ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শেলী সেনগুপ্তা

সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরা লোকটা-

প্রকাশিত: ০৯:৫৩, ২৪ জানুয়ারি ২০২০

 সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরা লোকটা-

একটা শব্দ, তারপর অনেকগুলো শব্দ, একটানা শব্দে চারপাশ কাঁপিয়ে দিচ্ছে। আশপাশের গাছের ঘুমন্ত পাখিগুলো জেগে গেছে। নিজেদের ভাষায় চেঁচামেচি করছে আর উদ্দেশ্যবিহীন ছোটাছুটি করছে। দবির পাগলার ঘুম ভেঙ্গে গেছে, ভয় ভয় করছে। সে একেবারে দেয়ালের সঙ্গে মিশে শুয়ে আছে। মাটির সঙ্গে বুক লাগিয়ে নিজেকে বিপন্মুক্ত রাখার চেষ্টা করছে। সেও কি বুঝে গেছে মা আর মাটি সন্তানের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়। দবির পাগলা এই দেয়ালের পাশে আছে অনেকদিন থেকে। যে যায় দেয় খায়, না দিলে চুপ করে বসে থাকে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে। কিছুদিন আগে বেশ কিছু লোক ওকে এখান থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল, কিসব বলছে সব কথা বোঝেনি সে, একটা কথা বার বার বলছিল ওরা, শব্দটা ছিল ‘নিরাপত্তা’। দবির পাগলা কিছুই বোঝেনি, শুধু বুঝেছে কঠিন কিছু বিষয় হবে ওটা। লোকগুলো দবির পাগলাকে প্রায় চ্যাংদোলা করে এখান থেকে সরিয়ে দিচ্ছিল। ঠিক তখন একটা লোক আসলো, সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা, হাতে ছিপ ছিল, লেক থেকে মাছ ধরছিল, সে লোকটা বলল, : ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? : স্যার, এখানে থাকা নিরাপদ না। তাই সরিয়ে দিচ্ছি। লোকটা হো হো করে হেসে উঠল, বলল, : আমার দেশের মানুষ আমার জন্য নিরাপদ নয়! কি বলছ তোমরা! ও এখানেই থাকবে, ওকে ওর মতো থাকতে দাও। লোকগুলো চলে গেল, সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা লোকটা ওর দিকে তাকিয়ে হাসল। দবির পাগলা কি সেদিন কিছু সময়ের জন্য দেবদূত দেখেছিল? দবির পাগলা সে বাড়িটার দেয়ালের পাশেই থাকে। মাঝে মাঝে সে লোকটা আসা-যাওয়ার পথে ওর হাতে খাবার দেয়, ওর দিকে তাকিয়ে অভয়ের হাসি হাসে। ওর খুব ভাল লাগে। লোকটা লেকে ছিপ ফেলে মাছ ধরে, কখনও কারও সঙ্গে গল্প করে। তখন দবির পাগলা পায়ে পায়ে এগিয়ে যায়, কিছুদূর গিয়ে চুপ করে বসে থাকে। লোকটার কথা শোনার চেষ্টা করে। কিছুই বোঝে না , কিন্তু মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। লোকটা মাঝে মাঝে আকাশ কাঁপিয়ে হো হো করে হেসে ওঠে, দবির পাগলার তখন ছোটবেলার বৃষ্টির কথা মনে পড়ে যায়। গ্রামে অনেক আনন্দ নিয়ে বর্ষার প্রথম বৃষ্টিতে ভিজত। লোকটা হাসলেই সেই বৃষ্টি ঝরত যেন দবির পাগলার মাথার ওপর। চারদিকে একটা শান্তি শান্তি ভাব, দু’চোখ বুজে আসে পরম শান্তিতে। বাতাসে তখন নতুন ধানের গন্ধ, গরম ভাতের গন্ধ, পাটশাক আর কুচো চিংড়ি দিয়ে এক থালা গরম ভাত। ওর চোখে মুখে তৃপ্তির আলো ফুটে ওঠে। সে লোকটা এই বাড়িতে বাস করে, বাড়িটা ঘিরে একটা শীতল বাতাস বয়ে যায়। কত পায়রা উড়ে বেড়ায়, কত লোক আসে। সবার জন্য অবারিত দ্বার। ওরও ইচ্ছে করে সে বাড়িতে ঢুকতে। একদিন ঠিক লোকটার পেছন পেছন ও বাড়িতে চলে যাবে। জানে লোকটার পেছনে থাকলে কেউ ওকে একটুও টলাতে পারবে না। কখনও কখনও লোকটাকে দেখলে ওর পাহাড়ের কথা মনে হয়। কিন্তু সেখানে আজ এত শব্দ কেন? ঘুম ভেঙ্গে পায়রাগুলো ছটফট করছে। কিছু লোক কঠিন স্বরে কি সব বলছে। দবির পাগলার কিছুই ভাল লাগছে না। খুব ইচ্ছে করছে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা লোকটাকে দেখতে। লোকটা একবার কাছে এলে দবির পাগলার সব ভয় কেটে যেত। এত অস্থির লাগছে কেন? মাটির মধ্যে মুখ গুঁজে পড়ে আছে সে। এক সময় শব্দ থেমে গেল। দবির পাগলার দু’চোখে ঘুম আর কান্নার মাখামাখি। নিজেকে গুটিয়ে কেঁচোর মতো করে নিলো। দেয়ালের সঙ্গে মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। আরও, আরও, আরও। কতক্ষণ ছিল জানে না। হঠাৎ মনে হলো কেউ ওর মাথায় হাত রেখেছে। পরম মমতায়, আলতো করে ছুঁয়ে দিচ্ছে ওর এলোমেলো চুলগুলো। আহ , শান্তি, ঘুমাতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু হাতটা আর হাতের মানুষটা ওকে ডাকছে, জাগিয়ে তুলছে। : দবির, বাবা দবির, ওঠ, এখন আর ঘুম না, অনেক কাজ আছে, ওঠ বাবা। দবির পাগলা নিজেকে কেঁচোর মতো গুটিয়ে পা মাথা একসঙ্গে করে ফেলল। তারপর উঠে বসল। দেখে ওর সামনে সেই লোকটা বসে আছে, সাদা পাজামাপাঞ্জাবী পরা, শুধু চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমাটা নেই। দবির তাকিয়ে আছে মন্ত্রমুগ্ধের মতো। কী গভীর দুটি কালো চোখ, কত মমতা মাখানো দৃষ্টি, ঈষৎ ক্লান্ত। লোকটা আবার ডাকছে ওকে, : বাবা, ছুটে যা, আমার সোনার বাংলার ঘরে ঘরে গিয়ে বল, আমি মরিনি, আমি আছি, ছড়িয়ে আছি গ্রামেপ্রান্তরে, বাংলার মানুষের হাসি, কান্না আর গানে। আমি আছি নদীর ঢেউয়ে রাখালের বাঁশিতে। আমি আছি বিপ্লবে, শান্তিতে। যতদিন বাংলার আকাশে সূর্য উঠবে দোয়েল গাইবে আমি আছি। সবাইকে বল, আমি আছি যার যার কর্মে। যা, সবাইকে বল, শোকে নয় শক্তিতে আছি আমি। সেই থেকে দবির পাগলা ছুটছে, শুধু ছুটছে। বসে থাকার সময় নেই। এখন সে ডাকহরকরার মতো ছুটছে, তার মুখে শুধু একটায় শব্দ, ‘আছে, বাবা আছে, বাবা আছে, বাবা বলেছে , কাজ করতে’ বাবা আছে, বাবা আছে।’
×