ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মো. আনিসুজ্জামান

বিদ্যাসাগরের দর্শনচিন্তা

প্রকাশিত: ০৯:৪৭, ২৪ জানুয়ারি ২০২০

 বিদ্যাসাগরের দর্শনচিন্তা

বাঙালি রেনেসাঁসের অন্যতম প্রাণশক্তি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসার (১৮২০-১৮৯১) এক অনন্য চরিত্র। তিনি দার্শনিক, সমাজ-সংস্কারক, শিক্ষাবিদ এবং আধুনিক বাংলা গদ্যের অন্যতম রূপকার। কুসংস্কারমুক্ত, যুক্তিবাদী এবং বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ নির্মাণের জন্যে তিনি ছিলেন নিবেদিন প্রাণ ক্ষমজন্মা এক বাঙালি। নারীবাদী এবং শিশু শিক্ষার প্রসার সবকিছুই ছিলো তাঁর চিন্তার মধ্যে। নীতি শিক্ষক হিসেবে তিনি সর্বাধিক পরিচিত। দার্শনিক হিসেবে তিনি ছিলেন বস্তুবাদী। বস্তুকে কেন্দ্র করে প্রায়োগিক উপযোগিতার ভিত্তিতে তিনি সবকিছু বিচার করতেন। ধর্ম সম্পর্কে তিনি ছিলেন অজ্ঞেয়বাদী। অজ্ঞেয়বাদ অনুসারে বস্তু জগতের বাইরে ঈশ্বর সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ সম্ভব নয়। কিন্তু তিনি ধর্মকে অস্বীকার করেন নি। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম সম্পর্কে তিনি ছিলেন নির্লিপ্ত। ইউরোপীয় রেনেসাঁস হয়েছিলো ধর্মকে অস্বীকার করে নয় পাশকাটিয়ে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ইউরোপীয় রেনেসাঁসের মূলমন্ত্রকে আত্মস্থ করে বঙ্গীয় রসায়নে উপস্থাপন করেছেন। রেনেসাঁসের মূলমন্ত্র মানবতাবাদ ছিলো তাঁর আদর্শ। তিনি মানবধর্ম প্রচার করেছেন। মানুষ ছিলো তাঁর চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে। দর্শন বিষয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কোনো গ্রন্থ রচনা করেননি। দর্শনের আলোচ্য বিষয় জ্ঞানতত্ত্ব, অধিবিদ্যা, মূল্যবিদ্যা নিয়ে তাঁর কোনো গ্রন্থ নেই। তাঁর রচনাবলীর মধ্যে দর্শনের মৌলিক বিষয়গুলোর প্রতিফলন রয়েছে। সর্বদর্শন সংগ্রহ তিনি সম্পাদনা করেছেন অত্যন্ত যতœসহকারে। তাঁর উদ্যোগে সর্বদর্শন সংগ্রহ বাংলায় অনুদিত হয়েছিলো। কথিত আছে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে সর্বদর্শন সংগ্রহ প্রকাশিত না হলে পাঠকদের হাতে বইটি পৌঁছতে সমস্যা হতো। বাঙালির অন্যতম দার্শনিক ভদ্রবাহু (৪৩৩-২৯৮ খ্রিষ্টপূর্ব) রচিত কল্পসূত্র বর্তমান সময়ের পাঠকের কাছে প্রায় বিস্মৃত। জৈন দার্শনিক ভদ্রবাহু চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের উপদেষ্টা ছিলেন। বাঙিালির আদি দার্শনিক হিসেবে ভদ্রবাহুর নাম সর্বাধিক সমাদৃত। সমাজ সস্কারক এবং যুক্তিবাদী হিসেবে বিদ্যাসাগর অধিক পরিচিত। কিন্তু বরীন্দ্রনাথ বছেলেন বিদ্যাসাগরের প্রধান কীর্তি হলো বঙ্গভাষা। ভাষা দর্শন বর্তমান সময়ে দর্শনের অন্যতম আলোচনার বিষয়। ভাষা দর্শন এতোটাই গুরুপূর্ণ যে দার্শনিক ভিটগেনস্টাইন বলেছেন, দর্শনচর্চা শেষ অবধি ভাষা চর্চা ছাড়া আর কিছুই নয়। ভাষা দার্শনিকেরা মনে করেন, ভাষার একমাত্র কাজ হলো ভাবের আদান প্রদান করা। আধুনিক চিন্তাবিদেরা ভাষাকে মধ্যস্ততাকারী হিসেবে দেখিয়েছেন। অর্থাৎ ভাষা আর কিছুই নয়, যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। সভ্যতা গড়ে উঠার অন্যতম উপদান হলো ভাষা। বিদ্যাসাগরের রচনাবলীর মধ্যে ভাষাচিন্তা খবই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর ভাষ চিন্তার মানস কাঠামো তাঁর অনন্য সৃষ্টি গদ্যরীতির উপর নির্ভরশীল। সন্দীপ পাল বিদ্যাসাগরের দর্শনচিন্তা গ্রন্থে দেখিয়েছেন, বিদ্যাসাগরের গদ্যরীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলো (১) শব্দ ব্যবহার, (২) শব্দক্রম, (৩) বাক্যগঠন, (৪) সংলাপ, (৫) প্রত্যক্ষ উক্তির ব্যবহার, (৬) বিরাম চিহ্ন এবং (৭) ছন্দের ব্যবহার প্রভৃতি। বিদ্যাসাগরের গদ্যরীতির সঙ্গে যুক্ত বিষয়গুলোকে বিশ্লেষণ করলে তাঁর ভাষা দর্শনের পূর্ণাঙ্গ রূপ পাওয়া যাবে। বিদ্যাসাগর সাংখ্য এবং বেদান্ত দর্শন পড়ানোর পক্ষে ছিলেন না। তিনি মনে করতেন সাংখ্য এবং বেদান্ত দর্শনের সাহায্যে সত্যকে জানা যায় না। দর্শনের উদ্দেশ্য সত্যকে জানা। সাংখ্য এবং বেদান্ত দর্শনের সাহায্যে সত্যকে জানা যায় না বলে তিনি এই দুই দর্শনকে ভ্রান্ত দর্শন মনে করতেন। তিনি ভাববাদী এবং অধ্যাত্মবাদী দর্শনের বিপক্ষে ছিলেন। বেদান্ত দর্শনের মত তিনি বার্কলির দর্শন বর্জনের কথা বলেছেন। ভাববাদ ব্যক্তি মানুষকে কুসংস্কারগ্রস্ত মানুষে পরিণত করে। সমাজকে পেছনের দিকে নিয়ে নিয়ে যায়। প্রগতির অন্তরায় হিসেবে ভাববাদী চিন্তার সূচনা হয়েছিলো। গ্রীক নগর রাষ্ট্রে নারীর ভোটাধিকার ছিলো না। প্রাচীন ভারতে নারীকে অধস্তন হিসেবে দেখা হয়েছে। গ্রিক দার্শনিক ও গণিতবিদ পিথাগোরাস মনে করতেন সৃষ্টির ক্ষেত্রে নারীর কোনো ভূমিকা নেই। নারীর জরুয়ুকে তিনি উন্নতমানের কিউবেটরের সাথে তুলনা করেছেন। নারী শুধু সন্তানের পুষ্টিদান করে। রুশো নারী পুরুষের জন্য ভিন্ন ধরনের শিক্ষার কথা বলেছেন। রুশোর মতবাদের প্রতিবাদ করে মেরী অ্যাসটেল (১৬৬৬-১৭৩১) বলেছেন, শিক্ষার সমান অধিকার নারীকে পুরুষের সমান ক্ষমতায়ন করতে সক্ষম। নারীবাদের প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে লিঙ্গবৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। বিধবাবিবাহ প্রবর্তন করে বিদ্যাসাগর নারীর যন্ত্রণাকে প্রশমিত করতে চেয়েছেন। কিন্তু এর মধ্যেই তিনি সীমাবদ্ধ ছিলেন না। নারী পুরুষকে একই শিক্ষা নীতির আলোকে শিক্ষিত করে তিনি সমান ক্ষমতায়নের পক্ষে ছিলেন। সন্দীপ পালের বিদ্যাসাগরের দর্শনচিন্তা গ্রন্থটি বিদ্যাসাগরের ধর্মচিন্তা, বিদ্যাসাগর ও বস্তুবাদী দর্শন, বিদ্যাসাগর ও সাধারণবোধ দর্শন, বিদ্যাসাগর ও ভাষাদর্শন, বিদ্যাসাগর ও নারীবাদী দর্শন, বিদ্যাসাগর ও নৈতিক দর্শন, বিদ্যাসাগর মানবতাবাদী দর্শন এবং চিরকালের পথিক, চিরকালের পথপদর্শক নামে আটটি অধ্যায়ে বিভক্ত। বিদ্যাসাগরের দর্শনকে সুন্দরভাবে এবং সহজভাবে উপস্থাপন করেছেন সন্দীপ পাল। তিনি দর্শনের শিক্ষক। দর্শনের পরিভাষা ব্যবহার করে বিদ্যাসাগরের দর্শনকে সাধারণ মানুষের কাছে উপস্থাপন করেছেন। ২০১৯ সালে গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ।
×