ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অধিদফতর নিয়ন্ত্রণে নেয়নি

বগুড়ার ভবানীপুর মন্দির হতে পারে বিশাল পর্যটনকেন্দ্র

প্রকাশিত: ১১:০৮, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০

 বগুড়ার ভবানীপুর মন্দির  হতে পারে বিশাল  পর্যটনকেন্দ্র

সমুদ্র হক ॥ উত্তরাঞ্চলের একটি প্রাচীন কীর্তি ও তীর্থভূমি অচেনাই রয়ে যাচ্ছে। প্রাচীন ভবানীপুর মন্দির বিশ্ব হিন্দু ফেডারেশনের তালিকায় গুরুত্ব বহন করেছে অনেক আগেই। বগুড়ার শেরপুরের নিভৃত গ্রামে অবস্থিত ঐতিহ্য রক্ষার এই মন্দিরে সন্ন্যাসব্রত ভারত পরিব্রাজনের পাঁচশ’ বছর পূর্তির স্মরণোৎসবও হয়েছে দশ বছরে আগে। যা ছিল ওয়ার্ল্ড হিন্দু ফেডারেশনের চতুর্থ সম্মেলন। এসেছিলেন মহামন্ডেলশ্বর প্রিয়বত ব্রহ্মচারী। হিন্দু তীর্থস্থান ভবানীপুর মন্দির নীরবে নিভৃতে দাঁড়িয়ে আছে বগুড়া শহর থেকে প্রায় ত্রিশ কিমি দক্ষিণ-পশ্চিমে শেরপুর উপজেলার ভবানীপুরে। মন্দিরের নামকরণেই পরিচিতি পেয়েছে গ্রামের নাম। দেশের অনেক পুরাকীর্তি ও প্রত্নসম্পদ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের অধীনে এসেছে। প্রাচীন এই মন্দিরটিও প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের প্রত্নসম্পদের আওতায় পড়ে। অথচ মন্দির ও স্থাপনা আজও প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের নিয়ন্ত্রণে আসেনি। এ বিষয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক নাহিদ সুলতানা জানান, বিষয়টি মন্ত্রণালয় অবগত আছে। এক সচিব মন্দিরটি সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে বলেছেন। নাহিদ সুলতানা মন্দিরটি পরিদর্শন করেছেন। দেখতে এসে পুরাকীর্তির ছবি তুলছিলেন শৌখিন আলোকচিত্রী উপসচিব রায়হানা ইসলাম। বললেন, বগুড়ার উত্তরে আছে দেশের সবচেয়ে প্রাচীন পুন্ড্রনগরী খ্যাত মহাস্থানগড়। আর দক্ষিণের এই মন্দির পর্যটক আকর্ষণ করতে পারে। বিশ্ব পরিব্রাজক ও পর্যটকদের আকর্ষণীয় এই মন্দির। প্রতি বছর মন্দিরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দেন বিশ্বের বহু দেশের মানুষ। মাঘী পূর্ণিমায় বহু তীর্থযাত্রী মন্দিরের পুকুরে পুণ্যস্নানে অংশ নেন। রাম নবমী তাদের অন্যতম বড় উৎসব। প্রতিটি উৎসবের শুরুতে শিশুরা শান্তির শ্বেত কপোত (পায়রা) উড়িয়ে দেয়। এরপর উৎসবের ডালা সাজানো হয়। মন্দিরের অলিন্দে পায়রা আশ্রয় নিয়ে আছে। নিত্যদিন তাদের ‘বাকবাকুম বাকবাকুম’ ডাকে ঘুম ভাঙে মন্দিরের পুরোহিত ও আশপাশের মানুষের। পায়রা নিয়েও আছে অনেক মিথ। এরা শান্তির পূজারী হয়ে সুন্দরের প্রকাশ ঘটায়। অশান্তির ছিটেফোঁটা বুঝতে পারলেই শান্তির আশ্রম খুঁজে নিতে উড়ে যায় অন্য কোথাও। বয়োবৃদ্ধরা বলেন, যে বাড়িতে শান্তি বিরাজমান স্থান সেই বাড়ি