ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

অমর একুশে ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত;###;উদার অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার দাবি

শহীদ মিনারে জনস্রোত ॥ মাথা উঁচু করে বাঁচার শপথ

প্রকাশিত: ০৯:৫৭, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০

শহীদ মিনারে জনস্রোত ॥ মাথা উঁচু  করে বাঁচার শপথ

মোরসালিন মিজান ॥ মায়ের ভাষা বাংলার প্রতি গভীর অনুরাগ আর নিজস্ব জাতিসত্তা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, কৃষ্টি, জীবন-যাপনের স্বাতন্ত্র ধরে রাখার দৃঢ় প্রত্যয়ে শুক্রবার পালিত হয়েছে অমর একুশে। বায়ান্নর অবিনাশী চেতনার উজ্জ্বলতম দিনে পূর্ব পুরুষের গৌরব বুকে নিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচার শপথ নিয়েছে বাঙালী। মৌলবাদ ধর্মান্ধতার কাছে মাথা নত করা কৌশলী রাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান স্পষ্ট করেছে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি উদার অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলার জোর দাবি জানিয়েছে। একইদিন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিত হয়েছে ইউনেস্কো ঘোষিত ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ ডে। প্রতিবারের মতো এবারও একুশের ডাকে জেগে উঠেছিল বাংলাদেশ। তন্দ্রাচ্ছন্ন জাতিকে জাগিয়ে দিতে এসেছিল অমর একুশে। এদিন মায়ের ভাষার জন্য আত্মত্যাগ করার গৌরব আর অর্জনের আনন্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। সাদা-কালো রঙের পোশাকে সেজে বের হন বিভিন্ন বয়সী মানুষ। ফুলে ফুলে ভরে ওঠে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। প্রভাতফেরি, প্রভাতফেরি/আমায় নেবে সঙ্গে,/বাংলা আমার বচন, আমি/জন্মেছি এই বঙ্গে...। নগ্নপায়ে প্রভাতফেরিতে অংশ নেন বঙ্গ সন্তানেরা। সব বয়সী মানুষ কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে গায়: আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি...। মহান শহীদ দিবসে বরকত রফিক শফিক জব্বারদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। লাল সবুজের পতাকার পাশাপাশি ওড়ানো হয় শোকের কালো পতাকা। অনেকে বুকে কালো ব্যাজ ধারণ করেন। এর বাইরে প্রায় সারাদিন শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান সর্বস্তরের মানুষ। একুশের প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী শহীদ বেদিতে ফুল দেন। সরকারী দল আওয়ামী লীগ, সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি, বিএনপি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাসদ, সাম্যবাদী দলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী স্থান ত্যাগ করার পর সর্বস্তরের মানুষের ঢল নামে। শ্রদ্ধা জানাতে আসা মানুষের দীর্ঘ সারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, পলাশী মোড় ছাড়িয়ে নীলক্ষেত ও ইডেন কলেজের সামনে গিয়ে ঠেকে। বিভিন্ন সভা সমিতি সংঘের নামে ভাগ হয়ে আসা মানুষের হাতে ছিল ফুলের স্তবক। অনেকে স্ত্রী সন্তানসহ আসেন। তাদের হাতে ছিল এক গুচ্ছ গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা, গাঁদা বা গ্ল্যাডিউলাস। সারারাত ধরে চলে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন। সকাল বেলায় জনস্রোত আরও বড় হয়। হাজার হাজার মানুষ ফুল হাতে শহীদ মিনারের পানে এগিয়ে যান। প্রভাতফেরি সহকারে আজিমপুর কবরস্থানে গিয়ে শহীদদের সমাধিতে ফুল দিতেও দেখা যায় এদিন। ভাষা শহীদদের সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোঃ আখতারুজ্জামানের নেতৃত্বে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ থেকে প্রভাতফেরি করে আজিমপুর কবরস্থানে যান। সেখানে শহীদ বরকত, জব্বার ও শফিউরের সমাধিতে ফুল দেন তারা। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের অংশ হয়েছিলেন অনেক বিদেশী নাগরিকও। তারাও ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি ভালবাসা জানান। ক্রমে চেনা শহীদ মিনার নতুন চেহারা পায়। ফুলে ফুলে ভরে ওঠে স্মৃতির মিনার। অর্ঘ্যরে ফুলে শহীদ মিনারকে চমৎকার সাজিয়ে নেন স্বেচ্ছাসেবীরা। বিএনসিসি, রেডক্রিসেন্ট, রোভার স্কাউট সদস্যরা ফুল দিয়ে বাংলা বর্ণমালা তৈরি করেন। প্রশস্ত সিঁড়িতে আঁকেন বাংলাদেশের মানচিত্র। সাজানো শহীদ মিনার দূর থেকে প্রত্যক্ষ করার জন্যও বহু মানুষ ভিড় করেন। সারা দিন এ ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালী জাতিসত্তার যে স্ফূরণ ঘটেছিল তা-ই পরবর্তীতে বাঙালীর জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় মনস্তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক প্রেরণা জোগায়। নিজ মাতৃভাষার প্রতি সম্মান জানানোর বিশেষ অনুপ্রেরণা হয়ে আসে ২১ ফেব্রুয়ারি। ভাষার অধিকারের পক্ষে লড়ার পাশাপাশি, ঔপনিবেশিক প্রভুত্ব ও শাসন শোষণের বিরুদ্ধে একুশ ছিল বাঙালীর প্রথম প্রতিরোধ। শহীদ মিনারে আসা জনস্রোত প্রতিরোধের আগুন জ্বালিয়ে রাখার আহ্বান জানায়। শহীদ মিনারের ঢেউ পরে আছড়ে পড়ে অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল চত্বরে আয়োজন করা মেলা পূর্ণতা পায় এদিন। শুধু বাংলায় লেখা বইয়ের বিশাল সংগ্রহ এখানে। ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি পাঠক নিজেদের পছন্দের বই খুঁজে নেন। অমর একুশের দিনে ঢাকার প্রায় প্রতি প্রান্তে বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছিল নানা আয়োজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় একাধিক সাজানো হয় একাধিক মঞ্চ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের উদ্যোগে সন্ধ্যায় টিএসসি মিলনায়তনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থিত শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ ও ক্যাম্পাসে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবর মঞ্চে একুশের অনুষ্ঠানমালা আয়োজন করেছিল সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। বাঙালী ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি চর্চার পথিকৃৎ ছায়ানট নিজস্ব মিলনায়তনে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ‘দারুণ ক্রোধের আগুনে আবার জ্বলবো ফেব্রুয়ারি’ সেøাগানে একুশের অনুষ্ঠান আয়োজন করে উদীচী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের বটতলার মঞ্চে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে অংশ নেয় কলকাতার সংগঠন এন আই পি। উদীচীর নিয়মিত শিল্পীরাও সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এগুলোর বাইরে ঐতিহ্যবাহী প্রায় সব সংগঠন একুশের অনুষ্ঠানমালার আয়োজনের মাধ্যমে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়। বিকেলে বাংলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত হয় অমর একুশে বক্তৃতা ২০২০। এতে ‘বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ ও সাম্প্রতিক উন্নয়ন প্রসঙ্গ’ শীর্ষক বক্তৃতা প্রদান করেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। বাংলা একাডেমির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য রাখেন মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী। জাতীয় জাদুঘরের সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে আয়োজন করা হয় সেমিনার। ছিল একুশের কবিতা পাঠ আবৃত্তি ও সঙ্গীতানুষ্ঠান। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ড. এম আবদুল আলীম। আলোচনা করেন ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন ও ড. আতিউর রহমান। আরও নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারির সেই ইতিহাস স্মরণ করা হয়। ঢাকার বাইরের প্রতিটি জেলা উপজেলা এমনকি গ্রাম থেকে মহান শহীদ দিবস পালন খবর পাওয়া গেছে। যশোরের আয়োজনটির কথা আলাদাভাবে বলা যায়। জানা যায়, সেখানে অমর একুশে ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রথম প্রহরে মোমবাতি প্রজ্বালন করে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। স্থানীয় শিশু কিশোর সাংস্কৃতিক সংগঠন চাঁদের হাট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। একুশের প্রথম প্রহরে ৫২শ’ মোমবাতি প্রজ্বালন করেন আয়োজকরা। এছাড়াও শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে আল্পনা আঁকা হয়। চাঁদের হাটের অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠনের নির্বাহী সদস্য মুক্তিযোদ্ধা এ্যাডভোকেট রবিউল আলম। আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন যবিপ্রবি উপাচার্য ড. আনোয়ার হোসেন, চাঁদের হাট যশোরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ফারাজী আহমেদ সাঈদ বুলবুল প্রমুখ। ২১ ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর নানা দেশে পালিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। জানা গেছে, বাংলা ভাষার আরেক উর্বর ভূমি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ছিল দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা। কলকাতাসহ একাধিক রাজ্যে গভীর আবেগ ও ভালবাসার সঙ্গে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্যাপিত হয়েছে। কলকাতার শিল্পী সাহিত্যক সাংবাদিক বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন বিশেষ তৎপর। এদিন রবীন্দ্রসদন সংলগ্ন তারামন্ডলের পাশে ভাষা শহীদ বেদিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা হয়। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের শিক্ষার্থীরা দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করে। কার্জন পার্ক, বেলেঘাটা ও দেশপ্রিয় পার্কেও ছিল দিনব্যাপী আয়োজন। কলকাতার রাজনৈতিক দলগুলোও পালন করেছে অমর একুশে। পাশাপাশি দিবস পালনে উদ্যোগী হয় বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশন। বিশ্বে স্থাপিত প্রথম বাংলাদেশ মিশনের উদ্যোগে আয়োজিত প্রভাতফেরিতে অংশ নেন কলকাতার বাংলা ভাষাপ্রেমী কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতি কর্মীরা। প্রভাতফেরিটি পার্ক সার্কাসে অবস্থিত বাংলাদেশ গ্রন্থাগার থেকে শুরু হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সরণি হয়ে বাংলাদেশ উপ-দূতাবাস প্রাঙ্গণে অবস্থিত শহীদ মিনারে গিয়ে শেষ হয়। একই প্রাঙ্গণে বিকেলের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে রবীন্দ্রভারতীর শিক্ষার্থীসহ ১৩টি দেশের প্রতিনিধি অংশ নেন। প্রত্যেকে নিজ নিজ ভাষায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করে। এদিকে, অমর একুশের দিনে জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থা (ইউএনডিপি) একটি বাংলা ফন্ট উদ্বোধন করেছে। বাংলা ভাষার প্রতি সম্মান জানিয়ে সংস্থাটি তাদের গত বছরের (২০১৯) মানব উন্নয়ন রিপোর্টের সার-সংক্ষেপও বাংলায় প্রকাশ করেছে। ঢাকার একটি হোটেলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন এই বাংলা ফন্ট উদ্বোধন করেন। বাংলা বর্ণমালার যুক্তাক্ষর ও মাত্রাসহ অন্যান্য বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে এই ফন্ট তৈরি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
×