ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মমতাজ লতিফ

পূজা নির্বাচন ঢাবি শিক্ষার্থীদের ভূমিকা

প্রকাশিত: ০৯:১৬, ৩০ জানুয়ারি ২০২০

পূজা নির্বাচন ঢাবি শিক্ষার্থীদের ভূমিকা

পূজা, বিশেষ করে সরস্বতী পূজা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এদিকে নির্বাচনের ভোট কেন্দ্র হয়ে থাকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলগুলো নির্বাচন পরিচালনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিয়োজিত থাকেন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকবৃন্দ, কলেজের শিক্ষক এবং ব্যাংক কর্মকর্তা। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সরস্বতী পূজা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক। আবার নির্বাচনের ভোটকেন্দ্রও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক। একই দিনে দুটি অনুষ্ঠান বেশ কিছু স্কুলে সংগঠন করা সম্ভব নয়। অথবা, এটি সমস্যার জন্ম দেবে, কেননা ভোটার সারি এবং পূজা দেয়ার নারী-পুরুষ, তরুণ-তরুণী, শিশু-কিশোরের সারি যে ঝামেলা সৃষ্টি করবে, এতে সন্দেহ নেই। আমরা, সাধারণ জনগণ ভেবেছিলাম, পূজার তারিখ যেহেতু বদলানো সম্ভব না, সেহেতু নির্বাচনের তারিখ বদলানো হবে এবং খুব সম্ভব এটি একদিন এগিয়ে আনা হবে। অর্থাৎ, ঊনত্রিশ তারিখ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে অথবা আটাশে জানুয়ারিও হতে পারে। এ চিন্তার বড় কারণ আমরা মনে করেছি, সারাদেশে ফেব্রুয়ারির ১ তারিখ, এক ফেব্রুয়ারি সংঘটিত হতে যাওয়া এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা এবং এ তারিখটি প্রায় বছরখানেক আগেই নির্ধারিত হয়। পরীক্ষার্থীরা সে তারিখ ধরে প্রস্তুতি গ্রহণ করে। এসএসসি বা স্কুল সমাপনী পরীক্ষা সম্পর্কে আমাদের অনেক বিষয় বিবেচনায় রাখতে হয়। এর অন্যতমটি হচ্ছে, এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র প্রতি গ্রামে থাকে না সে জন্য গ্রামীণ পরীক্ষার্থী, যাদের সংখ্যা লক্ষাধিক হবে, তাদের অনেককেই পরীক্ষা দেয়ার জন্য উপজেলা বা জেলা শহরে পরীক্ষার আগে কোন আত্মীয় বাড়িতে, অধিকাংশকে হোটেল বা মেসবাড়িতে এসে থাকতে হয়। তেমনি অনেক শিক্ষককে, যাদের এসএসসি পরীক্ষার পরিদর্শক বা পরীক্ষা কেন্দ্র প্রধানের দায়িত্ব পালন করতে হয়, তাঁদের অনেককেও পরীক্ষা কেন্দ্রের কাছাকাছি এসে থাকতে হয়। এসএসসি পরীক্ষার্থী কয়েক লাখ, পরীক্ষা কেন্দ্রও অনেক, সংশ্লিষ্ট শিক্ষক সংখ্যাও অনেক বড়। কথা হলো- এরা কমপক্ষে এক মাসের জন্য এই পরীক্ষা দেয়ার ও পরিচালনা করার কাজে নিযুক্ত থাকেন। কয়েক লাখ শিক্ষার্থী জীবনের প্রথম আনুষ্ঠানিক এসএসসি পরীক্ষাটি দেবে। তাদের পরীক্ষার তারিখটি অপরিবর্তিত রাখাই সবার কাম্য ছিল। অথচ নির্বাচন কমিশনের একদিনের নির্বাচনটিকে এসএসসি পরীক্ষার নির্ধারিত তারিখ, অর্থাৎ এক ফেব্রুয়ারিতে নিয়ে আসা একেবারেই ঠিক হয়নি। কেননা, লাখ লাখ শিক্ষার্থীর আগে থেকে নির্ধারিত পরীক্ষাটি পেছানো তাদের অনেকের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। অথচ নির্বাচন এক বা দু’দিন আগে নিয়ে আসলে, এসএসসি পরীক্ষার সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা লাখ লাখ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের রুটিনটি অপরিবর্তিত থাকত। আবারো বলব, এসএসসি পরীক্ষা হচ্ছেÑ প্রায় এক মাসের বা তারও বেশি দিনের কার্যক্রম। তার বিপরীতে নির্বাচনটি একদিনের। এসএসসি পরীক্ষা পেছানোর ফলে এখন নির্বাচন গেল এসএসসি পরীক্ষার পূর্বের তারিখ ১ ফেব্রুয়ারি। এসএসসি পরীক্ষা গেল ৩ ফেব্রুয়ারি। নির্বাচন ১ ফেব্রুয়ারি হওয়ায় বাংলা