ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

বাংলাদেশে নারীর আইনী সুরক্ষায় বিশ্ব প্রতিবেদন

প্রকাশিত: ০৯:৫৫, ২৪ জানুয়ারি ২০২০

বাংলাদেশে নারীর আইনী সুরক্ষায় বিশ্ব প্রতিবেদন

সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে বাংলাদেশ বিশ্বসভায় অন্যতম আসন আর দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে অবস্থান করলেও শুধুমাত্র নারীর আইনী অধিকার এবং ক্ষমতায়নে অনেকখানিই পিছিয়ে। এমন তথ্য উঠে আসে বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যে বলা হয় নারীদের এগিয়ে যাওয়ার বিভিন্ন সূচকে সংশ্লিষ্ট এই গোষ্ঠী দেশে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন দৃষ্টিকটুভাবে। জরিপ করা ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশে নারীদের অবস্থান ১৭১তম। শুধু তাই নয় দক্ষিণ এশিয়ায়ও বাংলাদেশের নারীরা অনেক পেছনে। ‘নারী, ব্যবসা ও আইন, শীর্ষক এই জরিপটি সপ্তম বারের মতো প্রকাশ করা হয় বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে। নারীর প্রতিদিনের জীবনযাত্রার গুরুত্বপূর্ণ সূচককে নির্ণায়ক ধরে ১০০ স্কোরের ভিত্তিতে প্রস্তুত করা এই গবেষণাটি সারা বিশ্বের নারী সমাজের সার্বিক অধিকার ক্ষমতা আর উন্নয়নের চিত্রকে তুলে ধরে। সপ্তম বারের মতো তৈরি করা এই তথ্য গত বছরের তুলনায় ২ ধাপ পেছনে। আটটি অতি আবশ্যিক নির্দেশক নিয়ে বিশ্বব্যাংক যে উপাত্ত তুলে ধরে সেখানে ভারতের অবস্থানই নজরকাড়া। ৭৪.৪ স্কোর নিয়ে ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় একেবারে শীর্ষে। সেখানে ৪৯.৪ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশ-পাকিস্তান একই জায়গায় একেবারে শেষের দিকে। মালদ্বীপ, নেপাল, ভুটান এবং শ্রীলঙ্কা অনেক বেশি স্কোর নিয়ে বাংলাদেশের বেশ ওপরেই। বিশ্বে ১৯০টি দেশর মধ্যে ভারত ১১৭তম অবস্থানে। ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের তথ্য-উপাত্ত নিয়েই এই বিশ্ব জরিপটি সম্পন্ন করে বিশ্বব্যাংক। নারীর স্বাধীনভাবে চলার অবস্থা, পেশা শুরু করা থেকে কর্মক্ষেত্রে প্রাপ্তি, বিয়ের পরবর্তীতে মা হওয়া, ব্যবসা ও সম্পদ ব্যবস্থাপনায় অধিকার সব মিলিয়ে নারীরা আসলে নিজ দেশে কতখানি সুরক্ষিত থাকেন সেটা যাচাই করতে বিশ্বব্যাংকের এই নমুনা। দৃশ্যত লিঙ্গ সমতায় বাংলাদেশ এগিয়ে গেলেও সার্বিক সামাজিক বলয়ে নারীরা কতখানি স্বাধীন অধিকারসম্পন্ন, নিরাপদ এবং মালিকা স্বত্বপ্রাপ্ত বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে। চলাফেরার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা পায় নাকি বাংলাদেশের নারীরা শতভাগ বিশ্বব্যাংক যা বলে। কিন্তু প্রতিদিনের চিত্রে যা দৃশ্যমান তা বুঝতে কষ্ট হয় না নারীর নিরাপত্তা কোন মাত্রায় সুরক্ষিত কিংবা অরক্ষিতও? গণপরিবহন, সড়ক-মহাসড়ক কিংবা আরও অনেক জায়গায় যেভাবে নারী সহিংসতার দুর্ঘটনা জনসমক্ষে চলে আসে তা সত্যিই আধুনিক সমতাভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় এক অনাকাক্সিক্ষত অশনি সঙ্কেত। সেখানে আইনী বিধিবিধানও যে নারীর পক্ষে কতখানি জোরদার তাও প্রশ্নবিদ্ধ। প্রথমত অপরাধীদের যথেষ্ট আন্তরিকতায়ই শুধু নয় স্বল্প সময়ের আটকও করা হয়। কিন্তু শেষ অবধি বিচারের