ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আগাছা

প্রকাশিত: ০৯:৫২, ২৪ জানুয়ারি ২০২০

 আগাছা

ভোরের আলো ফোটার আগেই ধান ক্ষেতের আগাছাগুলো পরিষ্কার করতে হবে। আগাছা বড় হওয়াতে জমির উর্বরতা কমে আসে। এই কয়দিন প্রচ- বৃষ্টিপাত হয়েছে। চারাগাছগুলো পানির নিচে গলা অবধি ডুবে গেছে। গতকাল রাতে বৃষ্টি হয়নি। শেষ রাতে পানি কমতে শুরু করেছে। আড়মোড়া ঘুম থেকে জেগে ওঠে ইদ্রিস মোতালেব। ভোরটা বেশ ফর্সা এবং রোদটা তেড়ে আসতে চায়। যৌবনপ্রাপ্ত ষাঁড়ের মতো। তাই তাড়াতাড়ি জমিতে আসা। এমনিতে আগাছাগুলো বেড়েছে। ছোট ছেলেটা এলো না। এতগুলো ধানি জমি একা আগাছা পরিষ্কার করতে কষ্ট হবে! তুহিন এলে হাতে হাতে কাজ এগিয়ে দেয়। ফসল ফলানো এত সহজ নয়। অনেক পরিশ্রম করতে হয়। নবজাতক শিশুর মতো, যতেœ ফলে ভাল ফসল। পাশের জমিতে জমির চাচা ও একই কাজে ব্যস্ত। তবু মাঝে মাঝে হাঁক দেন। জমির খোঁজ খবর নেন। বাড়ির ভাল মন্দ তালাশ করেন। ভাল সম্পর্ক আছে। জমির চাচার সংসারে কোন সন্তান নেই! বয়স প্রায় সত্তর ছুঁই ছুঁই। পাঁচ একর ধানি জমি। জমির চাচা ও চাচি তাতেই চালিয়ে নেয় বছর ফেরত বছর। ইদানীং চেয়ারম্যানকে দেখি জমির আইলে হাঁটাহাঁটি করতে। সঙ্গে দু’জন সোমত্ত লোক। কিসব কাগজ পত্রের ঘাঁটাঘাঁটি। জমির চাচার কারও ভালতে যায় না। মন্দতে কোন কথাই নেই। তবু ইয়াসিন চেয়ারম্যানের কুদৃষ্টি। জমির চাচার ধানি ক্ষেতের ওপর। ইট ভাটার কারখানা করবে। টাকার লোভ দেখায়। চাচা তো কিছুতেই জমি দিতে নারাজ। জমি দিয়ে দিলে খাবে কি? না খেয়ে মরতে হবে বুড়াবুড়িকে! এমনিতে চেয়ারম্যান দেশ, মাটি ও মানুষের ভাল দেখতে পারে না। হাতে হাত মিলিয়ে ছিল পাকিদের সঙ্গে। জোরপূর্বক পাঁচ একর জমি দখল করে। তাতে ক্রান্ত হয়নি। প্রকাশ্য হুমকি! জমির চাচার নিত্যসঙ্গী। নিতান্ত বাধ্য হয়ে জমি বিক্রি করে। চেয়ারম্যান তো খুশিতে গদগদ হয়ে তৈরি করে নীল নকশা। পাঁচ একর ধানি জমির উপর ইট পোড়া ধোঁয়া গলগল হয়ে বের হতে থাকে। জমির চাচা এখন অন্যের বাড়িতে কাজের লোক হয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। অন্যের দয়ায় এঁটো কাটা খেয়ে বাঁচতে হয়। সহায় সম্বল হারিয়ে চাচি নামাজ পড়তে পড়তে কান্না করে! যখনি মন খারাপ হয় তখনই একমাত্র ক্ষেতের আইলে বসে কাঁদতে থাকে। চোখের জল আঁচল ভিজে মাটিতে পড়ে। নিদারুণ কষ্টের দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যায় নিঃশব্দে! ইট ভাটার কারখানা তর তরিয়ে গড়ে উঠে। আশপাশে অনেক জমিতে ফসলের উৎপাদন ক্ষমতা কমে যায়। গ্রামবাসীর উৎকণ্ঠার শেষ নেই! কিন্তু কেউ চেয়ারম্যানের মুখের ওপর দুকথা বলার সাহস নেই। জমির চাচা অন্যের ক্ষেতের ফসল গোলায় তুলে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে। এই দীর্ঘশ্বাস