ওয়াজেদ হীরা ॥ উন্নয়নের প্রতিশ্রুতির প্রচারে সরগরম ঢাকা দুই সিটির ভোটের মাঠ। নানাভাবে প্রচার চালাচ্ছেন প্রার্থীরা। ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ভোট চাওয়ার পাশাপাশি ইন্টারনেট ব্যবহার করেও চলছে প্রচার। মেয়র প্রার্থীদের পাশাপাশি ওয়ার্ড কাউন্সিলর, সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থীরাও প্রচার চালাচ্ছেন বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। নতুন ভোটারের বেশিরভাগই তরুণ হওয়ায় দ্রুতই সামাজিক বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে নিজেদের তুলে ধরতে পারছেন প্রার্থীরা। তবে অপপ্রচার ঠেকাতে সাইবার দুনিয়ায় নজরদারি করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
জানা গেছে, প্রতীক বরাদ্দ পাওয়ার পরই গত ১০ জানুয়ারি থেকে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন প্রার্থীরা। ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণের মেয়র প্রার্থীদের পাশাপাশি কাউন্সিলর প্রার্থীরাও প্রচার নিয়ে ব্যস্ত। অলি-গলিতে মাইকে নানা ধরনের প্রচার বা গানের তালে তালে চাওয়া হচ্ছে ভোট। পাশাপাশি ইন্টারনেট ব্যবহার করে ডিজিটাল প্রচারও চলছে সমানতালে। ডিজিটাল প্রচারে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইভার ব্যবহার করা হচ্ছে। নতুন নতুন বিভিন্ন কনটেন্ট ব্যবহার হচ্ছে। কেন একজন প্রার্থীকে ভোট দেবে জনগণ, যোগ্যতা, উন্নয়ন কর্মকা-ের প্রতিশ্রুতিসহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন ভিডিও আপলোড করা হচ্ছে ভার্চুয়াল জগতে। আগামী ১ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন ঘিরে এসব প্রচার হচ্ছে। এছাড়া প্রচারে যুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেও এসব তথ্য জানা গেছে। তথ্যপ্রযুক্তিবিদরা বলছেন, সময় যখন যেভাবে আসে সেই ¯্রােতে সবাই এগিয়ে যায়। সবাই চায় প্রযুক্তি ব্যবহার করতে। সেই কারণে নির্বাচনের প্রার্থীরা প্রচারের বিকল্প মাধ্যম হিসেবে তথ্যপ্রযুক্তিকে বেছে নিয়েছেন।
জানা গেছে, মেয়র প্রার্থীরা যেখানে যাচ্ছেন সেখান থেকে নিজস্ব ফেসবুকের পাশাপাশি কর্মীদের ফেসবুক থেকেও লাইভ প্রচার করা হচ্ছে। নিজেদের প্রচারের সংবাদ বা বিভিন্ন ভিডিও ছবি শেয়ার করা হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে। একজন থেকে শতজন, হাজারজনে পৌঁছে যাচ্ছে নির্বাচনে একজন প্রার্থীর বার্তা। প্রার্থীদের মধ্যে ঢাকা উত্তরে আওয়ামী লীগের আতিকুল ইসলামের রয়েছে ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট, প্রথমবার মেয়র নির্বাচনের সময় সেটি চালু হয়েছিল। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বিএনপির তাবিথ আউয়ালও ব্যক্তিগত ফেসবুক পাতায় সক্রিয় রয়েছেন বিভিন্ন জনসংযোগে সরাসরি সম্প্রচারে। নৌকার প্রার্থী আতিকুল ইসলামের গত নয় মাসের নানা উন্নয়ন কর্মকা- তুলে ধরছে তার প্রচার সেল। পাশাপাশি নির্বাচনী ইশতেহারও তুলে ধরা হচ্ছে। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের নৌকার প্রার্থী আতিকুল ইসলামের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির দফতর সেলের সমন্বয়কারী প্রলয় সমদ্দার বাপ্পি জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের একটি মিডিয়া টিম বিষয়টি নিয়ে কাজ করে। আর অন্যরা আমাদের একনিষ্ঠ কর্মী। তারা আমাদের প্রচারকে বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চায়। ভার্চুয়াল জগতের প্রচার নিয়ে ঢাকা উত্তরে নৌকার প্রার্থীর মিডিয়া সমন্বয়ক জয়দেব নন্দী জনকণ্ঠকে