ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ডাঃ কাজী কোহিনূর

স্মরণীয় নাট্যব্যক্তিত্ব বেগম মমতাজ হোসেন

প্রকাশিত: ০৯:৫৭, ২৪ জানুয়ারি ২০২০

 স্মরণীয় নাট্যব্যক্তিত্ব বেগম মমতাজ হোসেন

২৮ ডিসেম্বর ২০১৭ বাঙালীদের জন্য একটা হৃদয় বিদারক দিন। যিনি বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের মতো অসহায় নারী জাতির পথ প্রদর্শক ছিলেন। যুগ যুগ ধরে স্রষ্টা আমাদের মাঝে ধারা পরম্পরায় পঠিয়েছেন অসহায় মানুষদের সৎ ও সঠিক পথ দেখানোর বাহক সেভাবেই আমরা পেয়েছি লেখিকা, নাট্যকার ও সমাজসেবী বেগম মমতাজ হোসেনকে। যিনি সকাল-সন্ধ্যা, শুকতারার মতো বেশ কিছু নাটক আমাদের মাঝে দিয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। আপার সঙ্গে আমার সখ্যতা মেডিটেশনের পথ ধরে। তিনি কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা গুরুজী শহীদ আল-বোখারীর ষষ্ঠ ব্যাচের ছাত্রী ছিলেন। আপার উৎসাহে ৩ বছর আপার সঙ্গে মেডিটেশন করা চর্চা করি এবং বেশ ভাল অনুভব করি। উনি বলতেন মানুষের ১০ পথে হাঁটা ঠিক নয় । অনেক উন্নতির পথ সামনে আসতে পারে আবার অনেক বাধা বিঘ্নতা জীবনে আসতে পারে। মেডিটেশন চর্চা করলে মানুষ সঠিক পথ খুঁজে পায়-জীবনের বাধা বিঘœতার কচুরিপানাগুলো দূর হয়। আর সময়টা বেঁচে যায়- জীবনটা হয় স্বাচ্ছন্দ্যের। তাতে একাল-পরকাল দুটাই পাওয়া যায়। সুতরাং আমাদের পরোপকারের কাজটা বেশি বেশি করতে যেতে হবে। ২০১০ সালে ৩০০ ব্যাচে মেডিটেশন কোর্স করলাম। তারপর থেকে উত্তরায় কেউ অসুস্থ হলে-বিপদে পড়লে আপা আমাকে নিয়ে তাদের মঙ্গল কামনায় মেডিটেশন করতেন। কারও রক্ত লাগলে আমরা কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে ব্লাড সংগ্রহের জন্য পাঠাতাম। অসহায় সানুষদের বিপন্মুুক্তির জন্য আপাকে দূর-দূরান্তে যেতে দেখেছি তার অসুস্থতার মাঝে। সংঘই শক্তি। আমাকে সব সময় বলতেন ফাউন্ডেশন ছেড়ো না। জীবনে কাছের মানুষগুলো সারা জীবন বেঁচে থাকে না। বিপদে আপদে সংঘই পাশে থাকে। বলতেন পরোপকারের কাজই এই কাল পরকালে আলো জ¦ালাবে। অসহায় নারীদের পাশে থেক। গুণীজনদের জীবনী ও তাদের মূল্যবান বাক্যবাণী সম্পর্কে আমাদের সকলের জানা দরকার। তবেই গুণীজনের জন্ম হবে পৃথিবীতে । তাদের দিকনির্দেশনা মানুষের জীবনে পথের পাথেয় হয়ে থাকবে। অনেক অসহায় নারীদের তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কারও অসুস্থতায়-স্বামী সঙ্গে/পারিবারিক যে কোন ঝামেলায়- অর্থ উপার্জনের পথ দেখাতেন। তিনি অতিথি পরায়ণ ছিলেন। আর আপাকে সব কাজে যিনি সহযোগিতা করেছেন তিনি আপার ছোট বোন সমাজসেবী মিসেস সেলিমা মান্নান। তিনি বোনদের মধ্যে তৃতীয়। তিনি আপার সব প্রোগ্রামের উৎসাহ দাতা। যারা আপার কাছে সহযোগিতার জন্য আসতেন তাদের আতিথেয়তা আন্তরিকতার সঙ্গে করতেন এবং অসহায় নারীদের থাকতে দিয়েছেন বিপদে আপদে। তারা ৩ জন এতিম মেয়েকে বাসায় রেখে লেখাপড়া শিখিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আপা জন্মগ্রহণ করেছেন ২৮-০৩-২০৪০ সালে, দেশের বাড়ি বরিশাল, বাবার নাম মরহুম আবু সৈয়দ আহম্মেদ, মাতার নাম মরহুমা আমিরুন্নেছা খাতুন। স্বামীর নাম মরহুম একেএম জাহাঙ্গীর হোসেন। বেগম মমতাজ হোসেন ৫ বোন ১ ভাইয়ের মধ্যে দ্বিতীয়। বড় ভাই আলমগীর কবির ইঞ্জিনিয়ার, লেখক, অভিনেতা, চিত্র নির্মাতা, স্বাধীনতার পদকপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীন বাংলা বেতারের (বাংলা ও ইংরেজী) সংবাদ পাঠক ছিলেন। ১টি সন্তান আর্টিস্ট খালিদ মাহমুদ মিঠু, উনি আপার মৃত্যুর ২ বছর আগেই মৃত্যুবরণ করেন। স্বামী মরহুম কেএম জাহাঙ্গীর হোসেন পুলিশ ইন্সপেক্টর ছিলেন তিনি ১৯৮৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন। আপা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ করেছেন। তার কর্মজীবন সাফল্য ম-িত। তিনি ছিলেন প্রাক্তন প্রধান শিক্ষয়িত্রী- উদয়ন বিদ্যালয়ে পরবর্তীতে প্রাক্তন রেক্টর- আরব মিশন পাবলিক স্কুল এ দায়িত্ব পালন করেন, এরপর প্রধান শিক্ষয়িত্রী-কচি কণ্ঠ উচ্চ বিদ্যাদয়ে, তারপর প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন- বোস্টন ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এ্যান্ড কলেজ এ, শুধু এসবই নয় সুবিধাবঞ্চিত শিশু ও নারীদের জন্য অবৈতনিক শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। নাম দেন অবসরে লেখাপড়া। তিনি শিশুদের জন্য অনেক সাহিত্য এবং নাটক রচনা করেন যা বেশ প্রশংসিত হয়েছে এবং সাহিত্য পুরস্কার পান। প্রকাশিত গ্রন্থ : সমূহ স্বপ্নের বন্ধু-প্রকাশক-ধানশীষ প্রকাশনী-১৯৮০ (অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার ১৯৮৩), রংধনুর রং-প্রকাশক-বাংলাদেশ শিশু একাডেমি- ১৯৮৪ (অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার-১৯৮৭), হিজলতলীর গাঁয়ে (মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলন বিষয়ক) প্রকাশক ধানশীষ প্রকাশনী-১৯৮৫, আঁধার রাজ্যের রাজা (রূপকথা) প্রকাশক- বাংলাদেশ শিশু একাডেমি- ১৯৯২, কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ‘লিচু চোর’ এবং ‘খুকু ও কাঠ বিড়ালীর নাট্যরূপ’ প্রকাশক-বাংলাদেশ শিশু একাডেমি-১৯৮৪ (অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার-১৯৯৯), কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা ‘পরিচয়ের’ নাট্যরূপ, প্রকাশক-বাংলাদেশ শিশু একাডেমি-২০০৯, শিশুতোষ পাঠ্য বই- সোনামণিদের পড়া (১ম ভাগ ) ১৯৭৮-২০০৪-ষষ্ঠ সংস্করণ চলছে, শিশুতোষ পাঠ্য বই- সোনামণিদের পড়া (২য় ভাগ) ২০০৯, প্রকাশক-মওলা ব্রাদার্স। তা ছাড়া তিনি বড়দের জন্য নাটক লিখে বেশ প্রশংসিত হয়েছেন, যেগুলো- থেমে নেই জীবন- প্রকাশক- ইউনির্ভাসিটি বুক পাবলিকেশন-২০০৭, অতন্দ্র প্রহরী (মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক) প্রকাশক- ইউনিভার্সিটি বুক পাবলিকেশন-২০০৮, বকুল ঝরার দিনে (মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক)- প্রকাশক- ইউনিভার্সিটি বুক পাবলিকেশন-২০০৯, সেকেন্ড হ্যান্ড (পারিবারিক)- প্রকাশক-ইউনিভার্সিটি বুক পাবলিকেশন-২০০৯, ত্রয়ী (শিশুতোষ নাটকের পুনর্মুদ্রণ)- প্রকাশক- ইউনিভার্সিটি বুক পাবলিকেশন-২০০৯। শিশুদের জন্য ধারাবাহিক নাটকগুলো-রোজ রোজ- সাড়ে তিন বছর প্রচারিত হয়েছে। জুঁই জোনাকী- এক বছর, আপন জন- এক বছর, সবার সঙ্গে- ছয় মাস, কাঠ বেড়ালী ও লিচুচোর- শিশুদের চলচ্ছিত্র নির্মান করেছেন। সোনাভাই (বঙ্গবন্ধু শৈশব ও কৈশর জীবন অবলম্বনে-২০১০)। তিনি সমাজ সংস্কারক ছিলেন। কলম দিয়েও মানুষকে সচেতন করা যায় ঘুঁনে ধরা সমাজের সং¯কার করা যায় সেটাই বলতেন। তিনি স্পষ্টভাষী, দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন। মাঝেমাঝে আমাকে স্নেহের সুরে বাবু বলে ডাকতেন। মেয়েদের নিজে কিছু করার পরামর্শ দিতেন। আমি কোন কিছু করার আগে আপার পরামর্শ নিতাম। আপার কাছে যেটুকু সময় থাকতাম নামাজের ওয়াক্ত হলে আপার সাথে নামাজ পড়তাম। খুব সুন্দর করে আপা মোনাজাত করতেন। মাঝে মাঝে কিছু মানুষের আয়োজন করে দোয়া পাঠের আয়োজন করতেন। তিনি ছিলেন অসহায় নারীদের বটবৃক্ষ।
×