ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যাংকের জবাবদিহি

প্রকাশিত: ০৮:৫১, ২৬ জানুয়ারি ২০২০

ব্যাংকের জবাবদিহি

যে কোন দেশে সরকারী-বেসরকারী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের খবরদারি ও নজরদারি একান্ত আবশ্যক। তবে বাস্তবতা হলো আমাদের দেশে অদ্যাবধি সেই সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু ক্ষমতা থাকলেও ব্যাংকিং সেক্টরে বিদ্যমান সমস্যা ও দুর্বলতায় প্রমাণিত হয়েছে যে, তা তেমন কার্যকর নয়, কঠোর তো নয়ই। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, প্রায় দেউলিয়া অবস্থায় উপনীত ফারমার্স ব্যাংক, দুর্নীতি ও আর্থিক অনিয়মে জর্জরিত বেসিক ব্যাংকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক আদৌ কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। এর পাশাপাশি সরকারী ব্যাংকগুলোর বিপুলসংখ্যক ঋণখেলাপীসহ খেলাপী ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শৈথিল্য ও গাছাড়া ভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। বুধবার জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী ১০৭ পৃষ্ঠাব্যাপী ৮ হাজার ২৩৮ ঋণখেলাপী ব্যক্তি ও কোম্পানির তালিকা প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের সব ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত সিআইবি ডাটাবেজে রক্ষিত ২০১৯ সালে নবেম্বরভিত্তিক হালনাগাদ তথ্যানুযায়ী খেলাপী ঋণের পরিমাণ ৯৬ হাজার ৯৮৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। পরিশোধিত ঋণের পরিমাণ ২৫ হাজার ৮৩৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে যেটি রীতিমতো উদ্বেগজনক, আশঙ্কা ও উদ্বেগের তা হলো, ব্যাংকের মালিক ও পরিচালকদেরই প্রায় দুই লাখ কোটি টাকার অপরিশোধিত ঋণ রয়েছে, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ১১ শতাংশের বেশি। অর্থমন্ত্রী স্বয়ং এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। হাইকোর্টও এক রায়ে উদ্বেগ- উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে বলেছে, টেকসই অর্থনীতি ধরে রাখতে পরিচালনা পর্ষদসহ ব্যাংক পরিচালনাকারীদের অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে স্বচ্ছ ও জবাবদিহি করতে হবে। ঋণখেলাপীদের পুনর্তফসিল সংক্রান্ত বিশেষ সুবিধা বহাল রেখে হাইকোর্ট ৫০ পৃষ্ঠার যে রায় দিয়েছে তাতে এই পর্যবেক্ষণ প্রকাশিত হয়েছে। আদালত বলেছে, যেহেতু ব্যাংক আমানতকারীদের তথা পাবলিক অর্থে ব্যবসা করছে, সেহেতু তাদের অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা তথা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে। উল্লেখ্য, মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে খেলাপী ঋণ পরিশোধের বিশেষ সুযোগ সরকার থেকে দেয়া হলেও এক্ষেত্রে আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায়নি, যা নিঃসন্দেহে দুর্ভাগ্যজনক। এর বাইরেও অর্থমন্ত্রী ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম-অব্যবস্থা-দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেছেন, যা সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘদিন থেকে। নয়-ছয় সুদহার বাস্তবায়ন করা নিয়েও গড়িমসি করছে ব্যাংকগুলো। ব্যাংকগুলো আসলেই উচ্চহারে সুদ নিয়ে থাকে। এত বেশি সুদে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ ও ব্যবসা করা দুরূহ। আর সে কারণেই সিঙ্গেল ডিজিট তথা নয়-ছয় সুদহার এবং সরল সুদহার কার্যকর করা এখন সময়ের দাবি। দেশে তাহলে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আসবে, শিল্প কারখানা স্থাপনসহ কর্মসংস্থান বাড়বে। এর পাশাপাশি কমে আসবে ঋণ খেলাপীর সংখ্যাও। সরকার এটি বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ইতোপূর্বে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স (বিএবি)-এর নেতৃবৃন্দ অঙ্গীকার করেছিলেন যে, যথাসত্বর তারা সিঙ্গেল ডিজিট তথা সরল সুদহার কার্যকর করবেন। এই সুদহার হবে দশ-এর নিচে, আমানত ও ঋণের অনুপাতে ৬-৯-এর মধ্যে। এর বিনিময়ে তারা সরকারের কাছ থেকে মাত্র ৬ শতাংশ সুদে সরকারী তহবিলের অর্ধেক বেসরকারী ব্যাংকগুলোতে সংরক্ষণসহ কিছু সুযোগ-সুবিধাও আদায় করে নিয়েছিলেন। সরকার তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করলেও কোন ব্যাংক অদ্যাবধি তা বাস্তবায়িত করেনি, সিঙ্গেল ডিজিট তো দূরের কথা। ফলে আমানতকারীদের পাশাপাশি উদ্যোক্তারাও বেশ হতাশ হয়ে পড়ছেন। উপরন্তু দ-সুদে নাকাল হচ্ছেন অনেক উদ্যোক্তা। অন্যদিকে প্রায় সব ধরনের সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমে যাওয়ায় আমানতকারীরাও হতাশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, শিল্পঋণের বিপরীতে উদ্যোক্তাদের বর্তমানে সুদ গুনতে হচ্ছে ১৪ থেকে ১৭ শতাংশ পর্যন্ত। এ ছাড়া ঋণ নেয়ার সময় প্রক্রিয়াকরণ ফিসসহ আরও অন্য যেসব ফি নেয়া হয়, তাতে এ হার ২০-২২ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে। বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণের বিপরীতে সুদ বা বিনিয়োগের মুনাফার হার নমনীয়-সহনীয় হওয়া মানেই তা হবে ব্যবসাবান্ধব। আমাদের দেশে ঘটেছে উল্টো। এর সমাধান করতে পারলে ব্যাংক ঋণের ওপর সুদের হার কমানো সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের পক্ষেই সম্ভব হবে। ব্যাংকিং খাতে সুবাতাস বয়ে যাক, এটাই প্রত্যাশা। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা ও কর্মতৎপরতাও অত্যাবশ্যক।
×