ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ইহুদি নিধনযজ্ঞে সহায়তায় বাধ্য হওয়া বন্দী গাব্বাই-এর গল্প

প্রকাশিত: ০১:৩০, ২৫ জানুয়ারি ২০২০

ইহুদি নিধনযজ্ঞে সহায়তায় বাধ্য হওয়া বন্দী গাব্বাই-এর গল্প

অনলাইন ডেস্ক ॥ "আমি শ্মশানে কাজ করতাম। মৃতদেহগুলো গ্যাস চেম্বার থেকে ওভেনে বয়ে নিয়ে যেতাম," বলছিলেন ডারিও গাব্বাই। অশউইৎজ বন্দী শিবিরের সাবেক এই বন্দী বর্ণনা দিচ্ছিলেন কিভাবে ইহুদিদের মৃতদেহগুলো সরিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হতো। গাব্বাই-এর বয়স এখন ৯৮ বছর এবং তিনিই সম্ভবত ইউরোপ থেকে ইহুদিদের নির্মূল করার নাৎসি পরিকল্পনার সর্বশেষ প্রত্যক্ষদর্শী। অশউইৎজ বন্দীশিবির থেকে মুক্তির ৭৫তম বার্ষিকীতে - এটি হলোকাস্ট বা ইহুদি নিধনযজ্ঞে সহায়তায় বাধ্য হওয়া বন্দীদের একজনের গল্প। ইন্ডাস্ট্রিয়াল কিলিং : হত্যায় গতি বাড়াতে নাৎসিরা অশউইৎজ এর মতো ক্যাম্প তৈরি করে এবং সেখানে একটি বিশেষ ইউনিট তৈরি করে তারা যাকে সন্দারকমান্দো (Sonderkommando) নামে ডাকা হতো। ষোলটি দেশ থেকে অশউইৎজে পাঠানো বন্দীদের সমন্বয়ে এটি গঠন করা হয়েছিলো। "এটা এমন কিছু যা আমি কখনো ভুলবোনা। আমি ভাগ্যবান যে বেঁচে গেছি," বলছিলেন গাব্বাই। সোভিয়েত বাহিনীর হাতে ১৯৪৫ সালের ২৭শে জানুয়ারি অশউইৎজ থেকে মুক্তির পর বেঁচে যাওয়া অনেকে তাদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন। তবে সন্দারকমান্দো (Sonderkommando)ইউনিটে ছিলো এমন কারও কাছ থেকে শোনা গেছে কমই। একজন মানুষের বিশেষ অভিযান : ১৯৮০ সালে ইসরায়েল ভিত্তিক হলোকাস্ট ঐতিহাসিক প্রফেসর জিডিওন গ্রেইফ এই সন্দারকমান্দো'র রহস্য উন্মোচনের কাজ শুরু করেন। "আমার একটা লক্ষ্য ছিলো যে তাদের ছবিগুলোর মান উন্নত করা। যখন গবেষণা শুরু করলাম যখন তাদের কোলাবরেটর ও খুনি হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু তারা ছিলো আসলে ভিকটিম, অপরাধী নয়," প্রফেসর জিডিওন গ্রেইফ বিবিসিকে বলছিলেন। অশউইৎজ থেকে বেঁচে আসা বিখ্যাত ব্যক্তি প্রিমো লেভি "দি ড্রোওনড এন্ড দা সেভড" বইয়ে লিখেছেন, সন্দারকমান্দো ছিলো নাৎসিদের সবচেয়ে শয়তানোচিত অপরাধ এবং এর সাথে একমত পোষণ করেছেন ড: গ্রেইফ। "এটা ছিলো জার্মানদের পরিকল্পিত কাজ। তারা চেয়েছিলো ইহুদিরাও একই অপরাধের দায় বহন করুক। এটা ছিলো নিষ্ঠুর একটি পরিকল্পনা। তারা অপরাধী ও ভিকটিমের মধ্যেকার পার্থক্য