ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

দেশে ফিরতে নারাজ

রোহিঙ্গাদের মনোভাব এখনও নেতিবাচক

প্রকাশিত: ০৯:৩৫, ৩০ জানুয়ারি ২০২০

রোহিঙ্গাদের মনোভাব এখনও নেতিবাচক

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ বাংলাদেশের আশ্রয় দান, বিভিন্ন দেশের সমর্থন লাভ, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার জোরালো ভূমিকা এবং সর্বশেষ ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে) এর পক্ষে মিয়ানমারের প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ প্রদানের ঘটনা নিয়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যরা উল্লসিত। কিন্তু নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার প্রশ্নে এরা এখনও নেতিবাচক মনোভাবে রয়েছে। এর নেপথ্যের কারণ মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা এখনও সম্পূর্ণভাবে নিরাপদ নয়। এর পাশাপাশি আশ্রয়দাতা দেশ বাংলাদেশে মাথা গোঁজার ঠাঁই নিয়মিত পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী প্রাপ্তি এবং প্রাণ নিয়ে বেঁচে থাকার যে নিশ্চয়তা পেয়ে যাচ্ছে এতে করে মূলত তারা সহজে এদেশ ছাড়তে এ মুহূর্তে অন্তত রাজি নয়। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়ার পক্ষে দায়েরকৃত মামলার বিপরীতে গত ২৩ জানুয়ারি আইসিজে চার দফা দিকনির্দেশনা নিয়ে যে অন্তর্বর্তীকালীন রায় প্রদান করেছে তা বিশ^জুড়ে সমাদৃত হয়েছে। জাতিসংঘের পক্ষে ইতোমধ্যে বলা হয়েছে আন্তর্জাতিক এই আদালতের আদেশ মানার জন্য প্রয়োজনে বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করা হবে। যদিও সেখানে বিশ^শক্তি চীনের এই ইস্যুতে ভেটো প্রদানের বিষয়টি অনেকটা নিশ্চিত। এরপরও বিশে^র বিভিন্ন দেশে দেশে উদ্বাস্তু হয়ে থাকা রোহিঙ্গারা বিশ^ব্যাপী যে সমর্থন কুড়িয়েছে তাতে তাদের সমস্যা সমাধানে বড় ধরনের ইতিবাচক ভূমিকা যে পালন করবে তা নিশ্চিত। এক্ষেত্রে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ বাংলাদেশ। ১৯৮৭ সাল থেকে ছোট-বড় বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে আসছে। সবচেয়ে বড় ঢলটি এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট গভীর রাতে সে দেশে সেনা অভিযান শুরু হওয়ার পর। এ অভিযানে শত শত রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। অসংখ্য নারী ও যুবতী ধর্ষিত হয়েছে। একের পর এক রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে এসব গ্রামের নাম নিশানা মুছে ফেলতে বুলডোজার দিয়ে মাটি চাপা দেয়া হয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে নতুন ও পুরনো মিলিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বেসরকারীভাবে প্রায় ১৩ লাখ। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার ঘটনায় সরকার পক্ষে যে নিবন্ধন কার্যক্রম চলেছে তাতে নিবন্ধিতদের সংখ্যা ১১ লাখেরও বেশি। এর মধ্যে এসব রোহিঙ্গার পরিবারে জন্ম নিয়েছে হাজার হাজার নতুন শিশু এবং তা অব্যাহত রয়েছে। উখিয়া-টেকনাফের ৩২ আশ্রয় শিবিরে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া হলেও দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আরও বিপুলসংখ্যক। পুরনো যারা রয়েছে এদের অধিকাংশ নানা কৌশলে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব এবং এনআইডি কার্ডও হাতিয়ে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, নতুন রোহিঙ্গাদের অনেকে এ তৎপরতায় লিপ্ত। একেবারে কাছের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার। এছাড়া টেকনাফের নাফনদী পেরুলেই মিয়ানমার। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে এই দুই দেশের মানুষের মধ্যে বাণিজ্যিকসহ বিভিন্ন কর্মকা- চলে আসছে। আইসিজে’র ৪ দফা নির্দেশনা সম্বলিত আদেশ মিয়ানমার সরকার গত ২৩ জানুয়ারি রাতেই প্রত্যাখ্যান করেছে। ফলে ইতোমধ্যে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে, আইসিজে’র নির্দেশাবলী মিয়ানমার মানতে বাধ্য কিনা। আর না মানলে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নেয়া যায়। ইতোমধ্যে বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহলের পক্ষ থেকে বক্তব্য দেয়া হয়েছে মিয়ানমার আন্তর্জাতিক এই আদালতের আদেশ মানতে বাধ্য। আবার অনেকে মত দিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন এই আদেশ না মানলে বিষয়টি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করা