ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

গোরা বিশ্বাস

জন্মশতবর্ষে একটি কুসুম

প্রকাশিত: ০৭:২৭, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০

 জন্মশতবর্ষে একটি কুসুম

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৪০০ সাল কবিতায় লিখেছিলেন, আজি হতে শতবর্ষ পরে/কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি কৌতূহল ভরে- কবির এই কবিতার মর্মবাণী ছিল শতবর্ষ পরে অনাগত ভবিষ্যতে যারা পৃথিবীর এই আলো-বাতাসে আসবে, কেমন হবে তাদের চিন্তা-চেতনা, সমাজ-ভাবনা। তার লেখার আবেদন সেদিনের পাঠকের কাছে আরও বেশি সমাদৃত ও কৌতূহলের হবে কি! দু’হাজার বিশ সালে লিখছি শতবর্ষ আগের কথা। অর্থাৎ আজ থেকে একশ’ বছর আগে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ টুঙ্গিপাড়া এক নিভৃত পল্লী গ্রামে সাহারা খাতুনের গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন আজকের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পিতা লুৎফর রহমান। শৈশবকাল থেকেই দুরন্তপনার মধ্য দিয়ে তার বেড়ে ওঠা। স্কুল জীবন থেকেই তিনি ছিলেন অন্যায়-অবিচার-জুলুম-অত্যাচার ও অসত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ধর্মের বিভাজনে যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল, তার আসল রূপ তরুণ বয়সেই তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন তার এক ভাষণে উর্দুই হবে পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা বলেন- তখনই রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবিতে তার কণ্ঠ সোচ্চার হয়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ’৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ’৬৬ সালের ৬ দফা, ’৬৯-এর গণআন্দোলন ও ’৭১ সালে মুক্তি সংগ্রাম; সকল ক্ষেত্রেই বঙ্গবন্ধু ছিলেন অগ্রনায়ক। পরাধীন ভারতে রবীন্দ্রনাথ যেমন তার লেখনীর মাধ্যমে ভারতবাসীকে শুনিয়েছেন মুক্তির মর্মবাণী, তেমনি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে হয়ে উঠলেন বাঙালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা ও জাতির জনক। যাকে ইতিহাস সৃষ্টি করেনি, যিনি ইতিহাস সৃষ্টি করে নিজেই ইতিহাস হয়ে আছেন। নানা ঘাত-প্রতিঘাত-নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করে যৌবন ও জীবনে দীর্ঘ তেরোটি বছর জেলে কাটিয়েছেন শুধুমাত্র এদেশের গণমানুষের মুক্তির জন্য। তিনি ভালবাসতেন দেশের মাটি ও মানুষকে। শত প্রলোভন-লোভ-লালসা কোন কিছুই বঙ্গবন্ধুকে লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। তার দেশপ্রেম যে কত গভীর ছিল, তা জানা যায় পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডনে হিথ্রো বিমানবন্দর পৌঁছে বিদেশী এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আমি আমার দেশের জনগণের কাছে ফিরে যেতে চাই।’ এখানে এক ঘণ্টাও থাকতে চাই না। ঠিকই, তিনি যখন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশের মাটিতে ফিরে আসেন তখন পুত্র-কন্যা, পরিবার-পরিজনের খবর না নিয়ে, ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়িতে না গিয়ে তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে সোজা চলে যান তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে। বঙ্গবন্ধু কৃষক-শ্রমিক মেহনতী মানুষের সমাজ ব্যবস্থা চালু করে শোষণমুক্ত একটি দেশ গড়তে চেয়েছিলেন। তিনি ধনিক শ্রেণীর চেয়ে নিম্ন শ্রেণীর হতদরিদ্র মানুষের কথা বেশি করে ভাবতেন। সর্বস্তরের মানুষকে ভালবাসতেন বলে এদেশের বেদে, সাপুড়ে, হিজড়া, প্রতিবন্ধী-পাহাড়ী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সব জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা প্রত্যক্ষ করেছে। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে প্রথম কৃষি বিপ্লব ও সবুজ বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন। কৃষকদের জন্য পঁচিশ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করেছিলেন। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘বাংলার মানুষ হাসবে বাংলার মানুষ খেলবে বাংলার মানুষ দুবেলা পেট ভরে ভাত খাবেÑ এটাই আমার চাওয়া।’ দেশে ও দেশের জনগণের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা ও দরদ একমাত্র তার পক্ষেই সম্ভব হয়েছে। বিশ্বে আর কোন নেতার পক্ষে হয়নি। বঙ্গবন্ধু ছিলেন এক অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূর্ত প্রতীক। তিনি ছিলেন বহুত্ববাদী দর্শনের জনক এবং একজন ধার্মিক ব্যক্তি। জেলখানায় বসে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন এবং কুরআনের বাংলা ও ইংরেজী অনুবাদ আত্মস্থ করতেন, যা আত্মজীবনীতে উল্লেখ আছে। সকল ধর্মকে সম্মান করতেন বলেই দেশে একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান উপহার দিতে পেরেছিলেন। আমরা দেখেছি, স্বাধীনতার পর সকল জাতীয় অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে পবিত্র কুরআন, গীতা, বাইবেল ও ত্রিপিটক পাঠ করা হতো। রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গান্ধী ও নজরুলের আদর্শকে তিনি ধারণ করতেন। অখন্ড ভারতে হিন্দু, মুসলিম দাঙ্গা তাকে ব্যথিত করেছে। গান্ধীর অহিংস উদার নীতি যা করতে পারেনি, বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষের জন্য তা করতে পেরেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেই অকুতোভয় বিশ্ব মানবকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে সেনা শাসনের আদলে যারা ক্ষমতায় এসেছিল, তারা পাকিস্তানী ভাবধারায় ফিরে গিয়ে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালী জাতীয়তাবাদকে মুছে ফেলে। উত্থান ঘটে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির। তারা দেশকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়। থেমে যায় সম্প্রীতির ঐক্য বন্ধন, গণতন্ত্র ও উন্নয়নের গতিধারা। কিন্তু তারা বাংলাদেশকে মুছে ফেলতে পারেনি। মুছে ফেলতে পারেনি বঙ্গবন্ধুকে এদেশের মানুষের মন ও হৃদয় থেকে। যে মাটি হানাদার বাহিনী ও তার দোসররা জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে চিতাভস্ম করেছিল, সে মাটিতেই তিনি সোনার মানুষ, সোনার ফসল ফলাতে চেয়েছিলেন। যে সোনার বাংলার কথা কবিগুরু তার স্বদেশ প্রেম কবিতায় লিখেছিলেন ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।’ সেই কবিতারই আটটি চরণ স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতে পরিণত হলো। এটা আজ আমাদের গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে যে, একজন জাতীয় সঙ্গীতের স্রষ্টা আর একজন জাতির স্রষ্টা- কি করে দুই প্রান্তের দুই মহামানবের আদর্শিক মিলন ঘটল। তা হলে কি কবিগুরু বঙ্গবন্ধুর মতো একজন দেশপ্রেমিক বাঙালী জাতির পরিত্রাতার প্রতীক্ষায় ছিলেন! সে কথা তিনি জীবন সায়াহ্নে এসে তার সভ্যতার সঙ্কট প্রবন্ধে ক্ষুধার্ত, নিপীড়িত মানুষের মুক্তির পথপ্রদর্শকের কথা উল্লেখ করেছেন। যিনি জনতার মঞ্চে এসে বলবেন- এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। আর মাত্র কয়েকদিন বাকিÑ আগামী ১৭ মার্চ সেই বিশ্বনেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ পূর্ণ হতে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ২০২০ সালকে মুজিববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছে। সে লক্ষ্য সামনে রেখে বছরব্যাপী নানা আয়োজনে সাড়ম্বরে পালিত হবে জন্মজয়ন্তী উৎসব। সভা, সমিতি, সেমিনার, নাটক, শিল্প-সাহিত্য, চিত্রকলা, কবিতা ও সঙ্গীতের মাধ্যমে তুলে ধরা হবে তার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের জানা-অজানা ঘটনা। বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার সত্যিকার ইতিহাস। দেশের মাটি পেরিয়ে ইউনেস্কোর মাধ্যমে বিশ্বের ১৯৩টি দেশে এই অনুষ্ঠান উদ্্যাপনের আয়োজন করা হবে। বঙ্গবন্ধু মুজিব কোন ব্যক্তির নয়, কোন দলের নয়, তিনি দলমত ধর্ম গোষ্ঠী সকলের উর্ধে জাতির অস্তিত্ব ও চেতনার প্রতীক। তাই শুধুমাত্র শতবর্ষে নয়, যতদিন থাকবে এদেশের পাহাড়, নদী, বন-বনানী, ফুল-ফসল, মাটি ও মানুষ ততদিন তার প্রদর্শিত পথেই আমাদের হাঁটতে হবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও নীতির প্রতি অবিচল থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে যেভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, দেশের মানুষও তার প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে একসঙ্গে কাজ করে যাবে। তবেই হবে জাতির পিতার প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা ও ভালবাসা। দেশবাসী আজ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, কখন আসবে সেই শুভক্ষণ। আমরা ধন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের একটি অত্যুজ্জ্বল ফুলকে ফোটাতে পেরে। আমরা কৃতজ্ঞ শেখ হাসিনার প্রতি, যিনি শত প্রতিকূল পরিস্থিতি পাড়ি দিয়ে জাতিকে এই শুভক্ষণটি উপহার দিতে পেরেছেন। লেখক : সমাজ ও পরিবেশ উন্নয়নকর্মী
×