ঘুচিয়ে দিতে চেয়েছিলো"। মৃতদেহের খোঁজে : ড: গ্রেইফ সন্দারকমান্দোর ৩১জনের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেছেন তার প্রথম বইয়ে। সন্দারকমান্দো সদস্যরা হত্যা প্রক্রিয়ায় সহায়তা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এমনকি মৃতদেহ নিশ্চিহ্ন করার আগে তাদের খুঁজতে হতো তাদের সোনার দাঁত কিংবা কোনো মূল্যবান কিছু আছে কিনা। অশউইৎজে কাজের পরিবেশে তাদের ছবিই ছিলো অল্প কিছু। ঈশ্বর কোথায় : গাব্বাই-এর সেখানে বিশেষ কাজ ছিলো। আর তা হলো খুন হওয়া নারীদের চুল কেটে সংগ্রহ করা। কয়েক দশক পর এখন তিনি অনুভব করেন কেমন ছিলো তার মনের অবস্থা। যুক্তরাষ্ট্রের একটি সংগঠনকে তার অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, "আমি নিজেকেই প্রশ্ন করি যে কেনো আমি বেঁচে গেলাম? ঈশ্বর কোথায়?" পোল্যান্ডের একজন নাগরিক তাকে শক্ত থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং তিনিও পরামর্শটিকে গুরুত্ব সহকারে নিয়েছিলেন। "আমি নিজেকে বলেছি..আমি একটা রোবট। চোখ বন্ধ করে যা করতে বলা হয়েছে তা করে যাও"। শাস্তি : গাব্বাই কোনো আদেশ অমান্য করতে পারেননি-কারণ কেউ আদেশ মান্য করতে অদক্ষ বা ধীর গতি দেখালে তাকে খুব নিষ্ঠুর শাস্তি পেতে হতো। অনেক সময় এসএস গার্ডরা মৃতদেহ পর্যবেক্ষণ করতো এবং তাতে সোনার কিছু পেলে যে দায়িত্বে ছিলো তাকে জ্বলন্ত উনুনে নিক্ষেপ করা হতো। এছাড়া গুলি করা, নির্যাতন করা, মারধর কিংবা উলঙ্গ করে ঘুরিয়েও শাস্তি দেয়া হতো। নাৎসির সন্দারকমান্দো ইউনিটের সদস্যদের অনেককে ছয় মাস পরপর হত্যা করতো এবং নতুন সদস্য আনতো। "তারা ছিলো শকের রাজ্যে। হাজার হাজার ইহুদিকে হত্যার দৃশ্য তাদের দেখতে হতো। বেঁচে থাকার জন্য এটাই ছিলো বড় চ্যালেঞ্জ," বলছিলেন ড: গ্রেইফ। গ্যাস চেম্বার : গাব্বাইয়ের মতো বেঁচে যাওয়া অনেকে মূলত মৃত্যুর কারখানায় কাজ করার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন। "তারা দরজা বন্ধ করতো। এরপর জাইক্লোন বি নিক্ষেপ করা হতো। এতে মরতে সময় লাগতো ৪/৫ মিনিট। শুধু গ্যাস যেদিক থেকে আসছে সেদিকের লোকজনের লাগতে দু মিনিটের মতো"। ক্রিস্টাল পেলেট ফর্মে জাইক্লোন বি ক্যাম্পে দেয়া হতো পরে এগুলো বাতাসে মিশে বিষাক্ত গ্যাসে পরিণত হতো এবং মানুষকে মারতে শুরু করতো। দ্রুত মৃত্যুর ক্ষমা: ওই ইউনিটের একজন সদস্য ছিলো ইয়াকভ যিনি গাব্বাইয়ের ভাই। ইয়াকভ তার দুই কাজিনকে