ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নতুন আতঙ্ক করোনা ভাইরাস ॥ প্রতিরোধ এবং সতর্কতা

প্রকাশিত: ০৯:১৯, ২৯ জানুয়ারি ২০২০

নতুন আতঙ্ক করোনা ভাইরাস ॥ প্রতিরোধ এবং সতর্কতা

চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে নতুন ধরনের করোনা ভাইরাস এপিডেমিক, প্যানডেমিক (যখন কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে পড়ে) আকার ধারণ করেছে। গত ডিসেম্বরে উহানে ভাইরাসটি প্রথম ধরা পড়ে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ধারণা, ভাইরাসটির উৎস কোন প্রাণী। মানুষের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাটি ঘটেছে উহান শহরে সামুদ্রিক মাছ বিক্রির বাজারে। গত বিশ বছরে চীন এবং বিশ্বের অনেক দেশের মধ্যে সরাসরি ফ্লাইট যোগাযোগ দ্রুত সম্প্রসারিত হয়েছে। উহানের এক কোটি দশ লাখ বাসিন্দা এখন সরাসরি ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন গন্তব্যের পাশাপাশি বাড়ির কাছের সিউল, ব্যাঙ্কক, কুয়ালালামপুর ও সিঙ্গাপুরের মতো শহরে যেতে পারে। সে কারণেই ভাইরাসটি চীনের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। ভাইরাসটি যেন ছড়িয়ে না পড়ে সে জন্য চীনের ২০টি শহরে সবধরনের পরিবহন ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এতে ঘরবন্দী রয়েছেন প্রায় ৫ কোটি ৬০ লাখ মানুষ। টানা ১৪ দিন ঘরবন্দী থাকার জন্য নাগরিকদের অনুরোধ করেছে সাংহাই এবং বেজিং শহরের কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি ছয় দিনের মধ্যে উহানে একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল তৈরি করা হবে বলে জানিয়েছে চীন। করোনা ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে চীনের সেনাবাহিনী ৪৫০ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে কাজে নিয়োজিত করেছে। গত শুক্রবার হেলিকপ্টারে করে তাদের হুবেইয়ে নেয়া হয়েছে। গত রবিবার পর্যন্ত চীনে মৃতের সংখ্যা ৫৬-এ পৌঁছেছে এবং সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা ছিল প্রায় ২ হাজার। আক্রান্ত ও মারা যাওয়া অধিকাংশ মানুষ চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরের এবং এর আশপাশের এলাকার। বেশিরভাগ মৃত ব্যক্তি পূর্বে অন্য কোন জটিল রোগে আক্রান্ত ছিল। চীনের নতুন চান্দ্রবর্ষের সাত দিনব্যাপী উৎসব শুরু হয়েছে গত শনিবার। এই উৎসব উপলক্ষে বিভিন্ন এলাকার মানুষ যেমন দূর-দূরান্তের পথ পাড়ি দিয়ে পরিবারের সদস্যদের কাছে যায়, তেমনি অনেকে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু এবারের চিত্র ভিন্ন। করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ফলে দেশটির উৎসব আয়োজন কমিয়ে নেয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে করোনা ভাইরাস। চীনের বাইরে ফ্রান্স, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, নেপাল, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র ও ভিয়েতনামে এই ভাইরাসে সংক্রমিত রোগী শনাক্ত করা গেছে। এই ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগের কারণ হলোÑ সিভিয়ার আকুইট রেসপিরেটরি সিনড্রোমের (সার্স) মতো এই ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ধারণা, ভাইরাসটির উৎস কোন প্রাণী। ধারণা করা হচ্ছে প্রাণীটি