ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

দায় ও দায়িত্ব

ব্যস্ত সড়কে বাস রাখার নৈরাজ্য থামবে কবে?

প্রকাশিত: ০৯:৫৯, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০

   ব্যস্ত সড়কে বাস রাখার  নৈরাজ্য থামবে কবে?

রাজন ভট্টাচার্য ॥ সড়কে নৈরাজ্য ও দুর্ঘটনার কারণে চালকদের বদনামের শেষ নেই। ইচ্ছেমতো চালানো, গাড়ির ছাল বাকল না থাকা, বাড়তি ভাড়া আদায়, চালকের লাইসেন্স না থাকা, রেষারেষিসহ চালকদের বিরুদ্ধে হাজারও অভিযোগ। আছে আলোচনা, সমালোচনা। দীর্ঘদিন এই সেক্টরের শ্রমিকদের নিয়ে হাজারও কথা। তবুও বদনাম একটুও কমেনি। বরং বাড়ছে। নতুন কিছু যুক্ত হচ্ছে দিনের পর দিন। এসবকিছুর সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার সড়কে ইচ্ছেমতো বাস পার্কিং করে রাখার ঘটনা। এতে নগরীতে যানজট যেমন হয়, তেমনি চলাচলে সৃষ্টি হয় প্রতিবন্ধকতা। নগরীর সৌন্দর্যও নষ্ট হয়। অথচ কোন পরিবহন কোম্পানির অনুমোদনের অন্যতম শর্ত হলো নিজস্ব পার্কিং ব্যবস্থা। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি- বিআরটিএ বলছে, কাগজপত্রে ঢাকাসহ দেশের সকল বাস কোম্পানির নিজস্ব পার্কিং জোনের কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান নিজস্ব পার্কিং ব্যবহার না করায় জনদুর্ভোগ হয়। আইনের দৃষ্টিকোণ থেকেও তা বৈধ নয়। অফিস সময়ে কমলাপুর থেকে টিটিপাড়াগামী সড়ক দিয়ে যারা প্রতিদিন যাতায়াত করেন তাদেরই কেবল বলতে পারার কথা সড়কটির অবস্থা কেমন থাকে। মধ্যরাত পর্যন্ত সড়কের বুকে পিষে চলে লাখো লাখো গাড়ি। রাস্তাটির যেন নিস্তার নেই। নেই বিশ্রামের সুযোগ। অথচ কমলাপুর স্টেশনের পাশ থেকে একেবারে টিটিপাড়া মোড় পর্যন্ত অন্তত শতাধিক বাস রাখা হয় প্রতিদিন। দুই লেনের এই সড়কটিকে বাস রাখার কারণে এক লেন এমনিতেই বন্ধ হয়ে যায়। ফলে দিনভর যানজট লেগেই থাকে। কাদের বাস ? চালক ও কন্ডাক্টররা জানিয়েছেন, এখানে রাখা সবগুলোই স্টাফ বাস। মতিঝিলসহ আশপাশের এলাকার বিভিন্ন অফিসে কর্মরতদের আনার পর এখানে পার্কিং করে রাখা হয় দিনভর। সন্ধ্যায় আবার স্টাফ নিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশে যাত্রা। এই এলাকায় কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা বলছেন, প্রভাবশালী লোকদের চাপের কারণে এখানের বাস পার্কিং নিয়ে কিছু করার থাকে না। আর স্টাফরা জানিয়েছেন, আমাদের যেখানে রাখতে বলা হয় সেখানেই রাখছি। বাস রাখার ভাল জায়গা না পেলে স্টাফ আনা নেয়া কঠিন বলেও জানান তারা। এত গেল একটি সড়কের গল্প। এবার কমলাপুর থেকে পীরজঙ্গী মাজার পর্যন্ত সড়কটির প্রায় দু’পাশের চিত্র একই রকমের। এই এলাকায় বিআরটিএ বা পুলিশের পক্ষ থেকে কোন অভিযান লক্ষ্য করা যায় না। আবার কমলাপুর থেকে আরামবাগমুখী সড়কটি একাংশেও দূরপাল্লার ও স্টাফ বাস পার্কিং করতে দেখা যায়। রয়েল ও তিশাসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লাগামী