ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রেজওয়ান আহমেদ

আন্তর্জাতিক ধ্বনিতাত্ত্বিক বর্ণমালায় বাঙলা

প্রকাশিত: ১৩:০২, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০

আন্তর্জাতিক ধ্বনিতাত্ত্বিক বর্ণমালায় বাঙলা

সামার ইনস্টিটিউট অব লিঙ্গুইস্টিকস -এস. আই. এল.। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা। ২০০৯ সালে এই সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছে বিশ্বে ৬,৯০৯টি ভাষা প্রচলিত আছে। ভাষা একটি গতিশীল মাধ্যম। সে কারণে প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল ভাষাসংক্রান্ত পরিসংখ্যানও। এ তথ্যের সত্যতা নিরূপণ করে ২০১৮ সালের হিসাব। ২০০৯ থেকে ২০১৮ -এই নয় বছরে বিশ্বের ভাষার তালিকায় যোগ হয়েছে আরও প্রায় ২০০টি নতুন ভাষা। ফলে চলতি হিসাবে বিশ্বে প্রচলিত ভাষার সংখ্যা দাঁড়ায় ৭০৯৭টিতে। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভাষার দেশ বলা হয় পাপুয়া নিউগিনিকে। ঔপনিবেশিকতাবাদ, ব্যাবসা-বাণিজ্যের প্রসার প্রভৃতি নানা কারণে সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যমতে সেদেশে প্রচলিত ভাষার সংখ্যা ৮৫৬টি। তবে এর মধ্যে তিনটি ভাষাকে সমধিক প্রচলিত বলা যায়- টোক পিসিন, ইংরেজী এবং হিরি মোতু বা হিরি। প্রশ্ন হচ্ছে ভাষার সংখ্যা কি শুধু বেড়েই যায় দিন দিন? নাকি কমতেও পারে? প্রসঙ্গত পেরুর অধিবাসী আমাদের এবং নেপালের অধিবাসী জ্ঞানীমায়া সেনের নাম উল্লেখ করা যায়। এরা যার যার মাতৃভাষার সর্বশেষ ভাষাভাষী। এদের ভাষা যথাক্রমে ‘তাসিরো’ এবং ‘কুসুন্দা’। এই দুই ভাষার দুই ভাষীর মৃত্যু ভাষা দুটিরও মৃত্যু ঘটবে। তবে আশার কথা ভাষা দুটির সংরক্ষণে দুই দেশের সরকারই উদ্যোগী। জানা গেছে, দুটি ভাষারই আলাদা অভিধান তৈরি করা হয়েছে প্রচলিত শব্দভান্ডার নিয়ে। এর বাইরে সংশ্লিষ্ট ভাষায় প্রচলিত গানের রেকর্ড, কিছু লোককথা, গল্পও এরূপ সংরক্ষণ প্রক্রিয়ার আওতাধীন। এবার ফিরি ৭০৯৭ ভাষার কথায়। এত এত ভাষা, জানা যায় সাড়ে তিন হাজারের মতো ভাষার রয়েছে লিখিত রূপ। বাকিগুলো শুধু মুখে মুখেই প্রচলিত। যেসব ভাষায় লিখিত রূপ পাওয়া যায়, সেসবে রয়েছে ৪৬ ধরনের বর্ণমালার চল। তবে লিখিত হোক বা মৌখিক, সব ভাষা কিন্তু সমানভাবে প্রচলিত নয়। ভাষাভাষী জনসংখ্যার ভিত্তিতে ভাষার গুরুত্ব নিরূপিত হয়। অবশ্য আগের অনুচ্ছেদে উল্লিখিত ‘কুসুন্দা’ ভাষা মৃতপ্রায় হলেও তার কিন্তু ভালই গুরুত্ব¡ আছে বলে জানা যায়! পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি ভাষাভাষী মানুষের ব্যবহৃত ভাষা ২৩টি। প্রশ্ন