গ্যাস চেম্বারে ঢোকাতে দেখেছেন। তিনি তাদের বলেছেন যাতে গ্যাসের কাছে থাকে ফলে মৃত্যু কষ্ট কম হবে। ড: গ্রেইফ বলছেন, যারা এ ধরণের মৃত্যু কূপে কাজ করে তারা ধীরে ধীরে আবেগহীনে পরিণত হয়। এর মানে এই নয় যে তারা খারাপ হয়ে গেছে। কেউ কেউ বলেছেন তারা শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত ভিকটিম ইহুদিদের মর্যাদা রক্ষার চেষ্টা করেছেন। সন্দারকমান্দো ইউনিট সদস্যদের মধ্যে জোসেফ সাকারই ছিলেন প্রথম যার সাথে ১৯৮৬ সালে ড. গ্রেইফের সাক্ষাত হয়। সাকারকে এমন জায়গায় মোতায়েন করা হতো যেখানে নারীদের পোশাক খুলে ফেলতে বলা হতো। "আমি আমার মাথা অন্যদিকে সরিয়ে ফেলতাম এবং নিশ্চিত হতাম যে তারা বিব্রত হচ্ছে না," সাকার বলেছেন ড: গ্রেইফকে। মৃতদের জন্য প্রার্থনা : সন্দারকমান্দোরা বেশিরভাগ ছিলো প্রথাগত ইহুদি। তারা দিনে তিন বার প্রার্থনা করতো ধর্মীয় অনুশাসন অনুযায়ী। এমনকি ক্যাম্প গার্ডরা কাছাকাছি না থাকলে তারা কাদ্দিস পড়তো। এটি শেষকৃত্যের সময় মৃতদের মনে করে করা প্রার্থনা। একশ'র মতো সন্দারকমান্দো সদস্যকে রিক্রুট করা হয় অশউইৎজে হাঙ্গেরিয়ান ইহুদিদের ডিপোর্ট করার সময়। ইসরায়েলের হলোকাস্ট মেমোরিয়ালের নোটে উল্লেখ করা আছে যে, ওই মাত্র আট সপ্তাহে প্রায় ৪ লাখ ২৪ হাজার ইহুদিকে অশউইৎজে ডিপোর্ট করা হয়। হত্যার পর শেষ কৃত্য করার বিষয়টি সক্ষমতার বাইরে চলে গিয়েছিলো। তখন শ্মশানের দায়িত্বপ্রাপ্ত জার্মান কর্মকর্তা জ্বলন্ত কয়লার কূপ খননের আদেশ দেন সন্দারকমান্দো সদস্যদের। এসময় একটি গোপন ছবি তুলেছিলেন একজন যাতে পরিষ্কারভাবে দেখা যায় যে কিভাবে দেহগুলো জ্বলন্ত কয়লায় পুড়ছে। সাহসিকতা : সন্দারকমান্দো শলমো ড্রাগন অবাধ্য হওয়ার মতো তেমন কোনো ঘটনা দেখেননি। তবে তিনি একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন ড: গ্রেইফের কাছে। "একজন নারী অনাবৃত হতে অস্বীকৃতি জানান। যখন এসএস (ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা জার্মান ইউনিট) সদস্য এসে তাকে বন্দুক ঠেকান ও তার অন্তর্বাস খুলতে বলেন। তিনি তার ব্রা খুলে তার মুখে ধরেন এবং এরপর তাকে আঘাত করলে তার বন্দুক পড়ে যায়। এরপর ওই নারী দ্রুত বন্দুকটি নিয়ে ওই সদস্যকে হত্যা করেন। এই নারী ছিলেন পোলিশ নৃত্যশিল্পী ফ্রান্সেসকা ম্যান ও মৃত্যুর পর তিনি ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। আরেকজন সন্দরকমান্দো সদস্য