বেশ কয়েকটি পরিবহন কোম্পানি রাস্তার ওপর বাস রাখে নিয়মিত। রয়েছে বেশ কয়েকটি পরিবহন কাউন্টার। সড়কে বাস রেখে এসব গাড়ির টিকেট বিক্রি হয়। এর একটু সামনে গেলে কমলাপুর স্টেডিয়ামের পাশে স্টার লাইন পরিবহনের গাড়ি রাস্তায় রাখতে দেখা গেছে। সাদেক হোসেন খোকা কমিউনিটি সেন্টারের আশপাশের সবকটি রাস্তায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠার বাস পার্কিং করে রাখা হয় দিনভর। কমলাপুর থেকে সায়েদাবাদ হয়ে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত একই চিত্র চোখে পড়বে। যেখানে রাস্তা আটকে বা লেন বন্ধ করে সরাসারি বাস রাখা হয় প্রতিদিন। যদিও সিটি কর্পোরেশন থেকে বলা হচ্ছে, অনুমোদন না নিয়ে রাস্তা দখল আইনসিদ্ধ নয়। এজন্য সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। রাজধানীর বনানী রেল স্টেশনের সামনের ব্যস্ততম সড়কে ঢাকার চাকা বাসগুলো এক লেন দখল করে দাঁড় করিয়ে রাখার দৃশ্য নিয়মিত। এর বিপরীত সড়কেও আরেকটি বেসরকারী কোম্পানির বাস সব সময় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। ক্যান্টনমেন্টগামী একটি পরিবহন কোম্পানি বনানী এলাকায় সারিবদ্ধভাবে বাস রাখে। যাত্রী হওয়া সাপেক্ষে সেসব বাস ছেড়ে যায়। সন্ধ্যার পর যারা মালিবাগ রেলগেট হয়ে বিশ্বরোড দিয়ে সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী যাতায়াত করেন তারা নিশ্চয়ই দেখেছেন এই সড়কে বিভিন্ন বাস কোম্পানির অবৈধ পার্কিং করার দৃশ্য। সমস্যার শুরু মালিবাগ রেলগেট থেকে। রেলগেট সংলগ্ন সোহাগ পরিবহনের কাউন্টারের সামনে আন্তঃজেলা রুটের বাস দাঁড় করিয়ে নিয়মিত যাত্রী তোলা হয়। সরিয়ে দেয়া হয় অন্যান্য পরিবহন। এর একটু সামনে সোহাগের পার্কিং জোন। জায়গা না হওয়ায় এই পরিবহন কোম্পানির অন্তত ২০টি বাস দিয়ে অর্ধেক রাস্তা বন্ধ করে রাখা হয়। এ বিষয়ে টার্মিনালের তত্ত্বাবধায়ক পরিচয় দেয়া আমিনুল নামের এক ব্যক্তি জানান, বাস বেশি। জায়গা কম। তাই অল্প সময়ের জন্য মাঝে মাঝে দু’একটি বাস রাস্তায় থাকে। কিন্তু জনদুর্ভোগের বিষয়ে তারা সব সময় সচেতন বলেও জানান। তার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল তখন ২০টির বেশি বাস ছিল এই সড়কে। মালিবাগ রেল গেট এলাকায় দায়িত্ব পালন করা ট্রাফিক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ক্ষমতাধর কোম্পানির পরিবহন। তাই জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করলেও আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারি না। কিছু বলতেও পারি না। বলতে গেলে উল্টো আমাদের ধমক খেতে হয়। তিনি বলেন, একটু সামনে গেলেই দেখবেন প্রতিটি ক্রসিংয়ে ট্রাফিক পুলিশ তৎপর। সড়কে পরিবহন নৈরাজ্য হলে রেকার লাগানো হচ্ছে। আদায় করা হচ্ছে জরিমানা। মালিবাগ কমিউনিটি সেন্টারের রাস্তা ছাড়ালেই মিডলাইন আর বাহন পরিবহনের বাস