যেন অপরাধীর অশনিসংকেতের এক একটা পোড়া ইট। বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছে শরীরটা। থেমে নেই জীবন নামের বিশাল চাকা! দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মোতালেব! দেশ স্বাধীনতা পেয়েছে প্রায় চল্লিশ বছর। কিন্তু শাসন শোষণ বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। এক শ্রেণীর মানুষ দেশটাকে নিয়ে যাচ্ছে বিনষ্টের পথে। এরাই তো পৃথিবীর ভূমিষ্ঠ আগাছা! ঘন সবুজ ধান গাছের পাশে জন্মেছে পোক্ত আগাছা। সমূলে উৎখাত করতে হবে। উত্তপ্ত রোদের সূর্যটা যেন মাথার উপর থেকে একচুল নড়ে না। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। তুহিন সকালের খাবারটা নিয়ে আসার কথা। হয়তো স্কুল থেকে ফেরেনি। বড্ড লক্ষ্মী ছেলে। সামর্থ্যর বাইরে কোন কিছু আবদার করে না। লেখাপড়ায় ভীষণ ভাল। খেলাধুলায় সমান পারদর্শী। ভেজা শার্ট রোদের তাপে শুকিয়ে আবারও ঘামে জবজবে। যেন নদী থেকে ডুব দিয়ে উঠেছে। অগত্যা জমি থেকে উঠে গাছের ছায়ায় বসতে হলো। অনেক আগেই জমির চাচা বসে আছে। কথা শুরুতে জমির চাচার শরীর অনেকটা অচল পয়সার মতো। কিন্তু নিরুপায় পেটের ভেতর যে ছুঁ ছুঁ দৌড়ানো থামাতেই। এই পর্যন্ত কাজ করতে হয়। হাত থেকে নিড়ানি রেখে গাছের ছায়ায় বসেছে। কাঁধের গামছা দিয়ে মুখ মুছে। একটু শীতল হাওয়া এসে শরীরটাকে কিছুটা ঠা-া স্পর্শ দিল। ধান গাছের চারাগুলো এক সঙ্গে দুলতে থাকে। মনটা আনমনে হারিয়ে যায়। ফেলে আসা দিনের কত কথার মাঝে সুপ্ত। কখন যে তুহিন এসে ডাকতে ডাকতে অস্থির টের পায়নি। তুহিন হাঁপাচ্ছে বোধদয় ছুটতে ছুটতে এলো। হাতে ভাতের বাটি গামছা মোড়ানো। অন্য হাতে সিলভারের পানির জগ। এক মুহূর্তের জন্য ক্ষুধা তৃষ্ণা উভয়ে মগডালে বসে আছে। বিহ্বলে তাকিয়ে আছে ছেলের দিকে। তুহিন জিজ্ঞাসা করে কি দেখছো বাবা? উত্তরে মোতালেব বললেন- ভাবছি দেশের মধ্যে কতগুলো আগাছা রয়ে গেছে। শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে দেশের ক্ষতি করতে চাইছে। বাবা আগাছার সঙ্গে দেশের সম্পর্ক কি? আমিতো এর আগাগোড়া কিছুই জানি না। আচ্ছা বাবা আগে ভাত খেয়ে নেন। খেতে খেতে না হয় বুঝিয়ে বলবেন। মোতালেন বললেন মন দিয়ে শুনলে বুঝতে পারবি। তুহিন পানির জগ এগিয়ে দেয়। কয়েক ছিটকে পানির জাপটা দিয়ে মুখ ধুয়ে নেয়। কাঁধের গামছা দিয়ে হাত ও মুখ মুছে তৃপ্তি সহকারে ভাত খেতে লাগলেন। শোন তুহিন, এই যে আমাদের সবুজ ধানি জমি। জমিকে মনে কর একটা সবুজ শ্যামল দেশ। এই সুন্দর দেশটা আমরা নয় মাস যুদ্ধ করে রক্ষা করেছি। অন্য দেশ থেকে কিছু শোষক এসে আমাদের দেশকে শাসন করবে। তা আমরা মেনে নেব কেন? নিজের দেশে আমরা সবাই স্বাধীনভাবে থাকব। স্বাধীনভাবে মাতৃভাষায় কথা বলব। তা ওদের গায়ে সহ্য হলো না। শুরু হলো ভাষা নিয়ে