ.৩০)। খ. ‘সে ইতিহাস বলতে চাই না। বলতে চাই না ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন। বলতে চাই না ১৯৫২ সালের আন্দোলন। বলতে চাই না ১৯৫৪ সালের ৯২ক ধারা। বলতে চাই না... বলতে চাই না কিছুই’ (১৬/১২/১৯৭২, ঢাকা, পৃ. ১৬৭)। গ. ‘এই জয় শেখ মুজিবুর রহমানের জয় নয়, এই জয় আওয়ামী লীগের জয় নয়, এই জয় নীতির জয়, এই জয় বাংলার ৩০ লাখ লোকের শহীদের রক্তের পরের জয়, এই জয় বাংলার জনগণের জয়, এই জয় বাংলার আদর্শের জয়, এই জয় বাংলার নীতির জয়’ ( ১৮/০৩/১৯৭৩, ঢাকা, পৃ.২৭৪)। ঘ. ‘সম্মানই যদি দিতে হয়, ঐ রিক্সাওয়ালা সম্মানী। সম্মানই যদি দিতে হয়, ঐ কৃষক যে মাঠে কাজ করে সে সম্মানী। সম্মানই যদি দিতে হয়, তাহলে যে কাজ করে খায় সে সম্মানী’ (০৮/০৩/১৯৭৫, টাঙ্গাইল, পৃ.৩৪৮)। বঙ্গবন্ধু এই ধারাবাহিক উপস্থাপনের মধ্যদিয়ে বাঙালীর ইতিহাস, আবেগ আর আগামীর স্বপ্ন-সম্ভাবনাকে একত্রে শিল্পরূপ দান করেছেন, তাঁর নান্দনিক ভাষার কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে। বিশ্বইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ বক্তৃতার সঙ্গে তুলনা করা হয়। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর UNESCO এই ভাষণকে Memory of the World Register এর অন্তর্ভুক্ত করে। ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক পরামর্শক কমিটি (ওঅঈ) ১৩০টি ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ দলিল, নথি ও বক্তৃতার মধ্যে ৭৮টি বিষয়কে নির্বাচিত করে, এর মধ্যে ৭ মার্চ ভাষণের অবস্থান ৪৮তম। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক জ্যাকব এফ ফিল্ডের ভাষণ সংকলন The Speech the Inspired History এ বিশ্বের সেরা ৪১টি ভাষণের মধ্য স্থান পেয়েছে ৭ মার্চের ভাষণ। জ্যাকবের বইয়ে ৭ মার্চের ভাষণটির শিরোনাম দেয়া হয়েছে The Struggle : This Time is the Struggle for Independence. কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো মনে করেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ কেবল একটি ভাষণ নয়, এটি একটি অনন্য রণকৌশলের দলিল’। আর আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা মন্তব্য করেন, ‘৭ মার্চের ভাষণ আসলে ছিল স্বাধীনতার মূল দলিল’। সমাজবিজ্ঞানী অনুপম সেন যথার্থই বলেন: ‘আর কোন স্মরণীয় ভাষণের বক্তা এ রকম একটি বিশাল জনসমুদ্রে তাৎক্ষণিক শব্দচয়নের মাধ্যমে এমন একটি মহাকাব্যিক ভাষণ দেননি। ...সব মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য লৌকিক বাক্য প্রয়োগ করলেন, যার অনন্য উপমা: ‘...এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু-আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।’ সাধারণ মানুষকে জাগাতে সাধারণ মনুষের প্রতিদিনের ব্যবহৃত বাক্যের কী অসাধারণ প্রয়োগ!’ ১৩ নবেম্বর ২০১৭-তে ঐতিহাসিক এ ভাষণের উপর একটি বিশ্লেষণধর্মী বই ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ: রাজনীতির মহাকাব্য’ শিরোনামে আইসিটি মন্ত্রণালয় থেকে ই-বুক ও মোবাইল এ্যাপ হিসেবে ‘সেই বই’ উদ্বোধন করা হয়। এতে সন্নিবেশিত ৭ মার্চের ভাষণের ভাষা সম্পর্কে কয়েকটি মন্তব্যে চোখ বুলানো যাক- ১. এ ভাষণের ভাব, ভাষা, শব্দচয়ন ও সাহসী উচ্চারণ মানবজাতির সংগ্রাম ও আন্দোলনের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় উপাদানে পরিণত হয়েছে। ... বঙ্গবন্ধু তাঁর অনন্য বাগ্মিতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার আলোকে তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বাঙালী জাতির আবেগ, স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষাকে একসূত্রে আবদ্ধ করেন। -শেখ হাসিনা, ‘মুখবন্ধ’, পৃ. ৩-৬ ২. ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁর মহাকাব্যিক ভাষণে বাংলার মানুষকে তাঁর কথা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে জোরালো ভাষায় ব্যক্ত করে সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে নতুন করে জাগিয়ে তুলেছিলেন। -মুস্তফা নূরউল ইসলাম, পৃ. ২৮ ৩. তাঁর ৭ মার্চের ভাষণের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য ছিল খুবই পরিশীলিত ও যুক্তিনির্ভর। -সৈয়দ বদরুল আহসান, পৃ. ৬৯ ৪. এ ভাষণে মাছে-ভাতে বাঙালীর অনমনীয় দৃঢ়তাও ফুটে উঠেছে। বলেছেন, ‘আমরা ভাতে মারব, পানিতে মারব।’ -কামাল চৌধুরী, পৃ. ১৩৮ ৫. রক্ত যখন দিয়েছি শব্দত্রয়ীর মধ্যে আছে বাঙালী জাতির দীর্ঘকালীন সংগ্রামের ইতিহাস। সেখানে অতি সতর্কতার সঙ্গে ব্যক্ত হয়েছে বাঙালীকে মুক্তির লড়াইয়ে কতোবার ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে তারই সংক্ষিপ্ততম উল্লেখ। আর শেষ বাক্যাংশের মধ্যে অধিকতর ত্যাগে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান এবং যে অনুচ্চারিত কথা বলা হয়েছে, তার মর্মবাণী হলো রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের শেষে আছে বিজয়ের রৌদ্রকরোজ্জ্বল রেখা। -আবেদ খান, পৃ. ১৪৩ ৬. এই ভাষণে বঙ্গবন্ধুর শব্দচয়ন লক্ষ করবার মতো। জনসভায় যে লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতি, তাঁরা অধিকাংশ ছিলেন গ্রাম-বাংলার অশিক্ষিত বা নিরক্ষর জনগণ। বঙ্গবন্ধু জানতেন, জনগণের মনের কথা বলতে গেলে তাদের মুখের ভাষায় বলতে হবে। তিনি তাই করেছেন। ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি’ বাক্যটি যদি শুধু শহরের শিক্ষিত মানুষদের জন্য উচ্চারণ করতেন, তা হলে তিনি বলতেন- আমি যদি হুকুম দিতে না পারি। কিন্ত বাক্যটিকে তিনি সেভাবে উচ্চারণ করেননি। -আবদুল খালেক, পৃ. ১১৪ ৭. তিনি যদি প্রমিত বাংলা ব্যবহার করতেন তা হলে বলতেন, সাত কোটি মানুষকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না। তিনি প্রমিত বাংলা ব্যবহার করেননি। আঞ্চলিক শব্দ সহযোগে আঞ্চলিক ক্রিয়াপদ ব্যবহার করে মুহূর্তের মধ্যে বাঙালী জাতিসত্তার হৃদয়ের বিশাল এক দরজা খুলে দিয়েছেন। যে দরজা পথে বেরিয়ে এসেছে বাঙালী চরিত্রের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য। ... তিনি রচনা করেছেন ছোট অথচ তীক্ষ্ন; অপ্রমিত অথচ গভীর অর্থবহ বাক্য। ...৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু সেদিন বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’। লক্ষণীয় বিষয় যে এই বাক্যটি তিনি প্রমিত বাংলায় বলেছেন। ...মুক্তির সংগ্রাম এবং স্বাধীনতার সংগ্রাম এককভাবে হয় না। এর জন্য প্রয়োজন হয় আন্তর্জাতিক সমর্থন, সাহায্য এবং সহযোগিতা। তাই বাক্যটি উচ্চারিত হয় প্রমিত বাংলায়। বাঙালী জাতিসত্তার উর্ধে পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে মেলবন্ধনের প্রত্যাশায়। -সেলিনা হোসেন, পৃ. ১১৭Ñ১১৮ ৮. বঙ্গবন্ধুর বাচন-ভঙ্গি ছিল খুবই সহজ-সরল এবং মর্মস্পর্শী। সম্ভবত এ কারণেই তিনি দেশের সাধারণ মানুষের কাছে এত সহজে পৌঁছুতে পেরেছিলেন। মানুষকে হত্য করবার বিষয়টি কতো না ভিন্ন উপায়ে বলা সম্ভব। বঙ্গবন্ধু সেটিকে বলেছেন, ‘মায়ের কোল খালি করা’। এবং সম্ভবত এই বাক্যচয়নের জন্যই কথাগুলো মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করে। -মুহম্মদ জাফর ইকবাল, পৃ. ৪৮। ১৯৭২ সালের ৪ নবেম্বর জাতীয় সংসদে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হবার মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তাতে জাতীয়তাবাদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের স্বরূপ উন্মোচিত হয়। অতি সাধারণ ভাষায় বঙ্গবন্ধু জাতীয়তাবাদের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন- ‘ভাষাই বলুন, শিক্ষাই বলুন, সভ্যতাই বলুন, আর কৃষ্টিই বলুন, সকলের সঙ্গে একটা জিনিস রয়েছে, সেটা হলো অনুভূতি। ...এই সংগ্রাম হয়েছিল যার উপর ভিত্তি করে সেই অনুভূতি আছে বলেই আজকে আমি বাঙালী, আমার বাঙালী জাতীয়তাবাদ।’ (চলবে)
×