ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শীতলপাটি

বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি টিকে থাকার প্রেরণা

প্রকাশিত: ১১:২৪, ২৬ জানুয়ারি ২০২০

বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি টিকে থাকার প্রেরণা

সালাম মশরুর ॥ ‘শীতলপাটি গরম চা’ সিলেট অঞ্চলে একটি পরিচিত শব্দ। শীতলপাটিতে বসে গল্পগুজব করে চা খাওয়ার স্বাদই আলাদা। গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে শীতলপাটির রয়েছে গভীর সম্পর্ক। শুধু চা খাওয়া নয়, গ্রামাঞ্চলে ভিন্ন স্থান থেকে বাড়িতে বেড়াতে আসা আত্মীয়-স্বজনদের বসতে দেয়া, খাওয়া-দাওয়া ও ঘুমানোসহ নানান আচার অনুষ্ঠানে শীতলপাটির ব্যবহার ছিল প্রধান বিষয়। কালের গহ্বরে হারিয়ে যাওয়ার এই পর্যায়ে সাম্প্রতিক কালের শীতলপাটির বিশ্ব স্বীকৃতি নতুন করে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। মুখে মুখে আলোচনা হচ্ছে শীতলপাটির ইতিহাস নিয়ে। ইউনেস্কোর স্বীকৃতি বিলুপ্ত প্রায় শীতলপাটির জীবনে আশার আলো জ্বালিয়েছে। পুঁজি সঙ্কট, উপকরণের অভাব, নায্যমূল্য না পাওয়াসহ নানা সমস্যার কারণে সিলেট অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটি বিলুপ্ত হতে চলেছে। এক সময় মুর্তাবেতের তৈরি শীতলপাটির কদর ছিল সব জায়গায়। সিলেট অঞ্চলে বিয়ের অনুষ্ঠানে সব সরঞ্জামাদির সঙ্গে একটি শীতলপাটি দেয়ার রেওয়াজ ছিল। জন্মদিন, বিদায় সংবর্ধনা, অতিথি বরণসহ নানান অনুষ্ঠানে শীতলপাটি ব্যবহার করা হতো। আর এখন এর ব্যবহার নেই বললেই চলে। শীতলপাটির দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ সবার কাছে পছন্দের। মুর্তাবেত দিয়ে তৈরি শীতলপাটির নক্সাগুলো পাটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। নক্সাগুলোর মধ্যে মসজিদ, মন্দির, নৌকা, হাঁস-মোরগ, হাতি, পাখি ও বিড়ালসহ বিভিন্ন পশু-পাখির ছবি তৈরি করা হয়। এক সময় সিলেট বিভাগের বিভিন্ন স্থানে শীতলপাটি তৈরি করা হতো বেশুমার। এই শীতলপাটি বিক্রি করেই জীবিকা নির্বাহ করত বহু পরিবার। এছাড়া বাণিজ্যিকভাবে শীতলপাটি তৈরি ছাড়াও গ্রামের লোকজন নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে মুর্তাবেত দিয়ে শীতলপাটি তৈরি করে নিতেন। গ্রাম এলাকার অধিকাংশ বাড়িতেই এক সময় মুর্তাবেত পাওয়া যেত। বাড়ির পাশের পুকুর, ডোবা-নালার আশপাশে মুর্তাবেত লাগানো হতো, যা ছিল সহজলভ্য। একটি সাধারণ পাটি বুনতে সময় লাগে ১৮/২০ দিন। পাটি বিক্রয় করতে হয় ২৫০০ টাকা থেকে ৩০০০ টাকা এবং উন্নতমানের পাটি বুনতে সময় লাগে দেড় মাস। বিক্রি হয় ১৫-২০ হাজার টাকায়। শীতলপাটির সঙ্গে জড়িতরা জানান, মুর্তা কিনে পাটি বানাতে যে খরচ ও সময় ব্যয় হয় তাতে তাদের আয় ব্যয় পোষানো কঠিন হয়ে যায়। পুঁজি