ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দেখো ঋতুরাজের লাস্যময়ী রূপ

প্রকাশিত: ১০:৩৮, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০

দেখো ঋতুরাজের লাস্যময়ী রূপ

ফাগুনের আগমনী বার্তা প্রকৃতিতে। গাছের ডালে ডালে লাল আগুনরাঙা শিমুল ফুল ফুটতে শুরু করেছে। শিমুল ফুলের সৌন্দর্য আর মধুর লোভে শিমুলের ডালে পাখির আনাগোনা বেড়েছে। বসন্ত হাজির হয়েছে তার মনোমুগ্ধকর রূপ নিয়ে। তাই হিম কনকনে অলসতা ভেঙ্গে জেগে উঠেছে প্রকৃতি। শীতের তীব্র অনুতাপ ঝেড়ে ফেলে স্বরূপে ফিরেছে পাতাঝড়া গাছগুলো। বনবাদাড়ে পড়ে থাকা নির্জীব শুকনো পাতারা আহ্বান করছে পাতাকুড়ানিজনে। বৃক্ষতলে জমাটবাঁধা শুষ্কপাতার মড়মড় আওয়াজ যেন বলছে- নাও কুড়িয়ে, দাও ভরিয়ে; পত্রপুষ্পে রঙছটা ছড়িয়ে। শুকনো পাতার এ আমন্ত্রণী কথা ঋতুরাজ বসন্তের আগাম বার্তা দিয়ে গেছে বেশ কিছুদিন আগেই। পুরো বছরের উৎসবহীন নিরানন্দ আমেজ ভুলে বাতায়নবর্তিনী প্রকৃতিকন্যা উঁকি মেরে কুহুতানে মেতে ওঠার হর্ষিত ডানায় ভেসে বেড়ানোর উপলক্ষ খুঁজে পেয়েছে। বসন্তবাহী কোকিলের অবিরাম কুহুতান বাংলার অপরূপ সজ্জিত অবয়বে লাগিয়েছে মুগ্ধতার অতল অলঙ্কারবিশেষ। বসন্ত এসেছে আবারও মনমোহিনী মুগ্ধতা ছড়িয়ে। চারপাশে তার বহ্নিবরণ আবেশ আর সুললিত মূর্ছনা টের পাওয়া যাচ্ছে। গাছে গাছে সবুজ কিশলয়, কৃষ্ণচূড়া-শিমুল-পলাশের আগুনে রং, শালিক-টিয়ে-বুলবুলি বিহঙ্গদলের ফুলে ফুলে ওড়াউড়ি তৃপ্ত বাহাস, সর্বত্র সুমধুর কলতান, গাঢ় সবুজ ফসলি ভূমে সারি সারি ধানের হুমড়ি খাওয়া উল্লসিত উন্মাদনা, রং-বেরঙের প্রজাপতি-ফড়িংয়ের নাচানাচি ও প্রকৃতির বাহারি বৈচিত্র্যময় বসন্তের জমজমাট আয়োজন পরিলক্ষিত হচ্ছে। যেন রূপের আগুনে পুড়ছে ঋতুরাজ বসন্ত। উত্তরের বহতা বাতাস আর হাড়কাঁপানি হিম জীর্ণতা দূর করে বসন্ত বাংলা জমিনে হাজির হয়েছে তার রূপযৌবনের ষোলোআনা অনুষঙ্গ আর দখিনা হাওয়ায় ভর করে। বসন্তের এই মনোরম মাধুর্য পেয়ে প্রকৃতি আজ বড্ড উতলা। মাঠে-ঘাটে, পথে-রথে, বনে-মনে, বৃক্ষে-অন্তরীক্ষে, ঘরে-বাইরেÑ সবখানেই বসন্তের বিমোহিত সুর বেজে উঠেছে। উৎসবের উত্তরীয় বসনে রঙিন বসন্ত আমেজ জাপটে ধরেছে শহরের ব্যস্ত জীবন থেকে গ্রামের মুক্ত জীবন ও পক্ষীপবন তরুলতাকে। প্রকৃতির পরতে পরতে যেমন লেগেছে বসন্তের উন্মত্ত ছোঁয়া তেমনি মানুষের দেহ-মনে লেগেছে বসন্ত রং। বিশেষ করে বাংলার সদ্যযৌবনা কিশোরী, যৌবনে টইটম্বুর যৈবতীকন্যা ও নববধূ অহল্যা এবং দাম্পত্যে দীর্ঘ পথচলা কান্তা-কামিনীদের কোমল কায়ায় লেগেছে বসন্তের বহুরূপী রং। বসন্তের প্রথম দিনটিতে তারা সেজেছে বসন্ত ভূষণে। মাথায় পুষ্পটোপর, কানে দোল কুসুমকলি, গলে ফুলের মালা, হাতে রঙিন চুড়ি, অঙ্গে