হচ্ছে, একটা মানুষের পক্ষে ২৩ ভাষা জানা কতটা বাস্তবসম্মত? বহুভাষাবিদ পন্ডিত ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ জানতেন ১৮টি ভাষা। সবার পক্ষে এ রকম প্রসঙ্গ ব্যক্তিত্ব হওয়া সম্ভব নয়। আমরা যদি একজন ইংরেজ, একজন আরবীয় আর একজন বাঙালীকে এক টেবিলে বসিয়ে একটি বাক্য উচ্চারণ করতে বলি- কলমটার দাম ত্রিশ টাকা- তাহলে যে ঘটনাটি ঘটবে তা হলো - বাঙালী ঠিকঠাকই উচ্চারণ করে দেবে। বিপত্তি ঘটবে ইংরেজ আর আরবীয়কে নিয়ে। একদিকে ইংরেজ বলবে- কলমটার ডাম ট্রিশ টাকা, অন্যদিকে আরব লোকটি তার আরবি উচ্চারণে বলবে কলমতার দাম ত্রিশ তাকা। এর কারণ হচ্ছে, বাঙলায় /ত/, /ট/ - দুটি ধ্বনি থাকলেও ইংরেজীতে /ত/ নেই, তাই ইংরেজী ঞ দিয়ে /ত/ - এর কাজ সেরে নেবে। অনুরূপে আরবি বর্ণমালায় /ট/ না থাকায় ॥ণ্ড॥ অথবা ॥দ্ব॥ দিয়ে /ট/ - প্রয়োজন মেটাবে। এতে আপাতদৃষ্টিতে দোষের কিছু নেই। সমস্যাটা হচ্ছে অন্য ভাষার সকল বর্ণের সঠিক প্রতিস্থাপক বর্ণ সকল ভাষায় নেই। ফলে অর্থগত বিভ্রান্তির মুখেও পড়তে হয় সচরাচর। উদাহরণস্বরূপ পাশ্চাত্যের কাপড়ের বাজারে গিয়ে আমরা ুরঢ়ঢ়বৎ এর বদলে লরঢ়ঢ়বৎ চেয়ে বসলে প্রথমে বিপাকে পড়বে দোকানি, পরবর্তীতে অপদস্থ হব আমরা। এই অম্লমধুর সমস্যা থেকে দূরে থাকতে ধ্বনিতত্ত্বের জ্ঞান থাকা খুব প্রয়োজন। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, এই সমস্যা থেকে বাঁচার উপায় হচ্ছে আন্তর্জাতিক ধ্বনিতাত্ত্বিক বর্ণমালা (International Phonetic Alphabet বা IPA) । এ বর্ণমালার উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্বের সব মানবীয় ভাষার ধ্বনিসমূহকে নিজের আওতায় নিয়ে আসা। ওচঅ তে মোট ১০৭টি বর্ণ, ৫২টি অনুচিহ্ন এবং ৪টি ছান্দিক চিহ্নের উল্লেখ পাওয়া যায়। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায় বাচ্চারা সাধারণত বাঙলা, ইংরেজী এবং আরবি পড়ে ছোটবেলা থেকে। আরবির চর্চাটা শুধু কোরানশিক্ষায় সীমাবদ্ধ এদেশে। দৈনন্দিন কাজে আরবির ব্যবহার যতটুকুই আমরা করি, জেনে না জেনে বিক্ষিপ্তভাবে শব্দের ব্যবহারে সীমাবদ্ধ তা। বাকি থাকে বাঙলা আর ইংরেজি। উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত নম্বর পাওয়ার জন্য বাঙলা পড়ে বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রী। এরপর চাকরির বাজারে ইংরেজীর অতিচাহিদায় বাঙলা শুধু মাতৃভাষা হিসেবেই থেকে যায়। সবাই হয়ে যায় ইংরেজীর পূজারি। বাঙলা এক্ষেত্রে অবহেলিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অথচ নবম-দশম শ্রেণীর বাঙলা ব্যাকরণ নিয়ে অনেকেরই অনেক ধরনের