পায়রার প্রিয়। হিন্দু মাইথোলজিতে ভবানীপুর মন্দির ঘিরে অনেক ঘটনা আবর্তিত হয়েছে। দেবীদুর্গার আরেক নাম ভবানী। মন্দিরের পূজা অর্চনা ও আরাধনায় দেবীদুর্গাকে স্মরণ করা হয়। গ্রহ নক্ষত্রম-লীর পরিক্রমাক্ষণের ওপর ভিত্তি করে অনুষ্ঠান ও উৎসব হয়। মাঘী পূর্ণিমার তিথির সূর্যালোকে জলাশয়ে (নদী বিল পুকুর) স্নানকে পুণ্যস্নান মনে করে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। এক পুরোহিত বললেন, প্রকৃতির কোন তিথির ভোরের আলোয় উন্মুক্ত জলাশয়ে স্নান পাপ ধুয়েমুছে মানব মনে পূণ্য বয়ে আনে। ভবানীপুর মন্দির হিমালয়রাজের যজ্ঞ মহাভারতের বড় উপাখ্যান। হিমালয়রাজ আয়োজন করেছিলেন এক বিরাট রাজযজ্ঞের। আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন রাজরাজাদের। সব আত্মীয়স্বজনও নিমন্ত্রিত। কিন্তু কোন কারণে নেমন্তন্ন পাননি কন্যাপার্বতীর স্বামী মহাদেব। অলৌকিকত্ব ও ভূতপ্রেত নিয়ে সারাক্ষণ মেতে থাকেন শিকাম্ভু। যজ্ঞ আসরে আমন্ত্রিতরা আনন্দে মশগুল। কেউ কেউ তামাশাও করছে। পার্বতীর স্বামী নিয়ে স্বামী নিন্দা শোনা মহাপাপ। ক্ষোভে অপমানে যজ্ঞস্থলে দেহত্যাগ করেন পার্বতী। মুহূর্তেই খবর পৌঁছে যায় মহাদেবের কাছে। এভাবে স্ত্রীর বিয়োগ মেনে নিতে না পেরে তিনি যজ্ঞস্থলে গিয়ে পার্বতীর প্রাণহীন দেহ কাঁধে নিয়ে প্রলয়নাচন শুরু করেন। এতে হিমালয়রাজের যজ্ঞ ভন্ডুল হয়ে পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার উপক্রম। দেবতারাও সব কিছু দেখেশুনে কূলকিনারা করতে পারছিল না। মহাদেবের কাঁধ থেকে পার্বতীর প্রাণহীন দেহ নামাতে না পারলে বন্ধ হবে না এই প্রলয় নাচন। ধ্বংস অনিবার্য জেনে দেবতারা শরণাপন্ন হলেন আদি দেব ব্রহ্মার কাছে। ব্রহ্মা জরুরী বৈঠকে ডাকলেন সুদর্শন চক্রকে। ব্রহ্মার নির্দেশে সুদর্শন চক্র মহাদেবের কাঁধে থাকা প্রাণহীন পার্বতীর দেহ কেটে বিচ্ছিন্ন করল। ৫২ খন্ডে বিভক্ত হলো পার্বতীর দেহ। একটি খন্ড চলে যায় স্বর্গউদ্যানে। বাকি ৫১ খন্ড ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে পড়ে। হিন্দু পুরাণ মতে যেসব জায়গায় খন্ডগুলো পড়ে সেই স্থানগুলো পীঠস্থান, তীর্থভূমি। বগুড়ার ভবানীপুর মন্দির এমনই একটি পীঠস্থান। জনশ্রুতি আছে, ভবানীপুরে পড়েছিল পার্বতীর বাঁ তল্প মতান্তরে বাঁ পায়ের গোড়ালি। অপর পক্ষের মতে ভবানীপুর মন্দির থেকে পাঁচ কিমির দূরে গুল্টা গ্রামে করতোয়া পাড়ে পার্বতীর দেহাবশেষ পড়েছিল। সেখানে পাথরের একটি মূর্তি গড়ে তুলে সাধু সন্ন্যাসীরা ধ্যানে বসে। পরে দস্যুদের ভয়ে ওই মূর্তি ভবানীপুরের গভীর জঙ্গলে লুকিয়ে রাখে। ধারণা করা হয়, মন্দিরের পাশে বেলবরনতলায় মূর্তিটি লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। এই স্থানেই পরে মন্দির গড়ে তোলা হয়।
×