বলেন, একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে ঢাকা শহর বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। এখানে দুই কোটির বেশি মানুষ এই মাধ্যম ব্যবহার করে। যার বেশিরভাগই তরুণ। আমরা তরুণদের সঙ্গে মিশে কাজ করতে চাই। বেশি মানুষের কাছে আমাদের বার্তা দিতে চাই। আমাদের কি লক্ষ্য, কি করব বা গত নয় মাসে আমাদের মেয়র কি করেছেন এই শহরের জন্য তার অন্যতম মাধ্যম এই বিভিন্ন সোশ্যাল নেটওয়ার্ক। প্রচার ক্ষেত্রে ভিডিও, থিম সং, গানের ভিডিও তুলে ধরছি। গণসংযোগের বা জনসমাগমে বক্তব্য আমরা লাইভ করছি। যাতে একজন ভোটার ঘর থেকেও একটি বার্তা পেতে পারে।
তাবিথ আউয়ালকে নিয়েও নিজ দলের কর্মীরা প্রচারে ব্যস্ত। মেয়র হলে কিভাবে ঢাকার উন্নয়ন করা হবে এসব নিয়ে ভিডিওসহ বক্তব্য প্রচারে ফেসবুক ব্যবহার করছেন তাবিথ আউয়ালের কর্মীবাহিনী। নির্বাচনী পোস্টারে চমক হিসেবে কিউআর কোডের ব্যবহার করেছেন উত্তরের মেয়র পদপ্রার্থী তাবিথ আউয়াল। এছাড়া তাবিথ আউয়ালের পোস্টারে রয়েছে ফেসবুক পেজের লিংক। সেখানে রয়েছে তার নির্বাচনী ইশতেহারসহ অনেক কিছু।
এদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপসের ফেসবুক পাতা থেকে প্রচারের বিভিন্ন দৃশ্য তুলে ধরার পাশাপাশি অনলাইন পোস্টার, ভিডিও কনটেন্ট প্রকাশ করা হচ্ছে। তাপসের জীবনী তুলে ধরার পাশাপাশি শর্টফিল্মের আকারে তুলে ধরতে দেখা গেছে তার বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা। মিডিয়া সেলের তারেক শিকদার মনে করেন, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক একজন প্রার্থীর। কে কত বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারল তার বার্তা। কি করবে জনগণের জন্য তার একটি স্পষ্ট ধারণা দিতে পারলে মানুষ যোগ্য প্রার্থী বেছে নেন এবং এসব ক্ষেত্রে নৌকার বিজয় হবে এমন প্রত্যাশা তার। মাঠের প্রচারের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে ভোটারদের কাছে পৌঁছানের চেষ্টা করছেন ঢাকা দক্ষিণে বিএনপি প্রার্থী ইশরাক হোসেন।
ঢাকা দক্ষিণ বিএনপির নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জন্য বিভিন্ন ভিডিও কনটেন্ট আছে। প্রতিদিন প্রচারের অংশ হিসেবে রাতে ভিডিওগুলো আপলোড করা হচ্ছে।
এই প্রজন্মের বেশিরভাগ ভোটার বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবেই নিচ্ছেন। নতুন ভোটার মানে তারুণ্যের কাছে এই সামাজিক মাধ্যমগুলো খুবই সক্রিয়। তারা ঘরে বসেই বা যেখানেই থাকুক একজন প্রার্থীর বার্তা পেয়ে যাচ্ছেন সহজেই। রাজধানীর ঢাকা দক্ষিণের এক তরুণ ভোটার হাসানুল আবির। তিনি বেসরকারী বিশ^বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। নির্বাচন নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে নির্বাচনে আগের সেই মিছিল-মিটিং দরকার নেই। আমাদের এই শহরে এমন সময়ও নেই। প্রার্থীরা নিজেদের মতো উন্নয়ন কিংবা কি করবেন বলে দিচ্ছেন আমরা ঘরে, ক্যাম্পাসে যেখানেই থাকি দেখে নিতে পারছি। এটা কিন্তু ভাল বলেন তিনি। অন্য বন্ধুরাও এসব মাধ্যম ব্যবহার করে প্রচারকে স্বাগত জানান। জিহাদুল জনি এবার প্রথমবারের মতো সিটি কর্পোরেশনে ভোট দেবেন। তিনি বলেন, ওয়ার্ড কাউন্সিলর বাসায় এসেছিল, মেয়রের পক্ষেও ভোট চেয়েছেন। তবে আমি বাসায় ছিলাম না। বাবা-মার কাছে ভোট চেয়েছেন। আমি আমাদের ওয়ার্ডের কে কে কাউন্সিলর না চিনলেও ফেসবুকের কারণে মুখগুলো এখন পরিচিত। তিনি বলেন, কোন প্রার্থী যদি নিজেকে সবখানে উপস্থিত করতে না পারে তবে সে পিছিয়ে পড়বে। তরুণরা আমরা যে মাধ্যমে চলি সেভাবেও যেতে হবে আবার আমাদের অভিভাবকরা যেভাবে অভ্যস্ত সেভাবে যেতে হবে, বলেন তিনি। এক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রচারে যারা এগিয়ে আছে তারা বেশি ভোটরের সঙ্গে সংযুক্ত, বলেন এই তরুণ ভোটার।
