ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মেয়েদের হল জীবন...

প্রকাশিত: ১২:৪৬, ২৬ জানুয়ারি ২০২০

মেয়েদের হল জীবন...

জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় যদি হয় ছাত্রজীবন তাহলে ছাত্রজীবনের স্বর্ণালি দিনগুলো হলো বিশ্ববিদ্যালয় হল জীবন। একেকটি হল যেন হাজার হাজার মনের দুঃখ-বেদনা আর আবেগ-অনুভূতির নীরব সাক্ষী। কত ভবিষ্যত কবির শত শত অস্ফুট চরণ, কত নেতার দেশ গড়ার অব্যক্ত স্বপ্ন, কত পড়ুয়ার চাকরি না পাবার বেদনা ধারণ করে একেকটি হল তার হিসাব কে রাখে? ছেলেদের হলগুলো রাত-দিন সব সময়ই থাকে জমজমাট। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম মেয়েদের হলগুলো। মেয়েদের হলের কথা জানাচ্ছেনÑ মহিউদ্দিন আহমেদ লম্বা করিডরে বিকেলের সোনারোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্রী নীলা। থাকেন রোকেয়া হলে। নীলার সঙ্গে তারই বিভাগের অপূর্বর সঙ্গে বন্ধুত্ব। অপূর্বের অনুরোধে নীলা প্রতিদিন অপূর্বর জন্য হালকা রান্না করে। নুডলস, খিচুরি ইত্যাদি। দুপুরে লম্বা একটা ঘুম দেয়ার পর ফুরফুরে বিকেল। এই বিকেলটার জন্য নীলা সারাটা দিন অপেক্ষা করে। প্রতিদিন অপূর্ব আসে এ সময়টাতেই। দিনের অন্য সময়গুলোতে সে পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ক্লাসে ফার্স্ট বয়। তাদের কি পড়াশোনার বাইরে বেশি সময় নষ্ট করলে চলে! হাতে একদম সময় কম। এসেই চলে যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো। গার্ডের কাছে কল দেয়। যদি কখনও নীলা সামান্য দেরি করে ফেলে তাহলে অপূর্ব রেগেমেগে অস্থির হয়ে যায়। যা রাগ ওর! তাই সে ঘুম থেকে উঠেই অপূর্বর জন্য নাশতা রেডি করে রাখে। বাড়িতে কোনদিন রান্না করেনি। মা বলতেন ‘শেখ। প্রত্যেক মেয়েকেই রান্নার কাজটা শিখতে হয়। মেয়েদের বড় কাজই তো সংসার গোছানো।’ নীলা তখন চিন্তা করেনি। বরং মায়ের কথা তখন হাস্যকর মনে হতো। ওদের বাড়ি নরসিংদী। মা-বাবার খুব আদরের মেয়ে। শুরুর দিকে মনটা কেমন ছটফট করত। একদম ভাল লাগত না। সবসময় ইচ্ছে হতো বাড়িতে চলে যেতে। প্রথম দিকে বৃহস্পতিবার এলেই কোনরকমে ব্যাগটা গুছিয়ে রওনা হতো বাড়ির উদ্দেশে। বাড়ি গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদত। মা সান্ত¡না দিতেন, ‘মাত্র তো পাঁচটা বছর। তারপরই আবার একসঙ্গে থাকব আমরা।’ চারাগাছ যেমন ধীরে ধীরে শক্ত হয়, তেমনি নীলাও মানিয়ে নিয়েছে হলের জীবন। গুনে দেখে আজ তেত্রিশ দিন হয়ে গেছে সে বাড়ি যায়নি। কই, খুব তো খারাপ লাগছে না! অদ্ভুত! অনেকগুলো বন্ধু হয়েছে ওর। বলতে কী, নিজের ক্যাম্পাসের প্রতি দারুণ একটা টান তৈরি হয়েছে। মানুষ যে জায়গাটিতে অনেকদিন থাকে, সে জায়গাটা তার কাছে একসময় অনিবার্য হয়ে ওঠে। তাই ক্যাম্পাস তার কাছে এখন নিজের বাড়ির মতোই। মনের সঙ্গে একেবারে মিশে গেছে। আর এরই মধ্য দিয়ে সে কখন যে রান্না-বান্নার মতো কঠিন একটা কাজও শিখে ফেলেছে বুঝতেই পারেনি। মাঝে মাঝে ওর মনে হয় জানালায় পাশে দাঁড়িয়ে যতœ করে রান্না করা দেখছেন ওর মা। লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে নীলার মুখ। লজ্জা পেতে পেতে ভাবে, আবার ভাবে, দূর মা আসবে কোত্থেকে? তারপরও লজ্জাটা কাটে না। মাকড়সার জালের মতো ওকে জড়ায়। তখন অপূর্বর ওপর ভীষণ রাগ হয়। সব দোষ অপূর্বর! বন্ধু হলো মনের জ্যোতি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুর দিকে সবাই চায় বন্ধুতা। একেকজন ছাত্রছাত্রী একেক জেলা থেকে আসে। অথচ প্রবল বন্ধুত্বের সুতো ঘুচিয়ে দেয় দূরত্ব। তৈরি হয় একের প্রতি অন্যের বিশ্বাসবোধ কিংবা নির্ভরশীলতা। নতুন এক জীবনের ভেলায় চড়ে ভাসতে থাকে তারা। সেই জীবনে শুধু নীলাকাশ আর ঝলমলে রোদ। হলের কক্ষটি একান্তই নিজের। যদিও এক বা একাধিক কক্ষসখী থাকে। প্রতিদিন পরিপাটি করে ঘর গোছায়, মেঝে ঝাড়ু দেয়। সকালে ক্লাস। দ্রুত নাশতার পর্ব সেরে যেতে হয় ডিপার্টমেন্টে। কীভাবে যে সময়টা কেটে যায়! একলাফে দুপুর চলে আসে। আগে যেতে হবে ডাইনিংয়ে। না হলে তলানির ঠাণ্ডা খাবার জুটবে কপালে। কোনরকমে বই-খাতা টেবিলে রেখে ডাইনিংয়ের উদ্দেশে দৌড়। লম্বা টেবিলপাতা। ঘরজুড়ে পরিচিত গন্ধ। চিকন নলা মাছের তরকারি আর পাতলা ডাল। আহা অমৃত! দিন কাটে তো ভাল ভাল সন্ধ্যা বড়ই... মুখর সন্ধ্যা। হৈহুলোড়। ছেলেরা হৈহুলোড় করার যতটা সুযোগ পায় মেয়েরা ততটা পারে না। সমাজ বলে একটা কথা আছে। একটা ছেলে ইচ্ছে হলে যা করতে পারে একটা মেয়ে তা পারে না। তাই বাইরে বের হলেও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে হলে ফেরা বাধ্যতামূলক। আর তাই সন্ধ্যাটা হয়ে পড়ে বড় নীরস, একঘেয়ে। অবাক স্বপ্ন পাখা মেলে মনের আকাশে বাধাহীন জীবন। মা-বাবার কড়া শাসন নেই। পাড়াপড়শির বাঁকা চাউনি নেই। তাই হলের মেয়েরা নিজেদের মতো করে দিনযাপন করতে পারেন। এক কথায় স্বাধীন। একটা স্বাধীন জীবন যে কোন মানুষকেই স্বপ্ন দেখাতে শুরু“করে। অবাক স্বপ্নের পাখা মেলে উড়াল দেয় আকাশে। হলের মেয়েরা নারীসমাজের রোল আইডল। জয় হোক হলের মেয়েদের।
×