ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

শেকড়হীন বৃক্ষরা

প্রকাশিত: ১২:৪১, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০

শেকড়হীন বৃক্ষরা

১৯৫২ সাল। হাশেম মৃধার বয়স তখন বারো/তেরো। স্কুলে পড়ে। ভাষার দাবিতে তখন ঢাকার রাজপথ উত্তাল। সেই উত্তাল ঢেউয়ের দোলা যে জামতলীর মতো অজোপাড়াগাঁয়ে লাগেনি তা নয়। ঢেউয়ের উৎপত্তি সাগরের যত ভেতরেই হোক, চারদিকে ছড়াতে ছড়াতে শেষে কিনারে গিয়েই শেষ হয়। বাজারে চায়ের দোকানে বা মানুষের জটলায় কিশোর হাশেম মৃধা শুনেছে ভাষার জন্য লড়াই বাধার কথা। সে সব কথা তার মস্তিষ্ককে আন্দোলিত করেছে। তার মনের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে প্রশ্ন-‘তারা আমাগো মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায় ক্যান?’ আমাদের ভাষার ওপর আঘাত হানার পেছনে যে সুবিশাল দুরভিসন্ধি ছিল-জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্বকে বিনাশ করার পরিকল্পনা ছিল তা সে বুঝতে পারেনি। তারপরও সে বুঝেছে, এটা অন্যায়। স্কুল ছুটির পর ফসলী জমির মাঝ দিয়ে জেগে থাকা সবুজ ঘাসের আল ধরে যখন তারা দল বেঁধে বাড়ি ফিরত, তখন হাশেম মৃধা দলের সবাইকে বলত-‘আমি সামনে থাইকা কমু-রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, আর তোরা পেছনে থাইকা কইবি-আমাদের দাবি মানতে হবে।’ দলের সবাই তার কথা মেনে নিত। সে গলার রগ ফুলিয়ে বলত-‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’ সবাই পেছন থেকে তদ্রুপভাবে বলত-‘আমাদের দাবি মানতে হবে।’ প্রথম প্রথম ‘আমাদের’ শব্দটাকে তারা তাদের মতো করে বলত ‘আমাগো’। ‘হবে’-কে বলত ‘অইবো’। তখন হাশেম মৃধা তাদের বুঝিয়ে বলত-‘শোন, ছোলোগান কহনও আমাগো মুখের ভাষায় হয় না। ছোলোগান হয় বইয়ের ভাষায়। তোরা আমাগো না কইয়া ‘আমাদের’ কইবি, আর ‘অইবো’-রে কইবি ‘হবে’ বুঝলি? তারপর থেকে তারা প্রতিদিনই এভাবে স্লোগান তুলে বাড়ি ফিরত। ক’দিনের মধ্যে তাদের ভেতর কী এক উদ্দীপনা এসে গেল। স্কুলে যাবার আগে সবাই গিয়ে জড়ো হতো হাশেম মৃধাদের বাড়ির নিচে। তারা স্লোগান দিতে দিতে স্কুলে যেত। স্লোগান দিতে দিতে স্কুল থেকে ফিরত। বিকেলে খেলার মাঠ থেকে ফেরার সময়ও স্লোগান তুলে বাড়ি ফিরত। তাদের এই স্লোগান অবশ্য টিয়ার গ্যাস আর বুলেটওয়ালাদের কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি। তারপরও আমি বলবো, তারা ভাষার দাবিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পথে নেমেছিল। জোর গলায় স্লোগান তুলেছিল। তারা ভাষা সৈনিক। এবং সেই ভাষা সৈনিক দলের নেতা হাশেম মৃর্ধা। স্লোগান দিতে দিতে তাদের মধ্যে এই মনোবল দৃঢ় হয়েছিল যে, অন্যায়কারীরা জয়ী হতে পারবে না। হাশেম মৃধা প্রায়ই বলতো-দেহিস, ওরা পারবো না আমাগো ভাষা কাইড়া নিতে। সত্যি ওরা পারেনি। কিছু তরুণের বুকের তাজা রক্ত ঝরেছে। মায়ের বুক শূন্য হয়েছে। শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেয়েছে বাংলা। ॥ দুই ॥ হাশেম মৃধা মেট্রিক পাস করল। বাড়ি থেকে কলেজ ১৩/১৪ মাইল দূরে। কলেজে যেতে পাড় হতে হয় একটা নদী, তিনটা খাল, আর ভাঙা পথ-ঘাট। এই কষ্টসাধ্য পথ অতিক্রম করে প্রতিদিন বাড়ি থেকে গিয়ে ক্লাস করা সম্ভব নয়। কলেজে পড়তে হলে হয় হোস্টেলে থাকতে হবে, নয় থাকতে হবে কারও বাড়িতে লজিং হিসেবে। একমাত্র সন্তানকে চোখের আড়াল করতে বাবা-মায়ের, বিশেষ করে মায়ের মন সায় দিল না। তার পড়াশোনার ইতি হয়ে গেল। সে বাবার সঙ্গে কৃষি কাজে যোগ দিল। বয়স একুশ হতে না হতেই বাবা-মা দেখে-শুনে তাকে বিয়ে দিল। যে মেয়েটির সঙ্গে তার বিয়ে হলো তার নাম মালা। হাশেম মৃধা তাকে গোপনে শিউলি মালা ডাকত। শিউলি বোধহয় তার প্রিয় ফুল ছিল। ॥ তিন ॥ ’৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধের ডামাডোল বেজে ওঠার সময় হাশেম মৃধা তিনটি পুত্র সন্তানের জনক। বড় ছেলে কাশেম মৃধার বয়স নয় বছর। মেঝো ছেলে রজব মৃধার বয়স সাত, আর ছোট ছেলে ফজল মৃধার বয়স পাঁচ। ভাষা আন্দোলনটা গ্রামে গ্রামে সেভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল না। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ল দেশের আনাচে-কানাচে। মানুষ চোখের সামনে জ্বালাও-পোড়াও দেখছিল। জামতলী গ্রামের লোকজন স্তম্ভিত। কী করবে বুঝতে পারছিল না। সবাই আশা করছিল হাশেম মৃধা কিছু বলবে। হ্যাঁ, শিক্ষিত লোক বলে গ্রামের ছেলে-বুড়ো সবাই তাকে মানতো। হাশেম মৃধাও একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে চাচ্ছিল। যেদিন তার প্রতিবেশী নিতাই চন্দ্র দাসের বাড়িতে আর্মি এলো এবং নিতাইকে ন্যাংটা করে তার মুসুলমানিত্বের প্রমাণ নিল, সেদিনই সে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেল। নিতাই চন্দ্র বাঁচতে চেয়েছিল। সে নিজের নাম বলেছিল মোহাম্মদ তোফাজ্জল হোসেন। স্ত্রীর নাম বলেছিল খাদিজা খাতুন। তারা দু’জন মুখস্থ করা কলেমাগুলোও ঠিক ঠিক বলেছিল। নারীকে ন্যাংটা করে হিন্দু-মসুলমান বোঝা সম্ভব নয়। কিন্তু পুরুষের ক্ষেত্রে সমস্যা। ন্যাংটা না করলে সে যে মসুলমান নয় তা বোঝা সম্ভব ছিল না। আর্মিরা নিতাইকে ন্যাংটা করে যখন প্রমাণ পেল যে, সে মুসলমান নয়, তখন তারা তাকে বাড়ির বাইরে বসিয়ে রাখল। আর ভেতরে চারজন মিলে তার স্ত্রী সর্মিলাকে ধর্ষণ করল। আর্মিরা চলে যাবার পর নিতাই ছুটে এলো হাশেম মৃধার কাছে। কেঁদে গড়াগড়ি করে বলল-‘ও দাদা, কইয়া দ্যান আমি এহন কী করুম?’ হাশেম মৃধা বলল-‘কুত্তায় যদি পায়ে কামড় দেয় তো পায়ের কী দোষ? মানুষ কি পাও কাইটা ফালায়? তুমার বউ তুমারই আছে।’ ঠিক তখনই খবর এলো, তোদের স্কুলের বাংলার শিক্ষক মনোরঞ্জন দাসকে আর্মিরা হত্যা করেছে এবং তার যুবতী মেয়ে নীলুকে ধরে নিয়ে গেছে তাদের ক্যাম্পে। হাশেম মৃধা গা ঝারা দিয়ে উঠে বলল- ‘এহন চলো, যুদ্ধে যাই। পিঠ দেয়ালে ঠেইক্যা গেছে। যুদ্ধ ছাড়া এহন আর কোনো পথ নাই।’ রাতের আঁধারে বাবা-মা, স্ত্রী আর ঘুমন্ত পুত্রদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাশেম মৃধা মুক্তিযুদ্ধে যাচ্ছিল। সে বড় ছেলে কাশেম মৃধার কপালে বিদায় চুম্মন আঁকতেই সে চোখ খুলে বলল-‘কই যাও বাপজান?’ -‘ও আল্লা! আমার বাপ দেখি ঘুমায় নাই।’ -‘কই যাও বাপজান?’ -‘যুদ্ধে যাইতেছিরে বাপ-যুদ্ধে যাইতেছি।’ -‘তুমার সাথে আমিও যামু বাপজান।’ -‘তুমার এহন যুদ্ধে যাওয়ার দরকার নাই বাপ। আমরা দ্যাশ স্বাধীন কইরা আসি, তুমার সামনে আরও বড় যুদ্ধ আছে।’ -‘দ্যাশ স্বাধীন অইয়া গেলে আবার কিসের যুদ্ধ?’ -‘তারপরই আসল যুদ্ধ। বড় হও তহন বুঝবা। আমাগো যুদ্ধতো জিতা গেলেই শ্যাষ। তুমাগো যুদ্ধের কোনো শ্যাষ নাই। সারা জীবন চলতেই থাকব দ্যাশ গড়ার যুদ্ধ।’ ॥ চার ॥ হাশেম মৃধার বড় ছেলে কাশেম মৃধার মেট্রিকের রেজাল্ট বের হওয়ার কয়েক দিন আগে হাশেম মৃধা মারা গেল। এবং তার কিছুদিন পরই তার স্ত্রী। স্ত্রী অবশ্য অনেক দিন ধরেই শয্যাগত ছিল। তারই যাবার কথা ছিল আগে। বাবা-মা’র মৃত্যুতে তিন ছেলেই সমানভাবে শোকে মুসড়ে পড়ল। মেট্রিকের রেজাল্ট বের হলো। কাশেম মৃধা পাস করল। কিন্তু তার আর কলেজে ভর্তি হওয়া হলো না। তার কাঁধে নেমে এলো গোটা সংসারের বোঝা। সে লেখাপড়া করতে গেলে ছোট ভাই দুইটার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে। সে স্বার্থপর হতে পারল না। তার চেয়ে যদি ছোট ভাই দুটিকে মানুষ করতে পারে সেটাই হবে মঙ্গলজনক। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর মেঝো ছেলে রজব মৃধা অন্যরকম হয়ে গেল। সে স্কুল ছেড়ে দিল। মজে গেল ধর্ম-কর্মে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। কোরআন তেলওয়াত করে। তসবি জপে। জিকির করে। কাশেম মৃধা বলল-‘ধর্ম-কর্ম করবি ভালা কথা। তাই বইলা স্কুল ছাইরা দিতে অইবো? ধর্মে কি শিক্ষা নিষেধ করছে? আমাগো স্কুলের মৌলভী সাবের কথাই ভাব। রবীন্দ্রনাথের সব বই তার পড়া। তার ধর্ম কি নষ্ট অইয়া গেছে?’ রজব মৃধা বড় ভাইয়ের এসব কথার বিপরীতে কোনো আওয়াজ করে না। স্কুলেও যায় না। সে তসবিতে আঙুল চালায় আর নীরবে জপ করে। কোন উপায়ন্তর না দেখে কাশেম মৃধা তাকে গ্রামের মাদ্রাসায় হাফেজি পড়তে পাঠায়। রজব মৃধা খুশি মনে কোরআন শরীফ মুখস্থের কাজে লেগে যায়। তার কণ্ঠ ভাল। সে মাদ্রাসার অন্য সব ছেলেদের চেয়ে সুন্দর করে কোরআন পাঠ করতে পারে। তার আচার-আচরণও অন্যদের চেয়ে ভাল। অপ্রয়োজনে কথা বলে না। কথা