সাপ হতে পারে। উহান থেকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্স বিশেষ বিমানে তাদের নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করছে। চীন এই ভাইরাসের বিস্তার রোধে সর্বাত্মক তৎপরতা চালিয়েছে। ৩৮৭টি রেলওয়ে স্টেশনে শনাক্তকরণ কেন্দ্র স্থাপন করেছে। বেশিরভাগ করোনা ভাইরাস বিপজ্জনক নয়, কিন্তু এ ভাইরাস ভাইরাল নিউমোনিয়াকে মহামারীর দিকে ঠেলে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। চীনের প্রধান কয়েকটি পর্যটন এলাকা, যেমন বেজিংয়ের ফরবিডেন সিটি এবং গ্রেট ওয়ালের একাংশ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বাতিল করা হয়েছে দেশের অন্যান্য এলাকায় বড় ধরনের প্রধান প্রধান অনুষ্ঠান। সাংহাইয়ের ডিজনি রিসোর্ট সাময়িকভাবে বন্ধ করা হচ্ছে। পাঁচটি শহরে বন্ধ করা হচ্ছে ম্যাকডোনাল্ডসের রেস্টুরেন্ট। করোনা ভাইরাস একটি আরএনএ (জঘঅ) ভাইরাস যাকে নোবেল করোনা ভাইরাস (২০১৯-হড়া) বলা হয়। যেভাবে বিস্তার ঘটে : মূলত বাতাসে অরৎ ফৎড়ঢ়ষবঃ-এর মাধ্যমে - ১) হাঁচি ও কাশির মাধ্যমে ২) আক্রান্ত ব্যক্তিকে স্পর্শ করলে ৩) ভাইরাস আছে এমন কোন কিছু স্পর্শ করে হাত না ধুয়ে মুখে, নাকে বা চোখে লাগালে ৪) পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার মাধ্যমে। প্রাথমিক উপসর্গসমূহ : ১। জ্বর ২। কাশি ৩। মাথাব্যথা ৪। গলাব্যথা ৫। অজ্ঞান হয়ে যাওয়া। শিশু, বৃদ্ধ ও দুর্বল- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাহীন ব্যক্তিদের নিউমোনিয়া ও ব্রঙ্কাইটিস হতে পারে। এখনও ভ্যাকসিন আবিষ্কার না হওয়ায় বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করাই প্রতিরোধের উপায়। প্রতিরোধের জন্য করণীয় : ১। ভাল করে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে ২। হাঁচি-কাশি দেয়ার সময় মুখ ঢেকে রাখতে হবে ৩। ঠা-া বা ফ্লু আক্রান্ত ব্যক্তির সস্পর্শ থেকে সতর্ক থাকতে হবে ৪। মাংস ডিম খুব ভালভাবে সিদ্ধ করতে হবে ৫। বন্যপ্রাণী বা গৃহপালিত পশুকে খালি হাতে স্পর্শ করা যাবে না ৬। মুখে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে ৭। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। সংক্রমিত হওয়ার ১৪ দিনের মধ্যে এ রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। লক্ষণ দেখা দিলে বাড়িতে বিশ্রাম নিয়ে প্রচুর পানি পান করতে হবে এবং নিকটস্থ হাসপাতালে বা চিকিৎসকদের পরামর্শ নিতে হবে। চিকিৎসা প্রাথমিকভাবে খুব সাধারণ : ১) পর্যাপ্ত বিশ্রাম ২) প্রচুর পানি পান করতে হবে ৩) উপসর্গ অনুযায়ী ওষুধ। আধুনিক বিশ্বে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন রোগ নির্ণয় হবে- এগুলোর নিরাময় আছে, চিকিৎসা আছে, প্রতিরোধ করার ব্যবস্থাও আছে। তাই, আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক থাকি, সুস্থ থাকি এবং নিরাপদ থাকি। বাংলাদেশ সরকার দেশের বিভিন্ন বিমান ও স্থলবন্দরে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্তকরণ ব্যবস্থা নিয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট অধিদফতর, শাখা পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সবাইকে সমম্বিতভাবে এগিয়ে এসে করোনা ভাইরাস রোগকে প্রতিরোধ করা জরুরী। লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×