সর্বশেষ কাঠগড়ায় দাঁড়াতে কত যে সময় ক্ষেপণ করতে হয় সেটাও ধারণার মধ্যেই থাকে না। যেমন ঠিক একইভাবে শাস্তি কার্যরত হতে কোন লক্ষণই দেখা দিতে যে মাত্রায় দীর্ঘসূত্রতার আবর্তে পড়ে আপীলের নামে সেটাও অভিযুক্তদের যথার্থ দ- দিতে ব্যর্থতার নামান্তর মাত্র। কর্মক্ষেত্রে নারীর অবস্থান, শিক্ষা, উচ্চ শিক্ষা এবং উচ্চতর গবেষণায় অর্ধাশ এই গোষ্ঠীর জোরালো অভিগামিতায় বিভিন্ন রকমের পেশার দ্বারও খুলে যাচ্ছে তাদের জন্য। যোগ্যতম বিবেচনায় অনেক নারী শীর্ষে পদে চলে আসতে সময়ও নিচ্ছেন না, যা সত্যিকার অর্থে এখনও হাতেগোনার মতো। সরকারী-বেসকারী প্রতিষ্ঠানে নারীর অংশ বাড়লেও তা এখনও সীমিত অবস্থায়। শীর্ষ স্থানে ক্ষমতায়ন নারীর সংখ্যা আরও কম। জনসংখ্যা অনুযায়ী এর অধিকতর সম্প্রসারণ ছাড়া বিশ্ব প্রতিবেদনে বাংলাদেশের নারীদের উন্নত মান প্রতিভাত হওয়া আসলেই কঠিন। বাল্যবিয়েকে সেভাবে ঠেকানো এখনও একটি চলমান প্রক্রিয়া। যা অবোধ বালিকাদের সারা জীবন বিপন্ন করতে যথেষ্ট। তা ছাড়া বাল্যবিয়ে মানেই অকাল মাতৃত্ব। হয়ে গেল কোন মেয়ের স্বপ্নের আকাক্সিক্ষত জায়গায় রুদ্ধতার পর্বত প্রমাণ বাধা। বাল্যবিয়েকে সামাজিক অভিশাপের আবর্ত থেকে বের করে আনতে ব্যর্থ হলে সঙ্কট প্রতিনিয়ত বাড়বে বৈ কমবে না। সনাতন, রক্ষণশীল, পশ্চাৎপদ সমাজ ব্যবস্থার গভীরে লালন করা সমস্ত অপসংস্কারকে মূল থেকে উৎখাত করতে যা যা করণীয় সবটাই করতে হবে নারী-পুরুষের মিলিত শক্তিতে। শ্রম মজুরিতে নারীর প্রতি বৈষম্য সত্যিই নিন্দনীয় ব্যাপার। সরকারী-বেসকারী প্রতিষ্ঠানে এমন বৈসাদৃশ্য দৃশ্যমান না হলেও ভূমিনির্ভর সমাজ ব্যবস্থায় কৃষিতে এমন চিত্র সংশ্লিষ্টদের বিক্ষুব্ধ করলেও নিজের অধিকার ও প্রাপ্তিটাও তাদের অজ্ঞাত। শুধু কি তাই অবকাঠামো তৈরিতে নারী নির্মাণ শ্রমিকও তার পুরুষ সহকর্মীর তুলনায় মুজরি পান কম। আর যে পোশাক শিল্প নারী-শ্রমের ওপর সারা বিশ্বে তাদের উৎপাদিত পণ্য সরবরাহ করে রফতানি থেকে বাণিজ্য সম্প্রসারণের যে সুযোগ তৈরি করে সেখানেও সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী হরেক রকম অত্যাচার, নির্যাতন এবং বৈষম্যের আবর্তে পড়ে যা প্রতিদিনের গণমাধ্যমের খবর। আর নারীর পারিবারিক সম্পত্তিতে অধিকার ও মালিকানা, ধর্ম, সমাজ আর আইনের বিধি মোতাবেক নারীরা সে জায়গায় বঞ্চিত এবং প্রাপ্ত দাবি হারানোর অবস্থায়। তেমন সঙ্কট চরমে পৌঁছায় অসহায়, পিছিয়ে পড়া হতদরিদ্র নারীদের ব্যাপারে। এই অসম কঠিন সামাজিক সংস্কারকে অতিক্রম করা দুঃসাধ্যই বলা যাবে নাÑ তবে অনেক লড়াই, সংগ্রাম করে নিজের পাওনাকে আদায় করা ছাড়া বিকল্প কোন পথও নেই। গ্রামনির্ভর সমাজ ব্যবস্থায় পশ্চাৎপদ নারীরা জানেনও না পিতা এবং স্বামীর সম্পত্তিতে তার অধিকারও প্রাপ্তি কতখানি। অনেক সময় জন্মদাতা পিতাও বালিকা মেয়েকে বিয়ে দিয়ে যাবতীয় সম্পত্তি ছেলেদের নামে উইল করে যান। এখানে আইনের কিছু সংস্কারও হয়েছে। বাবা ছেলেকে লিখে দিয়ে গেলেও মেয়ে যদি বর্তমানে থাকে তার প্রাপ্ত কিন্তু তাকে দিতেই হবে সংস্কার করা আইনী বিধানে। সুতরাং অধিকার বনাম নমিনী এখন আর টেকার কোন সুযোগ নেই। সমস্যা একটাই সংশ্লিষ্টরা এ ব্যাপারে ওয়াকিফহাল নয়। সুতরাং এখানে নারী শিক্ষা যেমন জরুরী পাশাপাশি তাদের আইনী অধিকার জানাও একান্ত আবশ্যক।
×