মাথাব্যথা পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে ধ্বনিতত্ত্ব অংশটিকে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী কঠিন ভাবে। এর কারণ হিসেবে বোধ হয় এটাই যথেষ্ট যে, ধ্বনিতত্ত্বের পরিধি ব্যাপক। শিক্ষকদের বেশিরভাগের মধ্যেও ধ্বনিতত্ত্বকে কঠিন বা জটিল বিষয় হিসেবে শিক্ষার্থীদের কাছে পরিচয় করানোর প্রবণতা দৃশ্যমান। তবে সে বিষয়কে সহজীকরণের পথে হাঁটার লক্ষণ কম। শুদ্ধ উচ্চারণে বাঙলা পড়ার প্রবণতা আমাদের মধ্যে খুব কম মানুষেরই আছে। এই শুদ্ধতা কেবল শুদ্ধ চলিত বাঙলার পঠনপাঠনে সীমাবদ্ধ- এমন নয়। যেহেতু ধ্বনি ভাষার মূল একক, আমরা যদি বাঙলা ধ্বনিগুলোর প্রতিটির শুদ্ধ উচ্চারণ জানি, তাহলে আপনিতেই তথাকথিত শুদ্ধ চলিত ভাষা বেরোবে আমাদের মুখ থেকে। এজন্য আমাদের জানতে হবে ওচঅ এর মাত্র ছাব্বিশটি প্রতীকের সঠিক ব্যবহার। এগুলোর মধ্যে বাঙলা স্বরধ্বনি নির্দেশক হিসেবে ব্যবহার করতে হবে ৬টি। বাকি ২০টির কাজ যৌগিক স্বর এবং ব্যঞ্জনবর্ণের প্রতিস্থাপন। ওচঅ অনুযায়ী বাঙলা স্বরধ্বনি (উচ্চারণের সময় ঠোঁটের অবস্থা বিবেচনায় ক্রম করা): দ্রষ্টব্য - ১. (ঙ্, ং), (জ্, য্), (ত্, ৎ), (ন্, ণ্, ঞ্), (শ্, ষ্) সেটসমূহের সংশ্লিষ্ট প্রতিস্থাপক একই। কারণ, বাঙলায় বিশেষ ধ্বনিতাত্ত্বিক পরিবেশ ছাড়া এদের উচ্চারণ প্রায় অভিন্ন। ২. স্বরের দীর্ঘ উচ্চারণ প্রায়োগিক বাঙলায় তেমন দেখা যায় না। যেমনটা ইংরেজীতে দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ ঋবব শব্দটির ধ্বনিতাত্ত্বিক রূপান্তরে সঠিক ইংরেজী উচ্চারণ যেখানে ভর:, সেখানে বাঙলা উচ্চারণ অনুযায়ী এ রূপান্তর হবে ভর, অর্থাৎ দীর্ঘস্বরবিবর্জিত। এর একটা কারণ হিসেবে মনে হতে পারে বিদেশী শব্দের বানানে ঈ-কার তথা ী ভুল, ই-কার তথা ি শুদ্ধ। তবে এ কারণটি প্রমিত বানানের নিয়ম নির্দেশ করছে। উচ্চারণ আলাদা বিষয়। সে যা-ই হোক, যেখানে দীর্ঘস্বর প্রয়োজন, সেখানে সংশ্লিষ্ট স্বরের পরেই কোলন চিহ্ন তথা : ব্যবহার করা হবে। তবে বাঙলা একাক্ষর শব্দের উচ্চারণ দীর্ঘ হতে পারে কোন কোন ক্ষেত্রে । যেমন - মা (ma:) ৩. চন্দ্রবিন্দু তথা ঁ এর ক্ষেত্রে স্বরের ওপর এর প্রতীক বসবে। ব্যঞ্জনের ওপর নয়। কারণ স্বর অনুনাসিক হয়, ব্যঞ্জন হয় না। যেমন চাঁদ = ca?d ৪. * জ্ = য্ = ? তর্কাতীত নয়। জ্ এবং য্ বাস্তবে উচ্চারণগতভাবে আলাদা। আন্তর্জাতিক ধ্বনিতাত্ত্বিক বর্ণমালার গুরুত্ব: ১. প্রমিত উচ্চারণ শিক্ষায় আন্তর্জাতিক ধ্বনিতাত্ত্বিক বর্ণমালা প্রয়োজন। যেমন- অকূল শব্দটির প্রমিত উচ্চারণ ওকুল (okul) কিন্তু অপারগ শব্দটির প্রমিত উচ্চারণ অপারোগ (?parog)। কেবল বাঙলা অথবা ইংরেজী বর্ণে এরূপ প্রমিতি প্রতিবর্ণীকরণযোগ্য নয়। কারণ, ধ্বনিগত বিচারে স্বয়ংসম্পূর্ণ বর্ণমালা পাওয়া যায় না বললেই চলে। ২. আঞ্চলিক ভাষার রূপমূল নির্দেশে প্রত্যক্ষ ব্যবহার রয়েছে আন্তর্জাতিক ধ্বনিতাত্ত্বিক বর্ণমালার। যেমন- মেয়ে শব্দটি প্রমিত উচ্চারণে দ্বিস্বর (mee) /বব/ অথচ উপভাষা অঞ্চলের প্রভাবে ত্রিস্বর হয়ে যেতে পারে- মাইয়া (maia) /ধরধ/ আবার, তার শব্দটি t?ar থেকে যুৎ অর্থাৎ হ্যার হয়। কোন কোন উপভাষায়। এরকম রূপমূল নির্দেশনা সংশ্লিষ্ট ভাষায় পুরোপুরি সম্ভব নয়। কারণ সব ধ্বনির সংশিষ্ট বর্ণ বর্ণমালায় নাও থাকতে পারে। এক্ষেত্রে যেমন /y/ ধ্বনির জন্য বর্ণ বাঙলা বর্ণমালায় নেই। ৩. প্রায় সমোচ্চারিত শব্দজোটের সকলের সঠিক উচ্চারণ জানাটা দরকার। অন্যথায় অর্থবিভ্রাট ঘটতে পারে। যেমন - taste শব্দের সঠিক উচ্চারণ /teist/, verb হিসেবে যার অর্থ স্বাদ গ্রহণ করা। আবার test শব্দের সঠিক উচ্চারণ /test/, verb হিসেবে পরীক্ষা করা অর্থে ব্যবহৃত। সঠিক জায়গায় সঠিক শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ধ্বনিতাত্ত্বিক বর্ণমালার অনুসৃতি জরুরী। টয়লেটের ফ্লাশে লেখা থাকতে পারে properly tested. যদি কেউ বলে The flush is properly tasted, সেক্ষেত্রে অর্থবিভ্রাট কোন পর্যায়ে পৌঁছাবে, ভাবা যায়? ৪. আমাদের দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইংরেজীভীতি প্রকট। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, ভাষাশিক্ষার দুর্বল ভিত। কিন্ডারগার্টেন ব্যবস্থা বিশেষত ইংরেজীতে জোর দিলেও, অভিভাবকসহ সকলে এ ব্যবস্থার সুবিধা নিতে প্রস্তুত নন এখনও। এর বাইরে কিন্ডারগার্টেন ব্যবস্থার বিপক্ষে কিছু যুক্তিযুক্ত সমালোচনা রয়েছে। এ রকম অনেক শিক্ষার্থী দেখা যায়, যারা ইংরেজীর সকল বর্ণ চিনলেও একটা বাক্য, কোন কোন ক্ষেত্রে একটা শব্দ ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারে না। এ সমস্যা দূর করতে হলে কিন্ডারগার্টেন ব্যবস্থায় আন্তর্জাতিক ধ্বনিতাত্ত্বিক বর্ণমালার শিক্ষা জরুরী। এতে ভাষার ভিত মজবুত হবে সকল শিশুর। ৫. বিশ্বায়নের এই যুগে বিদেশী ভাষার শিক্ষা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। বৈশ্বিক মানবসম্পদ সৃষ্টির লক্ষ্যে তাই বিদেশী ভাষা বোঝার উপযোগী শিক্ষার্থী গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হতে পারে আন্তর্জাতিক ধ্বনিতাত্ত্বিক বর্ণমালা পাঠক্রমভুক্ত করা। লেখক- শিক্ষার্থী, স্নাতক ২য় সিমেস্টার, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।
×