মতবিরোধ। তারপর দেশ পরিচালনা নিয়ে বিরোধ। আমরা ওদের কথামত চলব কেন? তার দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলো। এদেশের অনেক নিরীহ বাঙালীকে ওরা রাতের অন্ধকারে গুলি করে হত্যা করে। তারপর বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে! দফায় দফায় আন্দোলন করে বাঙালীরা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ছিল বাঙালী জাতির কাছে তাৎপর্যপূর্ণ। তখনই বাঙালী জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে পাকিদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ঘোষণা করে। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধে এদেশের জ্ঞানী গুণী বুদ্ধিজীবী মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে। এমনকি জেলবন্দীতে হত্যা এবং লাশ গুম করে। দীর্ঘ নয় মাস শেষে বাঙালী পেল অমর স্বাধীনতা। তুহিন আমার মনে হয়, বিশ্বের আর কোন জাতি দেশের স্বাধীনতার জন্য এভাবে যুদ্ধ করেনি। তুমি এখনও বয়সের তুলনায় অনেক ছোট। তাই তুমি সব কিছু বুঝতে পারছ না। আর যখন তুমি আস্তে আস্তে লেখাপড়া শিখে আরও বড় হবে। তখন তুমি নিজের মতো করে সব বুঝতে পারবে। মোতালেব ভাত খাওয়া শেষ করে গামছা দিয়ে হাত ও মুখ মুছে নিলেন। আচ্ছা বুঝলাম বাবা। দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য দেশের মানুষকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। এই যে তুমি বলছ আগাছা, সেটা আবার কি? দেশের আগাছা মানে কি? এতক্ষণে সঠিক প্রশ্ন করেছ। এই যে আমাদের জমিতে বছরে তিনবার ধান চাষ করি। কি জন্য? যাতে আমাদের ঘরে ভাতের অভাব যেন না থাকে। পাশাপাশি দেশের আরও মানুষ উদ্বুদ্ধ হয়ে চাষাবাদে মন দেবে। অনাহারে আর থাকতে হবে না। তেমনি ধান গাছের সঙ্গে আরও কিছু সবুজ উদ্ভিদ জন্মায়। সেগুলো ধান গাছকে বাড়তে বাধা দেয়। জমিতে যে জৈব সার দেয়া হয়। তা বেশি শোষণ করে। আগাছারা বলবান হয়। আর ধান গাছ বাধা পেয়ে, ফলন কমিয়ে দেয়। এদেশে আগাছা নামক এক শ্রেণীর কিছু মানুষ আছে। যারা অত্যন্ত সুবিধা ভোগী ও লোভী। স্বার্থের জন্য ওরা সব কিছু করতে পারে। যেমন যুদ্ধ চলাকালীন পাকিরা তো আমাদের দেশ সম্পর্কে কোথায় কি আছে তেমন কিছু জান তো না। কিছু লোভী মানুষ নামের নরপশু পাকিদের প্রশ্রয় দেয়। টাকা ও ক্ষমতা পাবার আশায় স্থানীয় মুক্তি বাহিনীর নেতা-কর্মীদের স্থান সম্পর্কে তথ্য প্রদান করে। কারও বাড়িতে সোমত্ত নারী থাকলে জানিয়ে আসে। রাতের অন্ধকারে পাকিদের নেশাখোর চোখ নারী কামনায় জ্বলজ্বল করে ওঠে। এদেশের বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। কিছু মানুষ যুদ্ধের ভয়াবহ অবস্থা দেখে পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নেয়। তাদের ঘরবাড়ি লুট করে। পুড়িয়ে