খিলগাঁও উড়াল সড়ক পর্যন্ত। প্রতিদিন এই সড়কে দুই সারি করে বাস পার্কিং করে রাখা হয়। জানতে চাইলে বাহন পরিবহনের চালক মমিন জানান, কোম্পানির নির্দেশ অনুযায়ী আমরা গাড়ি রাখি। এক্ষেত্রে নিজেদের কোন মতামত নেই। তিনি বলেন, মানুষের দুর্ভোগ হলেও আমাদের করণীয় কিছু নেই। কারণ মালিকের নির্দেশ। তাই আমাদের পুলিশও কিছু বলে না। মিডলাইন পরিবহনের চালক আক্কাস বলেন, দিনভর চালানোর পর কিছু বাস মোহাম্মদপুর ও এই এলাকায় রাখা হয়। এই এলাকার বাসগুলো সকাল থেকে পর্যায়ক্রমে ছেড়ে যায়। তিনি জানান, রাস্তা দখল করে রাখা ঠিক নয়। কিন্তু আমাদের কেউ কিছু বলে না। খিলগাঁও কমিউনিটি সেন্টারের বিপরীত সড়কে মঙ্গলবার দেখা গেছে নূর এ মক্কা পরিবহনের অন্তত ৫০টি বাস দুই লেন জুড়ে রাখা হয়েছে। সৌদিয়াসহ আন্তঃজেলা রুটের আরও কিছু বাস দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। রাস্তার উভয়পাশ জুুড়েই বাস পার্কিং করে রাখাই যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। রাতে সাতরাস্তা থেকে মহাখালী রেলগেট পর্যন্ত যানজট ও জনভোগান্তি বাড়ে শুধুমাত্র আন্তঃজেলা রুটের বাস রাস্তায় রাখার কারণে। শুধু তাই নয় তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকার বিভিন্ন রুটেও রাখা হয় বাস। এ নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে যেমন অসন্তোষ রয়েছে তেমনি পথচারীসহ যাত্রীদের অভিযোগের শেষ নেই। দিনের বেলাতেও মহাখালী বাস টার্মিনালের সামনের সড়কে এলোপাতাড়ি করে বাস রাখতে দেখা যায়। কাকরাইল, নয়াপল্টন, ফকিরাপুল যেন বাস রাখার অঘোষিত টার্মিনাল। তবে সন্ধ্যার পর এ দৃশ্য একেবারেই জমে ওঠে। বিভিন্ন পরিবহন কোম্পানির বাস একের পর এক আসতে দেখা যায়। আরামবাগেও সিটি সার্ভিসগুলোর বাস রাখার অভিযোগ রয়েছে। গোটা গুলিস্তানের সড়ক তো অনেক আগে থেকেই টার্মিনাল। ফুলবাড়িয়ায় একটি বাস টার্মিনাল থাকলেও তা ব্যবহার করে বিআরটিসি বাস। বেসরকারী বাসের বাড়ি তো সিটি কর্পোরেশনের রাস্তা। গুলিস্তান এলাকার ব্যবসায়ীদের বক্তব্য হলো, এই এলাকায় যানজটের ভোগান্তির মূল কারণ বাস দিয়ে রাস্তা দখল করে রাখা। বেশ কয়েকবার ভাসমান টার্মিনাল বন্ধের উদ্যোগ নেয়া হলেও তা বেশিদিন স্থায়ী হয় না। মিরপুর, ফার্মগেট, বনানী, গাবতলী, টেকনিক্যাল, ১০ নম্বর, এক নম্বর, ধানমন্ডি, গুলশান, বাড্ডা, নতুনবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় রাস্তার ওপর বাস রাখার কারণে নগরবাসীর অশান্তির কোন শেষ নেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যা বলেন, আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি এসব অবৈধ বাস পার্কিং বন্ধ করার জন্য। গোটা পরিবহন সেক্টর এখন সংস্কারের মধ্যে আছে। ধারাবাহিকভাবে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সঙ্কট অনেক। তাই রাতারাতি সব সমাধান হবে না। আস্তে আস্তে নগরবাসী সুফল পাবেন।
×