সঙ্কট এবং ব্যাংক থেকে ঋণ প্রাপ্তিতে জটিলতার কারণে অনেকেই এই ব্যবসা থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। শীতলপাটির প্রধান উপাদান মুর্তা নামের একবীজপত্রী উদ্ভিদের ছাল। যা ‘মুর্তাবেত’ নামে পরিচিত। সিলেটের হাওড় এলাকায় এক সময় মুর্তাবেতের ব্যাপক চাষ হতো। বাড়ির পাশের স্যাঁতসেঁতে জায়গা, জঙ্গল, অনাবাদি জমিতে হর-হামেশা পাওয়া যেত মুর্তা গাছ। অপরিকল্পিত নগরায়ন, আবাসন, বন-জঙ্গল কেটে সাফ করে ফেলায় বর্তমানে এই মুর্তা গাছ দুষ্প্রাপ্য। আশির দশকে সরকার মুর্তা গাছ উৎপাদনের জন্য সিলেটের কৃষকদের ঋণ দেয়ার কথা বললেও পরবর্তীতে তা আর বাস্তবায়িত হয়নি। ১৯৮৫ সালে সিলেটের বিয়ানীবাজারে বেসরকারী উদ্যোগে বাণিজ্যিক লাভের আশায় মুর্তার চাষ শুরু হলেও দু-তিন বছর পর তা মুখ থুবড়ে পড়ে। সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বলেন, আমাদের এক শ’র মতো মুর্তামহাল রয়েছে। এগুলো দুই বছর মেয়দে লিজ দেয়া হয়। নতুন নতুন জমিতে মুর্তা চাষও করা হচ্ছে। সম্প্রতি রাতারগুলের বেদখলকৃত জমি উদ্ধার করে মুর্তা চাষ করা হচ্ছে। এছাড়া বনবিভাগের জলাভূ’মি শ্রেণীর ১৫০০ হেক্টর জমিতে মুর্তা চাষ করার জন্য ১৭০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। সিলেটে তৈরি ‘শীতলপাটি’র সুনাম বেশ পুরনো। সিলেটকে বিশ্ব পরিম-লে আলাদা পরিচয় এনে দিয়েছে সিলেটের এই ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্প। অর্ধশত বছর পূর্বেও সিলেটের শীতলপাটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুনাম কুড়িয়েছে। ইউনেস্কোর বিশ্ব নির্বস্তুক সংস্কৃতি ঐতিহ্যের (ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি) তালিকায় স্থান করে নিল ‘শীতলপাটি’। এই অর্জনে নতুন করে প্রাণের সঞ্চার হয়েছে মৃতপ্রায় এই কারুশিল্পে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশের শীতলপাটির জন্য বিখ্যাত হয়েছেন মৌলবীবাজারের ধুলিজুড়া গ্রামের হরেন্দ্র দাশ। হরেন্দ্র দাশ শীতলপাটি বুনে বিখ্যাত হওয়ায় ২০১৩ সালে সরকারীভাবে প্রশিক্ষণে যান জাপান। শীতলপাটির জন্য বিখ্যাত হরেন্দ্র দাশ বলেন, আমার পূর্ব পুরুষেরা এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাই আমিও জড়িয়ে রয়েছি। পরিশ্রম অনুযায়ী বাজারে উপযুক্ত মূল্য না পাওয়ায় এ কাজে আগ্রহ কমে গেছে। কিন্তু পূর্ব পুরুষেরা করে গেছেন তাই আমি বাদ দিতে পারি না। স্থানীয় বাজারে বর্তমানে তেমন চাহিদা নেই। তবে ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, যশোর ও সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ফরমাইশ আসে। সে অনুযায়ী পাটি বুনে তাদের কাছে পাঠাই। এ ব্যাপারে শীতলপাটি শিল্প পরিষদের সভাপতি বেনু ভূষণ দাশ বলেন, মূলধন ও