বলার সময় উচ্চকণ্ঠ করে না। খাবার-দাবার, পোশাক-আশাক এবং জাগতিক সম্পদ-সম্পত্তির প্রতি তার কোন খেয়াল নেই। তার ধ্যান শুধু পরকাল। হাফেজি শেষ করে সে গ্রামের মসজিদে খাদেম হিসাবে চাকরি পায়। আর হাশেম মৃধার ছোটা ছেলে ফজল মৃধা? সে লেখাপড়ায় লেগে রইল। কিন্তু লেখাপড়ার চাইতে নেতাগিরিতে তার মন বেশি। ডানপিটে ছেলে হিসেবে গ্রামে তার দুর্নাম। মেট্রিক পাস করে ফজল ছুট দিল ঢাকায়। ঢাকায় গিয়ে সে একটা কলেজে ভর্তি হলো। গ্রামের স্কুলে তাকে জোর করে নেতা হতে হতো। এখানে নেতা হওয়ার সিস্টেমই আছে। যেখানে ফার্স্ট ইয়ারের আর সব ছেলেরা চুপসে থাকে সেখানে সে ওপরের ক্লাসের ছেলেদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুললো। ছাত্র-সংসদ কেন্দ্রে যায়। নেতাদের কথা শোনে। নিজেও বলে। ক’দিন পর কলেজের নির্বাচন। একটা পদ পেয়ে গেল সে। একেতো গ্রাম থেকে এসেছে, ভেতরে প্যাঁচ কম, বাইরে রাজনৈতিক দক্ষতার স্ফূরণ। সে জিতে গেল নির্বাচনে। তারপর আর তাকে পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি। দুই বছরের কলেজ জীবন সে শেষ করেছে ছয় বছরে। এর মধ্যে ছাত্র সংসদের ভিপি হয়েছে, জিএস হয়েছে। কলেজের একচ্ছত্র দাপটের অধিকারী হয়েছে সে। তখন থেকেই এ দেশের ছাত্র রাজনীতির কলুষিত হওয়া শুরু। ক্ষমতাসীনরা তাকে ব্যবহার করতে থাকে। বিনিময়ে তাকে দেয় টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজির অবাধ সুযোগ। সে টাকা কামাতে থাকে দুই হাতে। কলেজ থেকে বেরিয়ে সে আর লেখাপড়ায় যায় না। শুরু করে রাজনীতি, সঙ্গে ব্যবসা (বৈধ এবং অবৈধ)। সে ঢাকায় কয়েকটা জায়গায় প্লট কিনে ফেলে। সাংসারিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কাশেম মৃধার যথাসময়ে বিয়ে করা হয় না। যখন তার ওপর থেকে সাংসারিক চাপ কমে আসে তখন দেখে তার বিয়ের বয়স অতিক্রান্ত। সে নিজের ঘর-সংসারের চিন্তা বাদ দিয়ে ছোট দুই ভাইকে বিয়ে দেয়ার চেষ্টায় নামে। কিন্তু ভাইয়েরা তার সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হয় না। তাদের মানুষ করতে গিয়ে ভাইয়ের জীবন ব্যর্থ হবে তা তারা চায় না। তারা গোঁ ধরে বড় ভাই বিয়ে না করলে তারাও বিয়ে করবে না। শেষে কাশেম মৃধা বিয়ে করতে সম্মত হয়। রজব মৃধা আর ফজল মৃধা মিলে ভাইয়ের জন্য মেয়ে খুঁজতে শুরু করে। খুঁজতে খুঁজতে পেয়েও যায় একটা। গরিব বাবার মেয়ে। তেমন লেখাপড়া শেখাতে পারেনি। মেয়ের বিয়েতে কিছু দেয়া তো দূরের কথা, সামান্য খরচ করার সামর্থ্যও নেই। স্বাভাবিকভাবেই তার বিয়ে হয়নি। সেই মেয়েটিকেই তারা ভাইয়ের বউ হিসেবে নির্বাচন করে। বড় ভাইয়ের বিয়ের পরপরই রজব মৃধা যে মাদ্রাসায় পড়েছে সেই মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষকের মেয়েকে বিয়ে করে সংসারী হয়। আর ফজল মৃধা গ্রামের মেয়ে বিয়ে করবে না। ভাইয়েরাও সেটা চায় না। তাদের ভাই যেরকম শহুরে হয়ে গিয়েছে, তাতে গ্রামের মেয়ের সঙ্গে তার মিল হবে না। ফজল মৃধার মেয়ে পছন্দ করাই ছিল। তারই এক সহপাঠী। বড়লোক বাবার আদূরে মেয়ে। তিন বার আইএ পরীক্ষা দিয়ে ফেল করে ক্ষান্ত দিয়েছে। দুই মাসের ব্যবধানে তিন ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেল। ॥ পাঁচ ॥ তারপর কেটে গেছে অনেকটা সময়। পলি জমে বন্ধ হয়ে গেছে ইছামতির স্রোতধারা। মৃতপ্রায় হয়ে গেছে প্রমত্ত পদ্মা। এখন তারা তিন ভাই প্রত্যেকে একটি করে পুত্র সন্তানের জনক। ছেলেদের সবার বয়সই ১৩/১৪-এর মধ্যে। কাশেম মৃধা আর রজব মৃধা এক সঙ্গেই আছে। ফজল মৃধা ঢাকায়। তার নামে এখন মৃধা-টিধা নাই। ঢাকায় তার পরিচয় ফজলুর রহমান খান। সে বড় এক রাজনৈতিক দলের প্রথম সারির নেতা। বিশেষ উৎসবে সে বউ-ছেলে নিয়ে গ্রামে আসে। ইদানীং আসছে খুব ঘন ঘন। এসেই গ্রামের মানুষের সঙ্গে খুব মেলামেশা করছে। যাকে-তাকে বুকে জড়িয়ে ধরছে। স্কুল-কলেজ-ক্লাবে টাকা দিচ্ছে। গরিবদের সাহায্য করছে। এর পেছনের কারণ, সে সামনে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে। একটা বিষয় এতদিন কারও নজরে পড়েছিল না। তাদের তিন ভাইয়ের মধ্যে যেমন অন্তরঙ্গ মিল, তাদের ছেলেদের সঙ্গে তেমনটি নয়। তারা যে আপন চাচাতো ভাই-রক্তের সম্পর্কে সম্পর্কিত এ বিষয়টি তারা যেন জানেই না। তারা তিনজন যেন তিন ভুবনের তিন বাসিন্দা। পরস্পরের কাছে এলিয়েন। ॥ ছয় ॥ এক সকালে কাশেম মৃধা উঠোনে বসেছিল অলসভাবে। তখন ঘরের ভেতর তার ছেলে আদিত্য আর ছোট ভাই ফজলের ছেলে লিংকনের কথা শুনতে পায়। লিংকন-‘হোয়াট আর ইউ ডুয়িং?’ আদিত্য-‘একটা বই পড়ছি?’ -‘রাইটার?’ -‘পল্লী কবি জসীমউদ্দীন।’ -‘হু ইজ হি?’ -‘তুমি পল্লী কবি জসীমউদ্দীনকে চেন না (রাগত কণ্ঠ)?’ -‘আমি তো বাংলা স্টোরি পড়ি না। একচুয়ালী বই পড়া বোরিং টাস্ক টু মি। আমি ভিডিও গেম খেলি, কার্টুন দেখি, ফেসবুক করি, ইন্টারনেট সার্স করি, ডাউনলোড-আপলোড নিয়ে বিজি থাকি। তোমার ফেসবুক একাউন্ট নেই?’ -‘না।’ -‘হাও স্ট্রেঞ্জ! তোমার দেখছি মডার্ন ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে কানেকশন নেই। ব্যাক ডেটেড।’ -‘আমি বই পড়ি, ছবি আঁকি, গান শুনি।’ -‘কী গান শোন?’ -‘দেশাত্ববোধক, রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল গীতি, পল্লী গীতি, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া।’ -‘ঠু মাচ বোরিং। পপ-ব্যান্ড-র‌্যাপ শোনো না? ম্যাডোনা, লেডি গাগা, ব্রিটনি স্পিয়ার্স, শাকিরা, জাস্টিস বিবার, সেলেনা গোমেজ...।’ -‘ও সব কি আমাদের?’ -‘আমাদের সব তো ব্যাকডেটেড। ডু ইউ ওয়ান্ট টু রিমেইন ব্যাকডেটেড?’ -‘নিজের দেশ, ভাষা আর ঐতিহ্যকে ভালোবাসলে ব্যাকডেটেড হয়? শেকড়হীন বৃক্ষ।’ -‘হোয়াট? হোয়াট ডু ইউ মিন বাই শেকড়হীন বৃক্ষ?’ -‘রুটলেস ট্রি।’ -‘আমি তো এ লেভেল দিয়ে মেরিকা চলে যাব। এই দেশের কোনো কিছুই আমার ভালো লাগে না।’ -‘নিজের দেশের কোনো কিছুই যার ভালো লাগে না, তার মতো নির্বোধ আর কেউ নেই।’ -‘নির্বোধ!’ -‘হ্যাঁ নির্বোধ, ফুলিস-এদেশের আলো-বাতাসে বেড়ে উঠে...।’ -‘তুমি আমাকে গালাগাল দিচ্ছো। ইউ আর বেগার। বেগাররা তো পউর কান্ট্রিকেই ভালোবাসবে। পারবে মেরিকা যেতে?’ -‘এই বেগারদের টাকা-পয়সা লুটে তোমার বাবা বড়লোক হয়েছেন, এখন তোমাকে বেগারদের ঘৃণা করতে শিখিয়েছেন, ভালোবাসতে শিখিয়েছেন মেরিকাকে। মনে রেখ, আমরা বেগার হলেও তোমার মতো ডেভেলভড কান্ট্রিতে গিয়ে লেবার হবার স্বপ্ন দেখি না। আমাদের যা আছে তাই নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি। তুমি মেরিকা মেরিকা করছো। তুমি জানো এই ভাষার জন্য আমাদের দাদা স্লোগান তুলে মিছিল করেছিলেন? এই দেশের জন্য আমাদের দাদা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছিলেন?’ -‘গ্র্যান্ডফা’র এজ ইজ পাস্ট।’ -‘কিন্তু তার দেশ আর ভাষা আছে।’ -‘সে সব ধরে বসে থাকলে চলবে?’ -‘তাহলে দেশের ঠাকুর ফেলে বিদেশের কুকুর নিয়ে নাচানাচি করলে চলবে?’ -‘দে আর ডেভেলভড।’ -‘আমরা তাদের চেয়ে বেশি উন্নত। শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-বিজ্ঞান কোনো কিছুতেই আমরা তাদের থেকে পিছিয়ে নেই। জানো, এই ক’দিন আগে গণিত অলিম্পিয়াডে আমাদের দেশের একটা ছেলে রানার্স আপ হয়েছে। দু’জন পেয়েছে ব্রোঞ্জ পদক। পদার্থ অলিম্পিয়াডে আমাদের একটি মেয়ে ব্রোঞ্জ পদক জিতেছে আর তিনজন পেয়েছে অনারেবল মেনশন। আমরা যেটুকু পিছিয়ে আছি তা তোমাদের মতো শেকড়হীনদের জন্য।’ -‘স্টপ! স্টপ! এই জন্যই মেঝো চাচার ছেলে কাদির তোমার সঙ্গে মেশে না।’ -‘মেশে না না, তার সঙ্গেও মেশা যায় না। তুমি যেমন কথার মধ্যে ইংরেজী ঢুকিয়ে আধুনিক হতে চাও, সেও তেমনি আরবি-উর্দু ঢুকিয়ে খাঁটি মুসলিম হতে চায়। তোমার মন যেমন পড়ে আছে মেরিকা, তার মন তেমন আরবে। তুমি যেমন দেশের সবকিছু ভুলে, সবকিছুকে ঘৃণা করে মডার্ন হতে চাও, সে তেমন সবকিছুকে ভুলে ও ঘৃণা করে বেহেশত পেতে চায়। এই দেশ, দেশের মানুষ, এই ভাষা এসবকে ভালবাসলে তার বেহেশত ফসকে যাবে।’ ঠিক তখনই কাদির সেই ঘরে ঢুকল। ঢুকেই লম্বা করে সালাম দিল। লিংকন সালামের উত্তরে অভ্যস্ত নয়। সে হাই, হ্যালো-তে অভ্যস্ত। আদিত্য সালামের উত্তর দিল। সে ঢুকেই লিংকনকে বলল-‘তুমি এরকম পোশাক পড়ছো কেন? এরকম পোশাক পড়া ইসলামে নিষিদ্ধ। আরবীদের পোশাক দেখ না?’ আদিত্য বলল-‘এবার ঠ্যালা সামলাও।’ লিংকন বলল-‘হোয়াট ক্লাস ডু ইউ রিড ইন?’ কাদির বলল-‘আমি তোমার কথা বুঝতে পারলাম না।’ -‘ওয়া! তুমি দেখছি...। আমি বলেছি তুমি কোন ক্লাসে পড়?’ -‘আনা উদরুস ফিল মাদরাসা।’ -‘হোয়াট!’ আদিত্যের মুখে মিটিমিটি হাসি। বিড়বিড় করে বলল-কেউ কাউকে বুঝতে পারছো না। ভাষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লা এগারোটা ভাষা জানতেন। তারপরেও মাতৃভাষাই ছিল তাঁর কাছে সবচেয়ে আদরের। তারপর তিনজনের বাকযুদ্ধ : কাদির : তুমি ইংগারাজি বলো কেন? পারলে আরবি বলো-উর্দু বলো-ফার্সি বলো। এগুলো ইসলামের ভাষা। আমি কোরআন হেফজ করছি। তারপর দাখিল দেব। কামিল পাস করে আমি চলে যাব মক্কার উম্মুল কুরা বিশ্বদ্যিালয়ে। এদেশে পড়বো না। এদেশে পড়তে গেলে ইমান ঠিক রাখা কঠিন। এখানে সব নাস্তিকদের দল। বেহেস্তে যে ভাষায় কথা বলব এখানে সেই ভাষায় কথা বলা যায় না। ওর কথা ভাব-গল্প পড়ে, ছবি আঁকে, গান শোনে-সব শয়তানি কাজ। দুনিয়ায় পরকালের চিন্তা ছাড়া আর কিছুই করা ঠিক না। আদদুনয়া মাজরআতুল আযিরাহ। আদিত্য : তোমার যে জ্ঞান, সেই জ্ঞান নিয়ে তুমি আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগই পাবে না। তুমি পড়বে উম্মুল কুরায়। সেটাই তোমার জন্য উপযুক্ত। সেখানে যে কী শেখায় তা তো বোঝাই যাচ্ছে। তোমরা এই মুহূর্তে আমার ঘর থেকে চলে যাও। লিংকন : তোমরা দু’জনই ব্যাকডেটেড। কাডির একেবারেই। আদিত্য : তোমরা দু’জন অদূর ভবিষ্যতে নিজেদের পিতৃ পরিচয় মনে রাখতে পারবে কি না সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। একজনের চোখে ইউরোপ-আমেরিকা আর মুখে ভুল ইংরেজী, আরেকজনের চোখে আরব-পাকিস্তান-আফগানিস্তান, আর মুখে আরবি, ফার্সি, উর্দু। কাদির : তোমরা দু’জন পথভ্রষ্ট। তোমরা ইসলামের শত্রু। তোমাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন। উনছুরনা আলাল কওমিল কাফিরিন। আমরা কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করব। তোমাদের একেকটাকে হত্যা করা মানেই মহান রাব্বুল-আল আমিনের কাছে আরও প্রিয় পাত্র হয়ে যাওয়া। মনে রেখ-আমি উম্মুল কুরা থেকে ফিরে এসে এ দেশে জিহাদী দল গড়ব। জিহাদীদের জন্য কবরেও জিকির হয়। আদিত্য : তুমি উম্মুল কুরায় যাবার আগেই জেহাদী দলে ঢুকে যেতে পার। তোমার কাছে যেটা জেহাদী দল, আমার কাছে সেটা জঙ্গী দল। তোমার কাছে যেটা জেহাদ, আমার কাছে সেটা জঙ্গীপনা। লিংকন : তুমি আমার একটা হেয়ারও টাচ করতে পারবে না। আমি তখন থাকব...। ছুটে এলো কাশেম মৃধা। আর্তনাদ করে বলল-‘রজব, ফজল তোরা এই দিকে আয়। তোরা তো সর্বনাশ করছোস। আমাগো বাপ সে ভাষার জন্য ছলোগান দিছে, যে দ্যাশের জন্য যুদ্ধ করছে তোগো পোলারা এহন হেই ভাষা আর হেই দ্যাশরে নিজের মনে করে না। বাপ আমারে কইছিল, যুদ্ধে জেতা দ্যাশ গড়ার দায়িত্ব আমাগো। এই কি আমাগো দ্যাশ গড়া? তিন ভাগের দুই ভাগই তো এই দ্যাশের না। দ্যাশের আর থাকল কী?
×