বাসন্তী সফেদ লাল পাড়ের শাড়ি জড়িয়ে কপালে লাল ফোঁটা আর কপুলে বসন্ত বরণের আল্পনা এঁকে ঋতুরাজের লাস্যময়ী রূপ নিজেদের করে নেয়ার এক মহোৎসবে মেতে উঠেছে বাংলার ললিত-ললনা দল। শহরের বদ্ধ পরিবেশে হাঁপিয়ে ওঠা জীবনকে চাঙ্গা করতে বসন্ত বরণের প্রথম দিনটি স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকা এবং সখী ষোড়শী দলের কাছে হয়ে ওঠে বাঁধভাঙা উদযাপনী রঙিন মুহূর্ত। তবে এক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম গ্রামের বসন্ত বরণের দৃশ্যপট। গ্রামের মেয়েরা শহরের মতো এভাবে সেজেগুজে মুক্ত বিহঙ্গের মতো দিগি¦দিক ছোটাছুটি করে না। মহল্লার মুক্ত উঠোনে তারা বসন্তের প্রকৃত রূপ আস্বাদন করে প্রাণ খোলে। গাঁয়ের কুমারীকন্যারা কোকিলের বিরামহীন কুহুতানে যেমন দিয়ে যায় নিজেদের কণ্ঠশাণ তেমনি গ্রহণ করে বসন্ত প্রকৃতির রূপাঙ্গনে মাথা গুঁজে স্থান করার পরিতৃপ্তিবোধ। চারপাশে বসন্তের বহ্নিশিখা উদ্গিরিত হচ্ছে। সবুজের বুকে জ্বলে উঠেছে হলুদ হর্ষিত অনল। পল্লীপ্রান্তের বিস্তীর্ণ ভূমে সরষের হলদে বিচ্ছুরণ সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছে বসন্ত দামামা। কখনও কৃষ্ণচূড়ার রক্তিম আভা শহীদানের বীরত্ব ভাব ফুটিয়ে তুলেছে। কখনও শিমুল-পলাশের উষ্ণ রং বসন্তের ক্ষুধা নিবারণের ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া বসন্তবিহঙ্গী কোকিলের কুহুকীর্তন মাতিয়ে রাখছে বসন্তের ভরদুপুর। রূপের আগুনে জ্বলসে ওঠা ঋতুশ্রেষ্ঠ বসন্তের প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া প্রেমিকা ভুলে গেছে প্রেমসংজ্ঞা, ভুলে গেছে ভালবাসার সুখানুভূতি। প্রিয়জনের অতি আপন হাত ছেড়ে প্রেমবতী পিয়া রানী বসন্তের বহুত্ব রূপে মশগুল হয়ে ধরেছে ঋতুরাজের রঙভরা পথ। বসন্তরঙে রাঙা উন্মাদ প্রেমিকার বাসন্তী আঁচল ধরে পিছু ছুটছে ব্যথিত প্রেমিক পুরুষ। অবশেষে প্রকৃতিপূজারী বসন্তের বর্ণিল বাহানা যে কেবল প্রকৃতিগত তৃপ্ততা তা বুঝে প্রিয় প্রেমিক পুরুষের হাত ধরেই প্রেয়সী ঘুরছে বসন্ত রাঙা পথে। অপূর্ব রূপবতী বসন্তের প্রেমে কেবল প্রেমী-ললনাই মজেছে তা নয়, লেখক-কবি-সাহিত্যিকরাও যুগে যুগে বসন্ত বন্দনায় শামিল হয়েছেন। মধ্যযুগের শক্তিমান কবি ভারতচন্দ্র রায় তাঁর অন্নদামঙ্গল কাব্যে বসন্তকে রাজা বলে আখ্যায়িত করেছেন। বসন্ত যে একটি ঋতু সেই পরিচয়কে পেছনে ফেলে তিনি বসন্তকে রাজার পরিচয়ে পরিচয় করে দিতেও কৃপণতা দেখাননি। ষড়ঋতুর শেষ ঋতুটি যে ঋতুরাজ তা আবারও কবির ছন্দময় কবিতায় ফুটে উঠেছে সুন্দরভাবে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গীতাঞ্জলি কাব্যে বসন্তকে দেখেছেন এভাবেÑ ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে, / তব অবগুণ্ঠিত কুণ্ঠিত জীবনে / কোরো না বিড়ম্বিত তারে। / আজি খুলিও হৃদয় দ্বার খুলিও, / আজি ভুলিও আপনপর ভুলিও, / এই সঙ্গীত-মুখরিত গগনে / তব গন্ধ তরঙ্গিয়া তুলিও।’ কবিগুরু বসন্তকে সামনে পেয়ে মন উজাড় করে একে অপরকে ভুলে সুরের মূর্ছনায় ঋতুরাজকে বরণ করতে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। কবি বন্দনায় শামিল হতে বসন্ত বরণে প্রস্তুত আজ বাংলাদেশ। বসন্তকে নিয়ে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাবনা একটু ভিন্ন। তিনি ঋতুরাজ বসন্তকে মূল্যায়ন করেছেন অন্য ভঙ্গিমায়। বিদ্রোহী কবি নজরুল নিজেকে বসন্তের বার্তাবাহী গানওয়ালা পাখিদের সহযাত্রী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। মোতাহার হোসেনকে লেখা একটি পত্রে তিনি লেখেন, ‘কোকিল, পাপিয়া, বউ কথা কও, নাইটিঙ্গেল, বুলবুল- বিউটিফুল বলে এদের কেউ বদনাম দিতে পারেনি। কোকিল তার শিশুকে রেখে যায় কাকের বাসায়, পাপিয়া তার শিশুর ভার দেয় ছাতার পাখিকে। বউ কথা কও শৈশব কাটায় তিতির পাখির পক্ষপুটে। তবু আনন্দে গান গেয়ে গেল এরাই। এরা ছন্নছাড়া কেবলই ঘুরে বেড়ায়, কোথায় যায়, কোথা থাকে। তারপর এরাই স্বর্গের ইঙ্গিত এনে দিল।’ বিরহের কবি নজরুল প্রকৃতিতে আসা বসন্ত ক্ষণকে পৃথিবীর স্বর্গ বলে অভিহিত করেছেন। কবির ছন্দময় সুরে সওয়ার হয়ে গানের ওই পাখিগুলোই পৃথিবীতে সন্ধান এনে দেয় বসন্ত নামক স্বর্গকে। বসন্ত যেমন ঋতুর রাজা তেমনি প্রেমের কলিও বটে। ‘বসন্ত বন্দনা’ কবিতায় নির্মলেন্দু গুণ চয়ন করেছেনÑ ‘হয়তো ফুটেনি ফুল রবীন্দ্রসঙ্গীতে যত আছে, হয়তো গাহেনি পাখি অন্তর উদাস করা সুরে / বনের কুসুমগুলি ঘিরে। আকাশে মেলিয়া আঁখি / তবুও ফুটেছে জবা, দুরন্ত শিমুল গাছে গাছে, / তার তলে ভালোবেসে বসে আছে বসন্ত পথিক।’ বসন্তকে ঘিরে যত ফুল ফোটার কথা ছিল তত ফুল ফোটেনি বাগানে। পাখিরাও গান করেনি সে অনুযায়ী। অন্য ফুল না ফুটলেও জবা, শিমুল, পলাশ আর কৃষ্ণচূড়া ঠিকই ফুটেছে। বসন্তকালে ফোটা ওই ফুলগুলোকে পথিক যেমন ভালবেসেছেন কবিও তেমন ভালবেসেছেন। তাই তো শিমুল তলায় বসা বসন্ত পথিকই কবির সহযাত্রী হতে পেরেছে। শহুরে মানুষ বসন্ত বরণের প্রথম দিনটিতে ক্ষণিকের তৃপ্তিবোধে জাগ্রত হয়। আর গ্রামীণ জনপদ তথা আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা বসন্তক্ষণের সবটুকু সময়ই ঋতুরাজে মেতে ওঠে। তবে শহরাঞ্চলের মেয়েদের চালচলন, মননশীলতা ও রুচিবোধে ভিন্ন সংস্কৃতির দখল থাকলেও বসন্তকালীন এ সময়টায় পুরোদস্তুর বাঙালী সাজ অর্থাৎ আটপৌরে শাড়িতে তাদের সজ্জিত হতে দেখা যায়। বিশেষ এ দিনে কন্যা-কুমারী ও নারীদের এই বাঙালিয়ানা সত্যিই প্রশংসনীয়। লেখক : সাংবাদিক [email protected]
×