একাডেমির ফেব্রুয়ারির বই মেলা পিছিয়ে চলে গেল ২ ফেব্রুয়ারি। কবিতা উৎসবও নিশ্চয় ২, ৩ ফেব্রুয়ারি সরে যাবে। নির্বাচনটি এক-দু’দিন আগে আনলে এই সব তারিখ পেছাতে হতো না। এ ধরনের আচরণ দেখে মনে হয়, আমরা অন্যের প্রয়োজনের প্রতি সংবেদনশীল নই। বরং লাখ লাখ কিশোর-কিশোরীর জীবনের প্রথম পরীক্ষা দেয়ার সময়টিকে অপরিবর্তিত রেখে তাদের প্রতি জাতির, নির্বাচন কমিশন এবং বয়স্করা দায়িত্বশীল আচরণের প্রমাণ দিতে পারতাম। এখন আসা যাক, পূজার তারিখ অপরিবর্তিত রাখার দাবিকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, শাহবাগ মোড় আটকে রাখা, অনশন কর্মসূচী প্রসঙ্গে। আমরা মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম যাদের মিছিল, ১৪৪ ধারা ভাঙ্গা, মোনেম খান বিরোধী আন্দোলন, ছয় দফাভিত্তিক আশু স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হওয়া, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী হিসেবে বর্তমানের ঢাবি শিক্ষার্থীদের পূজার পক্ষে আন্দোলন করতে দেখে যে চিন্তা-ভাবনার উদয় হয়েছে, তা হচ্ছেÑ প্রথমেই বলতে হয় আমরা ঢাবি শিক্ষার্থীদের পূজার তারিখ থেকে নির্বাচন সরিয়ে নেয়ার দাবির প্রতি সমর্থন জানাই এবং বর্তমান প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের সংখ্যালঘু হিন্দুদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের প্রতি সংবেদনশীলতা প্রকাশের জন্য আনন্দিত হয়েছি। তবে, কতগুলো প্রশ্নও এ সঙ্গে না উঠে পারে নাÑ প্রথমত, আমার জীবনে এই প্রথম আমি দেখলাম, বারডেম হাসপাতালের পাশ দিয়ে রমনা উদ্যানের দিকে যাওয়ার রাজপথটিও ছাত্রদের বন্ধ করে দেয়া! এমনভাবে জনগণকে কষ্ট দেয়া, রোগী, বৃদ্ধ, শিশু নারীসহ সব বয়সীদের কষ্ট দেয়ার ঘটনা বা আন্দোলন দেখে অসন্তুষ্ট হয়েছি। আমাদের যুগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা স্বাধীনতার যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার সময় জনগণকে, কৃষক শ্রমিককে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সরকার বিরোধী মিছিল, সভা এবং শহীদ মিনারে গণসঙ্গীতের শিহরণ জাগানিয়া সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানই ছিল আন্দোলনের মূল পন্থা। পরবর্তীকালে, ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চ সৃষ্টি হওয়ার পর তরুণ প্রজন্ম শাহবাগ মোড় বন্ধ করে। তবে এই গণজাগরণ মঞ্চ কাঁধে তুলে নিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের অসম্পন্ন কাজ- ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও সর্বোচ্চ দ-ের দাবিকে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার কাজ, যা আমাদের, যারা ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতা হত্যার পর জিয়া কর্তৃক ওই খুনীদের বিচার বন্ধ করার লক্ষ্যে ইনডেমনিটি বিল জারি করা এবং বঙ্গবন্ধু কর্তৃক গঠিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ট্রাইব্যুনালগুলো বন্ধ করে গ্রেফতারকৃত এগারো হাজার যুদ্ধাপরাধীকে মুক্তি দেয়ার ফলে যখন উপলব্ধি করেছিলাম বঙ্গবন্ধুর খুনীরা, ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীরা মুক্ত থাকবে, তাদের বিচার করা সম্ভব হবে না। বরং তারা সরকারের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চর্চা করবে এবং ধন-সম্পদে সমাজে উচ্চবিত্তের মানুষে পরিণত হবে। সেটিই ঘটেছিল! যেটি ২০০৮-এ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী দলের মহাজোট তৈরি হয়ে নির্বাচনে বিজয় অর্জন করে এবং তাদের ম্যানিফেস্টোতে প্রদত্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে তরুণ প্রজন্ম বিপুল ভোট দেয়ার ফলে ২০১০ সালে মহাজোট সরকার ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য দুটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে। গণজাগরণ মঞ্চের প্রভাবক ভূমিকাটির ফলে সারাদেশে সব জেলায় গণজাগরণ মঞ্চ গড়ে ওঠে এবং যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ দ- অর্থাৎ ফাঁসির দাবিটি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এ কারণে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দ- প্রদান সম্ভব হয়। যেহেতু পুরো দেশের তরুণ প্রজন্ম ফাঁসির দাবিতে সোচ্চার হয়েছিল! এটি বাংলাদেশের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া একটি মাইফলক অর্জন। এটি তরুণদের সৃষ্টি, যেটি বাংলাদেশের ইতিহাসে স্থায়ী স্থান লাভ করবে। বলা বাহুল্য, তরুণ প্রজন্মকে আমরা অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণের কারিগর হিসেবে দেখতে চাই। তরুণ সমাজ যুগে যুগে বৈষম্যের বাধা ভেঙ্গে এগিয়েছে। সে কারণে, বর্তমানের ঢাবি শিক্ষার্থী এবং সারাদেশের তরুণ প্রজন্মকে শুধু পূজার তারিখ রক্ষার আন্দোলন করে তাদের অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষের কার্যক্রম শেষ করা সম্ভব হবে না। তাদের উপলব্ধি করতে হবেÑ ১. কেন গ্রাম-গঞ্জে হিন্দু বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভূমি, বসতঘর, জীবিকার উৎস ক্ষমতাশালীরা জবর দখল করে? তাদের স্ব-স্ব গ্রামে শক্তভাবে হিন্দু ও ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর ভূমি, বসত, জীবিকা রক্ষার্থে আন্দোলন, কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ২. তাদের হিন্দু, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বালিকা, তরুণী নারীদের সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর হাত থেকে রক্ষা করতে তরুণদের ঐক্যবদ্ধ করে কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। কোথাও হিন্দু, মুসলমান, বালিকা-নারী ধর্ষিত হলে ধর্ষককে আটক করা এবং ধর্ষণের দ--ফাঁসির দাবি জানাতে হবে এবং ধর্ষণকে অজামিনযোগ্য অপরাধ গণ্য করার দাবি করতে হবে। ৩. হিন্দু পরিবারে পুত্র-সন্তানদের রক্ষা করাও একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ। কেননা, হিন্দুর জমি, বসত, জীবিকা দখলের জন্য সংখ্যাগুরু মুসলিম ক্ষমতাবান লোভী মানুষের সহজ টার্গেট হয়েছে হিন্দু পুত্র-সন্তান! এমন কি মুসলিম সহপাঠীর সঙ্গে খেলতে গিয়ে ব্যাটের বা হাতুড়ির আঘাতে প্রাণ হারিয়েছে একমাত্র সন্তানÑ এমন উদাহরণ আমাদের অনেকবার ব্যথিত করেছে। ঢাবি শিক্ষার্থীসহ তরুণদের বলব- ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিদারাবাদ হত্যাকা- এবং পাবনার শিশু অর্ণব হত্যাকা-, দুটি ভালভাবে জেনে এই চরম বর্বর অমানবিক অপরাধ রোধ করার উদ্যোগ ও উপযুক্ত কার্যক্রম গ্রহণ করলে তাদের সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী অবস্থান স্পষ্ট ও কার্যকর হবে। ইতিহাসের ’৪৭-এর পাটিশানের ফলাফল লাখ লাখ হিন্দ, মুসলমানের রক্তগঙ্গা ও মাতৃভূমি ত্যাগের ঘটনা তরুণ প্রজন্মকে জানতে হবে। নতুবা তাদের মনে, হৃদয়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনা, প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারা অসম্ভব হয়ে থাকবে, যা সমাজকে উন্নয়নশীল দেশের উপযোগী হতে দেবে না। তরুণদের নিজেদেরও মানবতাবাদী হয়ে উঠতে দেবে না। এসব একদিন বা কয়েকদিনের আন্দোলনে অর্জনের বিষয় নয়। তরুণরা সমাজ বদলের প্রধান নায়ক। তাদের এই কাজগুলো করতে হবে, যা প্রকৃত অর্থেই তরুণ প্রজন্মের কাজ বা দায়িত্ব। লেখক : শিক্ষাবিদ
×