ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রবাসীদের মাতৃভাষা প্রীতি

প্রকাশিত: ১২:৪৪, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০

 প্রবাসীদের  মাতৃভাষা  প্রীতি

স্কুল জীবনে আমার একজন সহপাঠী ছিল আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। না, আপনারা যে মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের কথা ভাবছেন যিনি ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার অধিকার আদায়ে সংগ্রামরত ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশী নির্যাতনের সংবাদ পেয়ে প্রাদেশিক পরিষদ থেকে বেরিয়ে এসে মহান ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করেন, ইনি তিনি নন। ইনি আমাদের ক্লাসের পেছনের বেঞ্চে বসা অতি মেধাবী একজন বন্ধু, রশীদ। আমাদের পন্ডিত স্যার তার গুণে অতিষ্ঠ হয়ে নাম দিয়েছিলেন আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। প-িত স্যারের তখন বেশ বয়স হয়েছে। অবসরে যাওয়ার বয়স শেষ হওয়ার পরও স্কুল কমিটি বিশেষ বিবেচনায় তাকে কাজ করার সুযোগ দিয়েছেন। তিনি যেমন বিজ্ঞ তেমনি আবেগী মানুষ ছিলেন। সুন্দর সুন্দর উদাহরণ দিয়ে অনেক আবেগ মিশিয়ে তিনি আমাদেরকে পড়াতেন। এই উদাহরণ আর বিষয়ের সামঞ্জস্য নিয়ে তর্ক হতো রশীদের সাথে। রশীদ পাল্টা একটা উদাহরণ দিয়ে স্যারের সমস্ত বক্তব্যকে অসার পরিণত করে দিত। আমাদের কাছেও তখন স্যারের কথার থেকে রশীদের কথাকেই বেশি যুক্তিযুক্ত মনে হতো। যেমন তিনি একদিন ক্লাসে মাতৃভাষার গুরুত্ব বিষয়ে পড়াচ্ছিলেন, - আমরা আমাদের মনের ভাব প্রকাশ করি কথা বলে। আমরা সব সময় নানা বিষয় নিয়ে যখন যা মনে হয় তাই বলতে পারি। যে কারণে কথা বলাটা যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা আমরা বুঝতে পারি না। যেমন বাতাসের ভেতরে বসবাস করে আমরা বাতাসের গুরুত্ব বুঝতে পারি না। তোমাদের যদি একদিন কথা না বলে থাকতে বলা হয় তখন বুঝতে পারবে এটা কতটা অসম্ভব আর কষ্টকর ব্যাপার। রশীদ সটান দাঁডিয়ে পড়ে স্যারের যুক্তি খন্ডন শুরু করল। যেন এটা তার ঈমানি দায়িত্ব। - স্যার, বোবারা তো কথা বলে না। তাদের তো কোন অসুবিধা হয় না। আমাকে বললে আমি সাত দিন কথা বন্ধ করে থাকব। আমার কিছুই হবে না। আমার বাবা-মা তো ঝগড়া করে দু’তিন দিন ইচ্ছা করেই কথা বলে না। আমি তো কোন অসুবিধা দেখি না। এমন ব্যক্তিগত অকাট্য যুক্তি শুনে ক্লাসশুদ্ধ সবাই হো হো করে হেসে উঠল। স্যার বললেন, আপাতত তুমি আমার ক্লাসের সময়টুকু চুপ থাক, দেখি কেমন পার। আমরা আবার একচোট হাসলাম এবং মনে মনে ভাবলাম রশীদের কথায় যুক্তি আছে। স্যার আবেগ মিশ্রত কণ্ঠে আবার পড়ানো শুরু করলেন, - কবি বলেছেন, ‘নানান দেশের নানান ভাষা/বিনে স্বদেশী ভাষা মিটে কি আশা’। কবি এখানে স্বদেশী ভাষা বলতে মাতৃভাষার কথা বুঝাতে চেয়েছেন। রশীদ কিছু একটা বলার জন্য উসখুস করে চুপ করে গেল। আমরা একবার রশীদের দিকে, একবার স্যারের মুখের দিকে তাকালাম। স্যার বললেন, মাতৃভাষা হলো বাতাসের অক্সিজেনর মতো। কোন অক্সিজেনহীন পরিবেশে যেমন আমাদের দম বন্ধ হয়ে যাবে তেমন মাতৃভাষাহীন পরিবেশেও আমাদের দম বন্ধ হয়ে আসে। রশীদ এবার আর চুপ থাকতে পারল না। বলল, আমার মামা বিদেশ থাকে। ফটফট করে ইংরেজী বলতে পারে। তার তো কখনও দম বন্ধ হওয়ার কথা শুনিনি! তাছাড়া চাঁদেও তো বাতাস নেই । সেখানেও তো মানুষ যায়। কেউ তো দম বন্ধ হয়ে মারা যায় না। স্যার বললেন, যারা চাঁদে যায় তারা তো অক্সিজেন সিলিন্ডার সাথে নিয়ে যায়। আর বিদেশে যারা থাকে তাদেরকেও কোন না কোন আত্মীয় বন্ধু খুঁজে নিতে হয় একটু নিজের ভাষায় কথা বলার জন্য। নিজের ভাষায় কথা বলতে না পারা খুবই কষ্টের। সেই স্কুলে পড়া বয়সে প্রবাসী মানুষদের মাতৃ ভাষায় কথা বলতে না পারার কষ্টটা কেমন তা আমরা ভেবে দেখার প্রয়োজন বোধ করিনি। বরং উল্টো মনে হয়েছে, ইস্! বড় হয়ে যদি রশীদের মামার মতো বিদেশ যেয়ে ফটফট করে ইংরেজী বলতে পারতাম, তা হলে কি মজাটাই না হতো। বড় হয়ে সত্যিকারেই যখন বিদেশে চলে এলাম তখন বুঝতে পারলাম, মাতৃভাষা এবং দেশপ্রেম জিনিসটা আসলে কি। স্কুলে পড়ার সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ রচনা ছিল এ দুটি। রচনা দুটোর পাশে ভি ভি আই লিখে রাখতাম - যেমন সবাই লেখে। মুখস্ত করে পরীক্ষায় অনেক অনেক নম্বর তোলে। অথচ আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি দেশে যারা বসবাস করে আর যারা প্রবাসী তাদের মধ্যে এ দুটো বিষয়ের অনুভূতির যোজন যোজন ফারাক। দেশে বসবাসকারীদের ইতিবাচক কল্পনাশক্তিও কোনভাবেই প্রবাসীদের অনুভূতির কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে না। প্রবাসের মাটিতে পথ চলতে কারো মুখে বাংলা শব্দ শুনলে তাকে ডেকে কথা বলতে ইচ্ছা করে - ডেকে কথা বলি। একটা বাংলা সাইন বোর্ড লেখা দোকান দেখলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে যাই। মনে হয় এটি আমাদের নিজেদের দোকান। সময়ের সাথে সাথে প্রবাসেও এখন অনেক জায়গায় বাঙালীর সংখ্যা বেড়েছে। সেসব জায়গায় নানান উছিলায় বাঙালিরা একত্রিত হয়। সেখানে যেমন ঘরোয়া অনুষ্ঠান আছে - আছে পিকনিক। তেমন আছে নানান বাঙালিয়ানা অনুষ্ঠান। পহেলা বৈশাখ, বইমেলা, বাঙলা কনসার্ট, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস আর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মতো হরেক আয়োজন। এসব আয়োজনের একটি মূল উদ্দেশ্য থাকেÑ বাঙালিরা সবাই একত্রিত হওয়া। সবাই মিলে একটু প্রাণ খুলে বাঙলায় কথা বলা। এখন প্রবাসেও বিভিন্ন বড় বড় শহর থেকে বাংলা পত্রিকা বেরোয়। অনেক বাংলা রেডিও টিভি চালু হয়েছে। বাঙালিদের উদ্যোগে প্রবাসের বিভিন্ন এয়ারপোর্ট, হাসপাতালের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠানের প্রবেশ মুখে বাঙলায় লেখা থাকে স্বাগতম। প্রবাসে বসেও বাঙালিরা শিল্প-সাহিত্য-সংগীতের চর্চা করে। পরবর্তী প্রজন্মরা যাতে বাঙলা ভুলে না যায় তার প্রচেষ্টা থাকে প্রতিটি বাঙালি পরিবারেই। নিউইয়র্কের মতো বাঙালি অধ্যুষিত কিছু কিছু এলাকায় বাঙলা স্কুল গড়ে উঠেছে। কোথাও কোথাও রাস্তা এবং এলাকার নামকরণ হয়েছে বাঙলায়। দেশের ছেলেমেয়েরা এখন ইন্টারনেটের যুগে আধুনিক হওয়ার জন্য বাঙলা-ইংরেজী মিলিয়ে ভাষার ক্ষেত্রে একটি নতুন ধারা নিয়ে এসেছে। ইংলিশ মুভি, ইংলিশ মিউজিকের ভক্ত হয়ে উঠছে। অন্যদিকে কাজের প্রয়োজনে প্রবাসীদের বিদেশী ভাষা শিখতে হয় - বলতে হয়। কিন্তু সুযোগ পেলেই হেডফোনে বাঙলা গান শোনে, গাড়িতে বাঙলা গান বাজায়। বাঙলা ভাষার জন্য প্রবাসীরা যা কিছু ভূমিকা রেখেছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় অর্জন আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারি - শহীদ দিবস আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এ বিষয়ে কানাডাপ্রবাসী বাঙালি আবদুস সালাম ও রফিকুল ইসলামের ভূমিকা অগ্রগণ্য। তারা তাদের সংগঠন কানাডার বহুভাষিক ও বহুজাতিক মাতৃভাষা- প্রেমিকগোষ্ঠীর মাধ্যমে প্রথমে ১৯৯৮ সালে জাতিসংঘে এবং পরে ইউনেস্কোর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরবর্তিতে ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সক্রিয় সহযোগিতা ও কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রস্তাবটি নিয়মানুগভাবে ইউনেস্কোর ৩০ তম অধিবেশনে উত্থাপন করা হয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর সেই সভায় একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরের বছর ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে পৃথিবীর ১৮৮টি দেশে এ দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন শুরু হয়। এখন নিউইয়র্কে জাতিসংঘ ভবনের সামনে শহীদ মিনার বানিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়। এই অর্জন একদিকে যেমন বাঙালি ও বাংলা ভাষার অর্জন তেমনি সারা বিশ্বের সকল মাতৃভাষার গুরুত্বের একটি স্বীকৃতি। প্রবাসী বাঙালিরা অন্যান্য ভাষাভাষীর এই একটি দিনে স্মরণ করিয়ে দিতে পারে- এই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ইতিহাসটি আমাদের বাংলাদেশের। আমরা সেই জাতি যারা ভাষার জন্য একটা দেশকে স্বাধীন করেছি - সে দেশের নাম বাংলাদেশ। পরিশেষে আমার সেই পন্ডিত স্যারের একটি উক্তি সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। স্যার বলতেন, ‘যে কোন অর্জন নিয়ে আত্মতুষ্টি লাভ করা মানেই থেমে যাওয়া।’ আমাদের ভাষাকে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠা পেতে হলে জ্ঞান, বিজ্ঞান, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। একজন মাত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম ভাঙিয়ে আর কতদিন?
×