জায়গাজমি জোর করে দখলে আনে। এরাই হচ্ছে দেশের রাজাকার! সোনার দেশের আগাছা! এই রাজাকার বাহিনীর আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এখনও দিব্যি বেঁচে আছে। ওরা কখনও দেশের জন্য মঙ্গল কামনা করে না। সর্বদা দেশের ক্ষতি করার কাজে জড়িত থাকে। আগাছারা জমির জন্য কখনও মঙ্গল না! তুহিন সব মনোযোগ সহকারে শুনে। আচ্ছা বাবা ধান গাছ বাদ দিয়ে যে উদ্ভিদ জন্মায় তা আমরা অপসারণ করি। কিন্তু এই বর্বর মানুষকে কেন অপসারণ করা হয়নি? মোতালেব বুক থেকে কষ্টের দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিঃশব্দে বেরিয়ে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে ওঠে! নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে দূর দিগন্তে। গরম জলের ধারা দুচোখের কোণে। তুহিন জিজ্ঞেস করে- বাবা তুমি কাঁদছো কেন? কোন প্রতিউত্তর করলেন না। আবার বলতে শুরু করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সব রাজাকারকে মহত্ত্ব দেখিয়ে ক্ষমা করে দিলেন। অনেক ত্যাগের পর স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীন বাংলাদেশ নামে একটি নতুন দেশের অভ্যুদয় ঘটে। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের শাসন ভার গ্রহণ করেন। শাসন ক্ষমতা হাতে নেওয়ার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠনের কাজে মনোনিবেশ করেন। বঙ্গবন্ধু সাড়ে তিন বছর বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু হিংস্র মানুষ নামের নরপশু ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে নৃশংসভাবে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে! এমনকি আট বছরের শিশুপুত্র পর্যন্ত রেহাই পায়নি! সেই দিন বাংলাদেশের আকাশ বাতাস শস্যের মাঠ সবই কেঁদে ছিল। এবং কলঙ্কিত হয়ে ছিল। বঙ্গবন্ধু যদি যুদ্ধের সময় দেশ দ্রোহীদের উৎখাত করত। তাহলে এভাবে জীবন দিতে হতো না। নিরলসভাবে মানুষের পাশে সুখে দুঃখে বন্ধু হতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সব ভালবাসা দেশের মাটি ও মানুষের জন্য। মোতালেব ছোট্ট তুহিনকে এই সব কথা বলতে বলতে কখন যে, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো টের পায়নি। সম্বিত ফিরে বলল এই সব কথা হয় তো তুমি এখন বুঝবে না। জীবনে চলার পথে তুমি বুঝতে পারবে। পৃথিবীর সব মানুষকে এত বিশ্বাস করতে নেই। মানুষ নামের আগাছারা এখনও সমাজে বংশ বিস্তার করেছে। তবে আমাদের ধানি জমিতে কিছুতেই আগাছা বড় হতে দেব না। তুহিন বলল বাবা আমি একটু ফুটবল খেলতে যাব? বাবার সম্মতিতে ভোঁ দৌড়। মোতালেব নরম আলোয় বাড়ির উদ্দেশ্য ধীর পায়ে এগোয়। আর বিড়বিড় করে বলে আগাছারা সুযোগ পেলেই মাথা ডিঙিয়ে ক্ষতি করবেই। তাই আগাছাদের সঠিক সময়ে সমূলে উপড়ে ফেলতে হয়।
×