ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বোরহান বিশ্বাস

অভিমত ॥ ভোটার উপস্থিতি কম দায় কার?

প্রকাশিত: ১১:৪৩, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২০

অভিমত ॥ ভোটার উপস্থিতি কম দায় কার?

সদ্য সমাপ্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ঢাকা দক্ষিণের ১নং ওয়ার্ডে খুব কাছ থেকে নির্বাচন প্রত্যক্ষ করেছি। আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর নেতা-কর্মীদের দেখেছি হাতে লিফলেট নিয়ে ডোর টু ডোর গিয়েছেন। এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠ, তরুণ-তরুণী যাদের সঙ্গেই দেখা হয়েছে ভোট প্রার্থনা করেছেন। ভোট দেয়ার যৌক্তিকতা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। সর্বশেষ ভোটের দিন সকালের শীত উপেক্ষা করে ভোটার আনতে আবারও পরিচিতদের বাসার সামনে উপস্থিত হয়েছেন। কেউ কেউ ভোট দিতে অনুৎসাহিত ছিলেন। তাদের বুঝিয়ে, অনুরোধ করে ভোট কেন্দ্রে নিয়ে এসেছেন। পছন্দের প্রার্থীকে জয়ী করতে নিষ্ঠার সঙ্গে যারা শ্রম দিয়েছেন, তার প্রমাণও তারা পেয়েছেন জয়ী হওয়ার মধ্য দিয়ে। বিএনপির মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের কর্মী, সমর্থকরাও নির্বাচনের আগে মাঠে ছিলেন। ভোটের আগের দিন রাতে ঘুণাক্ষরের ভাবা যায়নি এভাবে তারা মাঠ ছেড়ে যাবেন। আবার কোন অপ্রীতিকর ঘটনার খবরও পাওয়া যায়নি। সুতরাং হাড্ডাহাড্ডি একটি লড়াই হবে ভেবে ১ তারিখ সকালে ভোট কেন্দ্রে উপস্থিত হই। কিন্তু বেলা বাড়লেও ভোটারদের উপস্থিতি না বাড়ায় হতাশ হয়েছি। আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সাধ্যমতো ভোটার নিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন। এক্ষেত্রে বিএনপি কর্মীদের একেবারেই নিষ্ক্রিয় মনে হয়েছে। তারা কি আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন যে, ওইদিন কোন কাজ করবেন না! সার্বিক অবস্থা দেখে মনে হয়েছে, বিএনপির কর্মী, ভোটার, সমর্থকরা দ্বিধার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন। প্রচারণায় যে পরিমাণ লোকের সমাগম হয়েছিল, ভোটের দিন তাদের ছিটেফোঁটারও দেখা মেলেনি। কোথায় গিয়েছিলেন তারা। আমি খিলগাঁওয়ের যে এলাকায় থাকি এটা বিএনপি অধ্যুষিত এলাকা। নিশ্চিত হয়েছি, এখানকার একটি সেন্টার থেকে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে ইশরাক হোসেন জয়ী হয়েছেন। প্রচারণায় সরগরম থাকলেও ভোটের মাঠে বিএনপির এমন করুণ অবস্থা কেন? তাই নিয়েই এখন চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছেÑ টানা ২১ দিন প্রচারণার চালানোর পর ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটিতে প্রচারবিহীন দিন ভোটের আগের দিন, শুক্রবার। তবে বসে ছিলেন না বিএনপির মেয়র প্রার্থীরা। ওইদিন বিএনপির দুই মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল ও ইশরাক হোসেন দলীয় নেতাকর্মী ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের সঙ্গে ব্যস্ত সময় পার করেন। নিজ নিজ নির্বাচনী কার্যালয়ে দফায় দফায় বৈঠক করে সর্বশেষ প্রস্তুতি নিয়ে নানা দিকনির্দেশনা দেন তারা দুজন। গণমাধ্যমের সামনে ইশরাক বলেন, ভোটাররা নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে যাবেন। কেন্দ্র দখল নয়, ভোটাররা যাতে নির্বিঘেœ ভোট দিতে পারেন, সে জন্য আমরা ভোট কেন্দ্র পাহারা দেব। একই সময় তাবিথ আউয়াল সব ধরনের বাধাবিপত্তি, ভয়ভীতি উপেক্ষা করে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে নগরবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। কিন্তু দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা নির্বাচন নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্কিত কথা বলে আসছিলেন। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, তারা যে ইভিএমের মাধ্যমে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে যাচ্ছে সেটি একটি অপকৌশল বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়ার। জনগণের রায় কখনও ইভিএমের মাধ্যমে প্রকাশ হবে না। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর মন্তব্য, নীরবে, নিঃশব্দে জনগণের ভোটাধিকার হরণের অপর নাম ইভিএম। সারা বিশ্বে বাতিল হওয়া ভোটাধিকার হরণের যন্ত্র ইভিএম। ভোট করার পথ থেকে সরে আসার জন্য তিনি নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রতি আহ্বান জানান। তিনি আরও বলেন, ইভিএমে আপনি যাকেই ভোট দেন তা চলে যাবে নৌকায়। এতে ভীত হয়েছে বিএনপির সমর্থকরা। তারা ভেবেছে এমন যদি হয় তবে ভোট না দেয়াই ভাল। তরুণ এবং জ্যেষ্ঠ নেতাদের বক্তব্যে যে মতবিরোধ ছিল, তা নির্বাচনের দিন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। জ্যেষ্ঠরা একদিকে সরকার, ইসি ও ইভিএমের কঠোর সমালোচনা করছেন আবার নির্বাচনেও অংশ নিচ্ছেন। এমন দোদুল্যমানতায় সমর্থকরা যাবেন কোথায়? ভোটাররা কেন্দ্রে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেবেন কি করে? হরতাল ডেকে তারা যেমন ঘরে বসে থাকেন, এবারো তেমন ঘটনা প্রত্যক্ষ করল নগরবাসী। হরতালও ভোটের মাঠে বড় নেতাদের উপস্থিতি একেবারেই ছিল না। কর্মীরা সাহস পাবে কোথা থেকে? ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের অনেক ভোটারও ভোট দিতে যাননি। এ নিয়েও চলছে নানা বিশ্লেষণ। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দলের ভোটার উপস্থিতি কম হওয়াকে গণতন্ত্রের জন্য শুভ নয় বলে অভিহিত করেছেন। অবশ্য তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগের জয় হয়েছে বলে মনে করেন। তার মতে, ঢাকায় তিন কারণে ভোটাররা ভোট দিতে যাননি। প্রথমত তিন দিনের টানা ছুটি, দ্বিতীয়ত ইভিএম নিয়ে বিএনপির নেতিবাচক প্রচারণা এবং নির্বাচনকে তাদের আন্দোলনের অংশ হিসেবে নেয়া। এবার দেখা যাক ভোটের সামগ্রিক চিত্র। উত্তর সিটিতে এবার ভোট পড়েছে ২৫ দশমিক ৩০, আর দক্ষিণে ২৯ দশমিক ০.২ শতাংশ। অর্থাৎ দুই সিটিতে ২৭ দশমিক ১৫ শতাংশ ভোট পড়েছে। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে মোট ভোটার ৫৪ লাখের বেশি। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের উত্তর ও দক্ষিণের মেয়র প্রার্থীরা ভোট পেয়েছেন ৮ লাখ ৭১ হাজার। ভোট পড়েছে সাড়ে ১৪ লাখের বেশি। সেই হিসেবে প্রদত্ত ভোটের ৫৯ শতাংশ পেয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বিএনপির দুই মেয়র প্রার্থী ৫ লাখ ৬৭৩ ভোট পেয়েছেন, যা প্রদত্ত ভোটের ৩৫ শতাংশ। স্বৈরাচার পতনের পর গণতন্ত্রের নবযাত্রায় পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে প্রায় অর্ধেক মানুষই ভোট কেন্দ্রে যাননি অথবা ভোটাধিকার প্রয়োগ করেননি। ওই সময় ভোট