ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এই অর্থ ব্যয় করা হবে বিদ্যুত, জ্বালানি, তথ্যপ্রযুক্তি, সেবা, কৃষি ও সড়ক পরিবহন অবকাঠামো খাত উন্নয়নে ;###;দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত ইস্যুতে এ পর্যন্ত ৩০ চুক্তি করা হয়েছে

বিশাল সৌদি বিনিয়োগ ॥ বাংলাদেশের প্রত্যাশা ৫০ বিলিয়ন ডলার

প্রকাশিত: ১০:৫০, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০

বিশাল সৌদি বিনিয়োগ ॥ বাংলাদেশের প্রত্যাশা ৫০ বিলিয়ন ডলার

এম শাহজাহান ॥ অবকাঠামো খাত উন্নয়নে সৌদি আরবের কাছে ৫০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রত্যাশা করছে বাংলাদেশ। বিপুল পরিমাণ এই অর্থ ব্যয় করা হবে বিদ্যুত, জ্বালানি, তথ্যপ্রযুক্তি, সেবা, কৃষি ও সড়ক পরিবহন অবকাঠামো খাত উন্নয়নে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত ইস্যুতে সৌদি আরবের সঙ্গে এ পর্যন্ত ৩০টি চুক্তি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে সৌদি আরবের বিনিয়োগে বাস্তবায়ন হবে এরকম ১৬টি বৃহৎ প্রকল্প চিহ্নিত করেছে সরকার। সর্বশেষ বাংলাদেশ-সৌদি আরব যৌথ কমিশনের (জেসি) বৈঠকে সৌদি আরব প্রতিনিধি দল এদেশে বিপুল অঙ্কের বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এখন অনন্য উচ্চতায় বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। জানা গেছে, সৌদির পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডের ২৫০ বিলিয়ন ডলার বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে মধ্যপ্রাচ্যের তেল অর্থনীতি নির্ভর এই দেশটি। মূল লক্ষ্য, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বহুমুখীকরণ। এরই অংশ হিসেবে বাংলাদেশ নিয়ে সৌদি আরবের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন শেখ হাসিনা সরকারের ধারাবাহিকতা, বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে রোডম্যাপ গ্রহণ, বিনিয়োগে ওয়ানস্টপ সার্ভিস নিশ্চিত করা, ভিশন-২১ এর মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে পৌঁছানো এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যমাত্রার মতো কর্মসূচীতে আকৃষ্ট হয়েছে সৌদি আরব। এর আগে গত বছর সৌদি বাদশা ও তার পুত্র প্রিন্স সালমানের আমন্ত্রণে সৌদি আরব সফর করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর ওই সফরে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত চুক্তিগুলো দ্রুত কার্যকরে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এদিকে, দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে দেশে সৌদি আরবের বিনিয়োগ আনার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। কিন্তু নানা ধরনের জটিলতার কারণে চুক্তি সই ও সমঝোতা স্মরক স্বাক্ষরের মধ্যে বিনিয়োগ প্রস্তাবগুলো সীমাবদ্ধ রয়েছে। কয়েকটি বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতের বিনিয়োগ চুক্তি ছাড়া দৃশ্যমান প্রকল্প নেই বললেই চলে। এ অবস্থায় সৌদি আরবের বিনিয়োগ দ্রুত দেশে আনার তাগিদ দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। ইতোমধ্যে সৌদি আরব সরকার ভারত ও পাকিস্তানে বড় অঙ্কের বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। সস্তা শ্রম ও ওয়ানস্টপ সার্ভিস নিশ্চিত হওয়ার কারণে ওই দেশ দুটির চেয়ে বাংলাদেশে এখন বিনিয়োগের জন্য উৎকৃষ্ট স্থান বলে মনে করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সম্প্রতি জানিয়েছেন, যত দিন যাচ্ছে সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক শক্তিশালী হচ্ছে। আরামকো বাংলাদেশে বিশাল বিনিয়োগ করবে। যদিও বিনিয়োগের পরিমাণ এখনই বলা যাচ্ছে না। অনেক বিষয়ে চুক্তিও হয়ে গেছে। তিনি বলেন, সৌদি আরবের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কটি অনেক দিনের। যার পেছনে রয়েছে সৌদি আরব ও বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব। বাংলাদেশ এখন বন্ধুত্বের উর্ধে টেকসই উন্নয়নের জন্য কার্যকর অংশীদারিত্বকে ধরে রাখার দিকে নজর দিচ্ছে। বাংলাদেশ তার বন্ধুদেশ এবং উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে অব্যাহত ও বর্ধিত সমর্থন প্রত্যাশা করছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ এবং সৌদি আরবের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পরে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। সেই পারস্পরিক চুক্তির ভিত্তিতে একটি যৌথ কমিশন (জেসি) প্রতিষ্ঠিত হয়। জেসি সভায় সৌদির প্রতিনিধি দলের বিনিয়োগের ঘোষণা গত ১৩ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর শেরে বাংলানগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে বাংলাদেশ-সৌদি আরব যৌথ কমিশনের (জেসি) ১৩তম সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সময় উপস্থিত ছিলেন, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব মনোয়ার আহমেদ, সৌদি শ্রম মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী মাহির আব্দুল রাহমান গাসিম, আরামকোর বিজনেস ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার এক্সপার্ট জুলিও সি হেজেলমেয়ার মোসেস প্রমুখ। জনশক্তি, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়ন, বিনিয়োগ, বিদ্যুত ও জ্বালানি, ধর্মীয় বিষয়, পর্যটন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, কৃষি ও ফিশারি, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষা ১৩তম যৌথ কমিশন অধিবেশনে এজেন্ডা এবং দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার এলাকা হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। একই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন অর্থনৈতিক খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ানোরও আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সহায়তা, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য হ্রাসে অবদান রাখতে বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ আশা করছে। এসডিজি, পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০৪১, অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা এবং অন্যান্য জাতীয় পরিকল্পনা ও নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার সৌদি বিনিয়োগ প্রত্যাশা করছে বাংলাদেশ। সৌদি আরব প্রথম পর্যায়ে ৪জি টেলিটকের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ এবং শহরে ৫জি সেবা প্রদানে ১০০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ করবে। এছাড়া বাংলাদেশ থেকে পর্যাপ্ত চিকিৎসক, নার্স ও ধাত্রী নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য একটি কার্যনির্বাহী কর্মসূচী প্রস্তুত করতে সম্মত হয়েছে উভয় দেশ। ইআরডি সূত্র জানায়, গ্রাম পর্যায়ে ৪জি টেলিটকের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে ১০০ কোটি ডলারের প্রস্তাব দিয়েছে সৌদি আরব। এছাড়া সৌদি আরবের শ্রমশক্তির ১৩ শতাংশই বাংলাদেশী। তারা দেশটির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন বলে জানান দেশটির শ্রম মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী মাহির আব্দুল রাহমান গাসিম। ওই বৈঠক সম্পর্কে ইআরডি সচিব মনোয়ার আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, উভয় দেশের মধ্যে ৬০টি ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে ৩০ বিষয়ে চুক্তি সই হয়েছে। সৌদি আরব বাংলাদেশের অধিকাংশ খাত নিয়েই আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তারা টেলিকম খাতে এক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। এছাড়া ইআরডি জানায়, সৌদির এ্যাকোয়া পাওয়ারের সঙ্গে ১৮০ মেগাওয়াটের বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য চুক্তি হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, শীঘ্রই সৌদি আরবের বেসরকারী বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে আসবেন এবং এমওইউ সই হবে। বিদ্যুত খাতের উন্নয়নে উভয় পক্ষই এক সঙ্গে কাজ করবে। এছাড়া বাংলাদেশের ফার্নিচার খাতে দক্ষতা বৃদ্ধি এবং রফতানির জন্য বিনিয়োগ করবে সৌদি আরব। এই বিষয়ে সৌদি আরব ও বাংলাদেশ সরকার একমত পোষণ করেছে। উভয় দেশের মধ্যে পারস্পরিক বাণিজ্যিক পণ্যের বৈচিত্র্যায়নের ওপর গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেছে। বৈঠকে সৌদি পক্ষ সৌদি ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্ট (এসএফডি) এবং বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যে সহযোগিতা জোরদারের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বিদ্যুত খাতে সৌদি আরবের বড় বিনিয়োগ যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির পর এবার এলএনজি (লিকুইফাইড ন্যাচারাল গ্যাস) ভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে সৌদি আরব। দুই থেকে আড়াই বিলিয়ন ডলারের এই বিনিয়োগে দেশে তিন হাজার ৬০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন করা হবে। তবে কেন্দ্র নির্মাণের স্থান ঠিক হবে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা জরিপ শেষ হওয়ার পর। গত বছরের অক্টোবর মাসে হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সঙ্গে সৌদি আরবের কোম্পানি এ্যাকোয়া পাওয়ারের এ সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারী বিনিয়োগ-বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, ৩ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনে দুই থেকে আড়াই বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে এ্যাকোয়া পাওয়ার। এই চুক্তির মাধ্যমে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো। তিনি বলেন, এনার্জি হচ্ছে অর্থনীতির চালিকা শক্তি। বাংলাদেশে অসাধারণ সাফল্য এসেছে এই খাতে।
×