প্রশিক্ষণের অভাবে আমরা এই শিল্পকে বিকশিত করতে পারছি না। সরকারী উদ্যোগে ব্যাংক থেকে স্বল্প সুদে ঋণ দেয়া হলে এই শিল্প দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি করা সম্ভব হবে। ধ্বংসের হাত থেকে যাতে শীতলপাটিকে রক্ষা করা যায় এজন্য সরকারী উদ্যোগে বিভিন্ন স্থানে মুর্তাবেত বাগান তৈরি করা প্রয়োজন। দেশে সবচেয়ে উন্নতমানের শীতলপাটি তৈরি হয় সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলায়। মৌলভীবাজারের রাজনগর, কুলাউড়া, বড়লেখা ও জুড়িতেও তৈরি করা হয় বিশেষ এ পাটি বা মাদুর। এসব এলাকার পাটির কারিগর বা পাটিকররা বংশ-পরম্পরায় শীতলপাটির কাজ করে আসছেন। বর্তমানে অন্তত পাঁচ হাজার শ্রমিক এই পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। শীতলপাটি বিক্রেতারা জানান, একসময় গ্রামাঞ্চল থেকে প্রচুর পরিমাণ শীতলপাটি আসত, দামও ছিল কম। কিন্তু এখন মুর্তাবেতের সঙ্কটের কারণে শীতলপাটি তৈরির পরিমাণ কমে গেছে। এছাড়া, ইদানীং বাজারে প্লাস্টিকের মাদুর সহজলভ্য হওয়ায় মানুষ ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অপেক্ষাকৃত বেশি দাম থাকায় শীতলপাটি কিনতে চান না। মুড়া পদ্ধতিতে মুর্তার চারা উত্তোলনের উপযুক্ত সময় বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাস। মুড়া সংগ্রহ করার সঙ্গে সঙ্গে পলিব্যাগ বা সীড বেডে বা (বীজতলায়) রোপণ করতে হয়। যদি রোপণে দেরি হয় তাহলে ছায়াযুক্ত জায়গায় মুড়ায় হালকা পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখতে হবে। বীজ হতে মুর্তার চারা তৈরির সময় হলো মে-জুলাই মাস। মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে মুর্তা গাছে ফুল ফোটে। ফুলের রং সাদা। তাই এপ্রিলের শেষ দিক থেকে জুলাইয়ের প্রথম দিকে মুর্তার বীজ সংগ্রহ করতে হয়। গাছ থেকে সরাসরি ফল সংগ্রহ করা যায়। একটি ফলে ২-৩টি বীজ থাকে। হাত দিয়ে চটকিয়ে ফল হতে বীজ বের করতে হয়। বীজ সংগ্রহের পর পরই বপন করা উত্তম। চারা গজাতে ১৫ থেকে ২৫ দিন সময় লাগে। বীজ বপনের পরে বেডে শেড দিতে হয়। মুর্তা চাষের উপযুক্ত স্থান হলো নিচু স্যাঁতসেঁতে জমি। বাড়ির আশপাশে, ডোবার ধারে পুকুরের ঢালু পাড়, খালের পাড় ও বাঁধের ছায়াযুক্ত স্থান উপযোগী। সিলেট ছাড়াও টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর ও সিরাজগঞ্জসহ হাওড় বাঁওড়ে প্রাকৃতিকভাবে মুর্তা জন্মে। মুর্তা গাছের বয়স যখন ২ বছর হয়, তখন বেত কাটার উপযুক্ত সময়। মুর্তা সাধারণত: মার্চ/এপ্রিল মাসে কাটা হয়। এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে মুর্তা বাগান তৈরি এবং প্রক্রিয়াজাত করার কাজে উন্নীত করতে হবে। যাতে পাটিকররা আগ্রহী হন। বিলুপ্তপ্রায় মুর্তা বাগান তৈরিতে স্থিতিশীল চাষাবাদ করতে হবে।
×