দেখেছেন কিভাবে একজন পোলিশ শিশু ইহুদিদের প্রার্থনা সঙ্গীত গাইতে গাইতে গ্যাস চেম্বারে প্রবেশ করছে। ব্যর্থ বিদ্রোহ : অন্য বন্দীদের তুলনায় কিছুটা ভালো খাবার ও থাকার ব্যবস্থা ছিলো সন্দারকমান্দোদের। এমনকি ভিকটিমদের পোশাকও তারা ব্যবহার করতে পারতো। তাদের থাকার ঘর ছিলো আলাদা এবং সার্বক্ষণিক নজরদারি ছিলো। এরপরেও তারা একটি লড়াইয়ে সামিল হয়েছিলেন যেটি তাদের বিদ্রোহ হিসেবেই পরিচিত। "১৯৪৪ সালের ৭ই অক্টোবরের অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেছিলেন দুই ভাই। এটা ছিলো ইহুদি বিদ্রোহ। এটা ছিলো সাহসিকতার গল্প যা সোনালী অক্ষরে লেখা থাকা উচিত," বলছিলেন ড: গ্রেইফ। ওই দিন তারা অন্য কয়েক জন এসএস গার্ডদের ওপর হামলা করেন ও আগুন ধরিয়ে দেন। কিন্তু এর জেরে ৪৫১ জন সন্দারকমান্দোকে গুলি করে হত্যা করা হয়। লিপিবদ্ধ নিষ্ঠুরতা : মার্সেল নাদজারি তার ক্ষোভের কথা লিপিবদ্ধ বা রেকর্ড করেছিলেন। "মৃত্যু হবে তা নিয়ে আমি দুঃখিত নই। কিন্তু আমি দুঃখিত এজন্য যে আমি প্রতিশোধ নিতে পারছিনা," নাজদারি লিখেছিলেন ১৯৪৪ সালের নভেম্বরে। তিনি তার নোটে লিখেছিলেন একজন ভিকটিমের পুড়ে যাওয়ার পর ছাইয়ের ওজন ৬৪০ গ্রাম। নাজদারি সহ আরও কয়েক জনের নোট আরও অনেক পরে আবিষ্কৃত হয়। এগুলো থেকে নির্যাতনের মাত্রা সম্পর্কে বোঝা যায়। ন্যায় বিচার প্রার্থনা : যুদ্ধের পর সন্দারকমান্দো কয়েক জন তাদের সাবেক গার্ডদের আদালতে নিয়ে যান। হেনরিক তাওবার এসএস কমান্ডার অটো মলের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন। "বহুবার মল লোকজনকে জ্বলন্ত কয়লায় ফেলেছে," আমেরিকান মিলিটারি ট্রাইব্যুনালে বলেন তিনি। বিচারে মলের মৃত্যুদণ্ড হয়েছিলো। নাৎসি ক্রিমিনাল : অনেক অপরাধী কখনোই শাস্তি পায়নি। অশউইৎজের সাত হাজার স্টাফের মধ্যে আইনের মুখোমুখি হয়েছে মাত্র আট'শ জন। মানব ইতিহাসের অন্যতম বড় গণহত্যায় যেখানে এগার লাখ মানুষ খুন হয়েছে এবং এর মধ্যে ৯০ ভাগই ইহুদি। "কোনো জার্মান নাৎসির স্বাভাবিক মৃত্যু হওয়া উচিত নয়," বলছিলেন ড: গ্রেইফ একমাত্র সাক্ষী : ড: গ্রেইফ বলছেন, এখন আর সন্দারকমান্দোদের কেউ কলাবরেটর বলতে পারবেনা। বেঁচে থাকা একমাত্র সাক্ষী গাব্বাই এখন লজ এঞ্জেলেসে বাস করেন ও কথা বলার মতো নেই। "আমি নিজেকে বলেছি একদিন যুদ্ধ শেষ হবে এবং যখন শেষ হবে আমি যেন বাঁচতে পারি এবং বিশ্বকে সব ঘটনা জানাতে পারি"। সূত্র : বিবিসি বাংলা
×