পড়েছিল ৫৫ দশমিক ৪ শতাংশ, সপ্তম সংসদ নির্বাচনে ৭৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ, অষ্টম সংসদ নির্বাচনে ৭৫ শতাংশ, ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোট পড়ে। এ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ৮৭ শতাংশ ভোট পড়ে। দশম সংসদ নির্বাচনে প্রায় ৪০ শতাংশ ভোট পড়ে। সর্বশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শতকরা ৮০ ভাগ ভোট পড়ে। প্রায় প্রতিটি নির্বাচনের পরেই দেখা গেছে, ভোটার উপস্থিতি বেশি হলেও সেটা নিয়ে কথা উঠেছে, আবার কম হলেও মুখরোচক আলোচনা হয়েছে। ২০০২ সালে অনুষ্ঠিত অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপির সাদেক হোসেন খোকা মেয়র হন। তখনকার নির্বাচন কমিশনারের দাবি ছিল- নির্বাচনে প্রায় ৩০ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছেন। ওই ৩০ ভাগ ভোটারের উপস্থিতি মেনে নিয়েই তিনি মেয়রের দায়িত্বভার নেন। পরবর্তী সময় অনেকেই সাদেক হোসেন খোকাকে সফল সিটি মেয়রের তকমা দিয়েছেন। ২০১৫ সালে প্রথমবারের মতো দুই সিটির নির্বাচনে ঢাকা উত্তরে আনিসুল হক ৪ লাখ ৬০ হাজার ১১৭ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম পরাজিত প্রার্থী তাবিথ পেয়েছিলেন ৩ লাখ ২৫ হাজার ৮০ ভোট পান। ঢাকা দক্ষিণে মোহাম্মদ সাঈদ খোকন ৫ লাখ ৩৫ হাজার ২৯৬ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী মির্জা আব্বাস পেয়েছেন ২ লাখ ৯৪ হাজার ২৯১ ভোট। ওই নির্বাচন নিয়ে যারা কথা তুলেছিলেন, তাদের অনেকেই পরবর্তী সময় আনিসুল হকের নামের আগে ‘কিংবদন্তি’ জুড়ে দিয়েছেন। ২০১৪ সালে নির্বাচনে অংশ না নিয়ে এর আগে বিএনপি যে ভুল করেছিল, এবার হাফ নির্বাচন করে সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি করল। তাদের সমর্থক ও ভোটাররা মুখিয়ে ছিলেন ভোট দেয়ার জন্য। কিন্তু দলীয় সিদ্ধান্তহীনতায় তারা সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। যারা সাহস করে ভোট দিয়েছেন তারা ইভিএম পদ্ধতি খুবই এনজয় করেছেন। এবার আর চিরাচরিত ব্যালট পেপার ছিনতাই হওয়ার ছবি কোথাও দেখা যায়নি। আমরা শুধু উত্তর আর দক্ষিণের মেয়রের হিসাবই কষছি। দুই সিটির নির্বাচিত কাউন্সিলর প্রার্থীদের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীরা কে কত ভোট পেয়েছেন, তার হিসেব কেন প্রকাশ করছি না। পছন্দের প্রার্থীকে জয়ী করতে অনেক নীরব ভোট পড়েছে তার হিসাব কেন আমরা জানব না? ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ায় তুলনামূলকভাবে আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপিরই বেশি ক্ষতি হয়েছে। সেটি বিএনপির ভোটার, সমর্থকরা ভেতরে ভেতরে ঠিকই বুঝতে পারছেন। আওয়ামী লীগ আন্দোলনমুখী দল। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বাতিল করতে বিএনপিকে বাধ্য করেছিল তারা। সেদিন সারাদেশে ভোট পড়েছিল মাত্র ২১ ভাগ। বিএনপি এখন বলছে নির্বাচন সঠিক হয়নি। কিন্তু তারা কি আন্দোলন করে কিছু করতে পারবে? যদিও তাদের রয়েছে বিপুল সংখ্যক সমর্থক। তবে নেই সাংগঠনিক সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও কর্মসূচী। আর তাকে এগিয়ে নেয়ার জন্য ত্যাগের মনোভাব। হরতাল ডেকে যারা ঘরে বসে থাকে তারাই নির্বাচনে অংশ নেয়ার কথা বলে ১ তারিখ নির্বাচনের মাঠে ছিলেন না। লেখক : সাংবাদিক
×