হবে। এখানে প্রশ্ন জেগেছে বহু আগে থেকে মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা নির্যাতিত ও নিপীড়িত হয়ে আসছে। কথায় কথায় অনেকের প্রাণ সংহারও হয়েছে। তবে ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের রাত থেকে যা ঘটেছে তা রেকর্ড গড়েছে। জাতিসংঘ বিভিন্ন সংস্থাসহ, বিভিন্ন দেশ রাখাইন রাজ্যে গণহত্যার অভিযোগ এনেছে। স্যাটেলাইটে ধারণকৃত ঘটনার রেকর্ড নিয়ে প্রমাণ উত্থাপন করা হয়েছে গণহত্যা ও গণকবরের ঘটনার। এরপরও আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমার পক্ষে সেদেশের স্টেট কাউন্সিলর আউং সান সুচি সেনা নির্যাতনের ঘটনা স্বীকার করলেও গণহত্যার ঘটনা সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেছেন। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে শুনানিতে গাম্বিয়ার পক্ষে যখন মিয়ানমারে ঘটে যাওয়ার ঘটনা তথ্য উপস্থাপন করছিল তখন সুচিকে কখনও সোজা সামনে তাকিয়ে, কখনও মাটির দিকে তাকিয়ে আবার কখনও বাদীপক্ষের বক্তব্য শুনতে দেখা যায়। রোহিঙ্গাদের ওপর সেদেশের সামরিক বাহিনী নৃশংসতার বিভিন্ন ঘটনা যখন তুলে ধরা হয় তখন সুচি পাথরের মতো মুখ করে বসেছিলেন বলেও বার্তা সংস্থাসমূহে তথ্য দেয়া হয়। গাম্বিয়ার বক্তব্যের পর সুচি যখন আত্মপক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য দেন তখন তিনি গণহত্যার অভিযোগ সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করে এসেছেন। গাম্বিয়ার দাবি ১৯৯১ সালের জেনোসাইড সনদ লঙ্ঘন করেছে মিয়ানমার। যে জেনোসাইড সনদ ১৯৫৬ সালে মিয়ানমার (তৎকালীন বার্মা) অনুমোদন করেছে। এদিকে, আন্তর্জাতিক আদালতের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশদানের মাত্র দুদিন আগে মিয়ানমারের ইন্ডিপেনডেন্ট কমিটি অব ইনকোয়ারি (আইসিওই) নিজ দেশের স্বার্থ রক্ষা গড়ে একটি রিপোর্ট সেদেশের প্রেসিডেন্টের কাছে পেশ করে। বিষয়টি আন্তর্জাতিক আদালতকে প্রভাবিত করার একটি অপপ্রয়াস হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। যা হোক ১৭ সদস্যের আন্তর্জাতিক এই আদালত সর্বসম্মতভাবে অন্তর্বর্তীকালীন যে রায় দিয়েছে তা নির্যাতিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যদের পক্ষে এসেছে। মূল রায়ের জন্য কয়েক বছর অপেক্ষায় থাকতে হবে রোহিঙ্গাদের। সঙ্গে বিশে^র বিভিন্ন মহলকেও। আইসিজে’র পক্ষ থেকে যে অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দেয়া হয়েছে সেদিন উখিয়া-টেকনাফে রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরগুলোতে দোয়া ও মোনাজাত হয়েছে। বিশ^ আদালতের পক্ষে এমন একটি অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ আসার পর রোহিঙ্গারা যে খুশি হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রত্যাবাসন প্রশ্নে এদের মনোভাব এখনও নেতিবাচক। অর্থাৎ তারা এ মুহূর্তে নিজ দেশে ফিরে যেতে অনাগ্রহী। যারা যেতে ইচ্ছুক তারাও অনাগ্রহীদের চাপের মুখে প্রত্যাবাসনের নাম আনতে অপারগ। প্রশ্নের পর প্রশ্ন উঠছে রোহিঙ্গারা কবে এদেশ ছাড়বে। এ প্রশ্নের উত্তর কোন মহলের পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। কেন না, বিষয়টি এখন আন্তর্জাতিক আদালতে। বিচারাধীন অন্তর্বর্তীকালীন আদেশে যা বলা হয়েছে তা মিয়ানমারে এখনও বসবাসরত রোহিঙ্গাদের স্বার্থ রক্ষায় দেয়া হয়েছে। এ আদেশে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য কোন কথা নেই। কারণ বাদী দেশ গাম্বিয়ার পক্ষে এদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য কোন অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ প্রার্থনাও করা হয়নি। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে থাকা যেমন নিরাপদ, তেমনি বাংলাদেশ ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করে অন্যদেশে চলে যাওয়ার বিষয়টিও তাদের কাছে আকর্ষণের একটি বিষয়। এছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেসব রোহিঙ্গা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে তাদের অনেকের আত্মীয়স্বজন বর্তমানে উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় শিবিরে অবস্থান করছে। এ পর্যন্ত পর্যবেক্ষণে এটাই নিশ্চিত হয়েছে রোহিঙ্গারা বর্তমানে প্রত্যাবাসিত হওয়ার পক্ষে নয়। বহুবিধ কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাংলাদেশে আশ্রিত অবস্থায় নিশ্চিত জীবন অতিবাহিত করা।
×