ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ছয় মাস ১৫ দিনে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩৪৭৮ কোটি টাকা বেশি ঋণ

সরকারের ব্যাংক ঋণ বাড়ছেই

প্রকাশিত: ০৯:৩৬, ২৯ জানুয়ারি ২০২০

সরকারের ব্যাংক ঋণ বাড়ছেই

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ রাজস্ব আদায়ে ভাটা এবং সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়ায় ব্যয় মেটাতে ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর অধিক নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে সরকার। ফলে অর্থবছরের সাড়ে ছয় মাস না যেতেই সরকারের ব্যাংকঋণ অর্ধলাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। গত ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫০ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের পুরো সময়ের লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও তিন হাজার ৪৭৮ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে গত ৯ জানুয়ারি একদিনেই নেয়া হয়েছে রেকর্ড তিন হাজার ৭০৬ কোটি টাকা। গত ১০ বছরের মধ্যে এত বেশি ঋণ নেয়ার নজির এবারই প্রথম। একক কোন অর্থবছরের হিসাবেও এটি সর্বোচ্চ। এদিকে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার অস্বাভাবিক ঋণ নেয়ায় অর্থবছরের মাঝপথে এসেই মুদ্রানীতি সংশোধন করতে বাধ্য হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে আগামী জুন পর্যন্ত ব্যাপক মুদ্রা সরবরাহের (ব্রড মানি) লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১২.৫ শতাংশ। সেটি বাড়িয়ে ১৩ শতাংশ করা হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে মুদ্রানীতি পলিসি কমিটির (এমপিসি) ৪৫তম সভায় এই সংশোধনী আনা হয়। এর ফলে বাজারে অতিরিক্ত আরও ছয় হাজার কোটি টাকার সরবরাহ বাড়বে বলে জানা গেছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বেশি ঋণ নিলে বেসরকারী খাত নিরুৎসাহ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। একই সঙ্গে ঋণের সুদহারও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ জন্য বরাবরই ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে যতটা সম্ভব কম ঋণ নেয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন তারা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সরকারের বাজেটে কোন ভারসাম্য নেই। এর কারণ হচ্ছে, রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধির মাত্রা অনেক কমে গেছে। সঞ্চয়পত্রের বিক্রিও কমে গেছে। ফলে বাধ্য হয়েই সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে। তিনি বলেন, এমনিতেই ব্যাংকগুলো তারল্য সঙ্কটে আছে। তার ওপর সরকার বেশি মাত্রায় ঋণ নিলে বেসরকারী খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি আরও কমে যাবে। এর ফলে বেসরকারী খাতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি ব্যাহত হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরে বেসরকারী খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির আরও অবনতি হয়েছে। গত ডিসেম্বরে এই খাতে বার্ষিক ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ১০ শতাংশ। এটি গত সাত অর্থবছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। সাধারণত অর্থবছরের শুরু ও শেষেরদিকে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারকে বেশি ঋণ নিতে দেখা যায়। কিন্তু এবার অর্থবছরের শুরুতে যেমন বেশি ঋণ নেয়া হয়েছে তেমনি মাঝামাঝি সময়েও প্রায় একই গতিতে ঋণ নেয়া হচ্ছে। অর্থবছরের শেষ সময়েও এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ব্যাংকঋণের এই পরিমাণ একলাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেকেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরে সরকারের ব্যাংকঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা গত ৮ ডিসেম্বরই ছাড়িয়ে যায়। এরপর বেশ কিছুদিন ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার গতি কিছুটা কম ছিল। এখন আবার তা বাড়তে শুরু করেছে। সব মিলে ১ জুলাই থেকে গত ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত (৬ মাস ১৫ দিন) ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেয়া হয়েছে ৫০ হাজার ৮৪২ কোটি ৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে দেশের তফসিলি ব্যাংকগুলো থেকে নেয়া হয়েছে ৪৩ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা। আর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেয়া হয়েছে ৭ হাজার ৩৮১ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের পুরো সময়ে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকার ঋণ নিয়েছিল ২৬ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরে ১৯ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে সরকার নিয়েছিল মাত্র ৯২৬ কোটি টাকা। প্রতিবছরই ঘাটতি বাজেট দিয়ে আসছে সরকার। এবারও বাজেটে প্রায় একলাখ ৪৫ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা ঘাটতি ধরা হয়েছে, যা জিডিপির ৫ শতাংশ। এই ঘাটতি মেটানো হয় অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক খাত ও সঞ্চয়পত্র উল্লেখযোগ্য। এবার ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা, আর সঞ্চয়পত্র থেকে ২৭ হাজার কোটি টাকা। টিআইএন ও ব্যাংক এ্যাকাউন্ট বাধ্যতামূলক করা, মুনাফায় উৎস কর বৃদ্ধি এবং অপ্রদর্শিত অর্থে ক্রয় প্রতিরোধ করাসহ নানা রকম কড়াকড়ি আরোপে সঞ্চয়পত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে মানুষ। সর্বশেষ নবেম্বর মাসে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে মাত্র ৩২০ কোটি টাকা। এটি গত অর্থবছরের একই মাসের চেয়ে প্রায় ৯২ শতাংশ কম। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে পাঁচ হাজার ৮৪১ কোটি টাকা। এটি গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৭৩ শতাংশ কম। এদিকে চলতি অর্থবছরে বৈদেশিক উৎস থেকে অর্থায়ন পাওয়ার আশা করা হয়েছে ৬৮ হাজার ১৬ কোটি টাকা। কিন্তু এখান থেকেও আশানুরূপ ঋণ পাচ্ছে না সরকার। আবার রাজস্ব আদায়েও ভাটা দেখা দিয়েছে। চলতি অর্থবছরের চার মাসে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২০ হাজার কোটি টাকার কম রাজস্ব আদায় হয়েছে।
×