ঢাকা উত্তরে সিপিবির প্রার্থী আহাম্মদ সাজেদুল হকের নির্বাচন পরিচালনায় মিডিয়া সেলের প্রধান খান আসাদুজ্জামান মাসুমের তথ্য মতে, সামর্থ্য অনুযায়ী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারের চেষ্টা চালাচ্ছি। প্রার্থীর প্রচারে নানাদিক, আমাদের প্রতিশ্রুতিগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
আইনে এ বিষয়ে কিছু নেই
এদিকে, সনাতন পদ্ধতির ভোটের প্রচার বিষয়ে নির্বাচনী আচরণ বিধিতে স্পষ্ট করা থাকলেও ইন্টারনেটে প্রচারের বিষয়ে কিছু নেই বিধিতে। আচরণবিধিতে তা না থাকায় দ্রুত করণীয় ঠিক করা দরকার বলে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা মত দেন। এ বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। যদিও এর আগে সোশ্যাল মিডিয়া নজরদারির কথা বলেছিলেন ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের রিটার্নিং কর্মকর্তা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও দল নিয়ে বিদ্বেষমূলক ও অপপ্রচার ঠেকাতে বিশেষ নজরদারির কথা বলেছিলেন। সর্বশেষ একাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় অপপ্রচার ঠেকাতে প্রশাসনের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনও সোশ্যাল মিডিয়ায় নজরদারি করে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি সাইবার দুনিয়ায়
এদিকে, দুই সিটির নির্বাচন ঘিরে সাইবার দুনিয়াতে নজরদারি রেখেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নির্বাচনকে সামনে রেখে কোন গোষ্ঠী অথবা কোন ব্যক্তি যাতে উগ্র প্রচার, গুজব ও নাশকতার ছক তৈরি করতে না পারে সেদিকে নজরদারি তাদের। নির্বাচন উপলক্ষে ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, ব্লগ ও ওয়েবসাইট মনিটরিং করা হচ্ছে বলেও জানা গেছে।
ডিএমপির সাইবার সিকিউরিটি এ্যান্ড ক্রাইম বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচন এলেই একটি গ্রুপ মাঠে প্রচারের চাইতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বেশি ব্যবহার করে। ভুয়া পোর্টাল খুলে এবং ফেসবুক আইডির মাধ্যমে তারা দল বা প্রার্থীর পক্ষে প্রচার চালালেও কখনও মিথ্যা তথ্যও ছড়িয়ে দেন। তাদের দেখে অনেকেই উদ্বুদ্ধ হয়। প্রতিপক্ষ প্রার্থীর বিরুদ্ধে বাজে পোস্ট ও কুৎসা রটায়। ভোটারদের কাছে দলের ও প্রার্থীদের ভাবমূর্তি নষ্ট করে। জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করে। এসব মনিটরিং করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে সতর্ক ডিএমপির সাইবার ক্রাইম সেল। ডিএমপির পক্ষ থেকে ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে একটি বার্তা পাঠানো হয়েছে। তারা সাড়া দিয়েছেন। সাড়া দেয়ার বিষয়টিকে কাজে লাগিয়ে সাইবার জগতকে অপরাধ ও নির্বাচনী প্রপাগান্ডা মুক্ত রাখতে উদ্যোগী সংশ্লিষ্টরা। এছাড়াও ডিএমপির পক্ষ থেকে বিটিআরসি’র সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাইবার সিকিউরিটি এ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের ডিসি আফম আল কিবরিয়া জনকণ্ঠকে জানান, নির্বাচন সামনে রেখে সাইবার জগতকে অপব্যবহার থেকে মুক্ত করতে আমরা সক্রিয়। কোন গোষ্ঠী যাতে গুজব তৈরি করে পরিবেশ অস্থিতিশীল করতে না পারে সেদিকে নজরদারি রয়েছে পুলিশের। সাইবার ক্রাইম সেল শাখা সূত্র জানায়, পুলিশ সদর দফতরের সাইবার সেল, ডিএমপির সাইবার ক্রাইম ইউনিট, র্যাবের সাইবার ক্রাইম সেল ২৪ ঘণ্টা মনিটরিং করছে।