ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

রেজা সেলিম

ডিজিটাল বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিং

প্রকাশিত: ০৮:৪৪, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০

ডিজিটাল বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিং

ডিজিটাল বাংলাদেশের অন্যতম একটি সফল উদ্যোগ হলো মোবাইল ব্যাংকিং সেবা যার ব্যাপ্তি আশাতীতভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। এখন মোবাইল ফোন ব্যবহার করে যে কোন সময় শহর থেকে গ্রামে বা গ্রাম থেকে শহরে টাকা পাঠানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। এছাড়া পরিষেবা খরচ যেমন বিদ্যুত, গ্যাস, পানির বিল বা ইন্টারনেটে কেনাকাটা এমনকি সরকারী-বেসরকারী, নানা প্রকারের বৃত্তি ও ভাতা দেয়া, বিদেশ থেকে টাকা পাঠানোসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা এখন পছন্দের মাধ্যম হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বর্তমান সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেবার বছরখানেকের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১০ সালে মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু করে যার অধীনে ২০১১ সালের ৩১ মার্চ বেসরকারী খাতের ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালুর মধ্য দিয়ে দেশে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের যাত্রা শুরু হয়। এর পরপরই ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করে ‘বিকাশ’। বর্তমানে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার বাজারের সিংহভাগই বিকাশের দখলে। যদিও বাংলাদেশ সরকারের ডাক বিভাগের ‘নগদ’ মাত্র এক বছরের মধ্যেই দেশের মোবাইল ব্যাংকিং সেবায় ইতোমধ্যে দ্বিতীয় আসন গড়ে নিয়েছে, এতে বোঝা যায় এই সেবার গ্রাহকদের এখনও সরকারের সেবার প্রতিই আস্থা বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে ১৬টি প্রতিষ্ঠান মোবাইল ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মোবাইল ব্যাংকিংয়ে নিবন্ধিত গ্রাহক সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭ কোটি ৯৬ লাখ ৪৯ হাজার। যা নবেম্বরে ছিল ৭ কোটি ৮৫ লাখ ৯৪ হাজার। অর্থাৎ এক মাসে গ্রাহক বেড়েছে ১০ লাখ ৫৫ হাজার। আর এটা প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকেরই ‘মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস’ যা ‘এমএফএস’ নামে সুপরিচিত তাদের দেয়া সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসেই মোবাইল ব্যাংকিংয়ে গ্রাহক লেনদেন করেছে ৪০ হাজার ৬৪৭ কোটি টাকা। একক মাস হিসেবে এটি সর্বোচ্চ রেকর্ড লেনদেন ছিল। এমএফএস তাদের প্রতিবেদনে বলছে ডিসেম্বরে মোট ২২ কোটি ৭৪ লাখ ২২ হাজার ৯৩৮টি লেনদেন হয়েছে যেসবের মাধ্যমে ৪০ হাজার ৬৪৭ কোটি ৬৪ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৩১১ কোটি ২১ লাখ টাকা। একই মাসে মোবাইল ব্যাংকিং হিসাবগুলোতে টাকা জমা পড়েছে ১৪ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা। যা আগের মাসের চেয়ে ৮ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি। এ সময়ে উত্তোলন করা হয়েছে ১৩ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকা। যা জুনের তুলনায় ৬ শতাংশ বেশি। আমরা জানি এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যয় ও একই সঙ্গে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে দেয়া। ডিজিটাল বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক অঙ্গীকার তার মূলমন্ত্রই হলো সাধারণের জীবনে ‘দিনবদল’ এনে দিতে সহায়তা করা যা মানবিক বাংলাদেশের রূপকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সংগঠিত হচ্ছে। কিন্তু আমাদের জন্য উদ্বেগের বিষয় হলো নানারকম নতুন উদ্যোগের পেছনে সরকারের সমর্থন, পৃষ্ঠপোষকতা এমনকি উদ্যোগগুলো যদি ঝুঁকিতেও পড়ে তাকে বাঁচাতে সহায়ক নীতি তৈরি করে দেয়া পর্যন্ত সহায়তা থাকার পরেও দেখা গেছে কিছু কিছু অসাধু ঘটনা ঘটছে যা কোনভাবেই কাম্য নয়। এমনকি আইনের চোখে অপরাধ হলেও সেসব উদ্যোগ আইন-আদালতের কোন পরোয়া করে না, নিজেদের স্বার্থ আদায়ে নানারকম কৌশলের আশ্রয় নেয়। সাম্প্রতিক গ্রামীণফোনের কাছে সরকারের পাওনা ১২ হাজার ৫৭৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা সম্পর্কে আমরা জানি, এরা তা পরিশোধে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ পর্যন্ত প্রতিপালন করতে চাইছে না! মোবাইল ফোন ব্যবসার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি বলছে, তারা কুড়ি বছরের হিসাব অডিট করে দেখেছে রবির কাছে ৮৬৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা পাওনাসহ এই দুটি মোবাইল ফোন কোম্পানির কাছেই সরকারের পাওনা রয়েছে প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা। প্রশ্ন হলো জনগণের কাছে নানারকম সেবা পৌঁছে দিতে সরকার তাদের জন্য সহায়ক নীতিমালা তৈরি করে দিলেও তারা তাদের অঙ্গীকার অনুযায়ী সরকারের টাকা কেন পরিশোধ করে না? এটা তো ধ্রুব সত্য যে, তাদের সকল সেবা যেমন কথা বলা (ভয়েস), ইন্টারনেট (ডেটা) ও অন্যান্য মান সংযোজন সেবা (ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিসেস বা ভ্যাস) সবই দেশের মানুষ ব্যবহার করে, তাদের যে মূল্য (তা কম আর বেশি যাই-ই হোক) জনগণ তা সরকারের প্রাপ্য করসহ যথাযথভাবে পরিশোধ করে কিন্তু এইসব সেব্রা মাধ্যমে প্রাপ্ত সরকারের টাকাটুকু ওই কোম্পানিগুলো সঠিক নিয়মে পরিশোধ করে না। না হলে গত কুড়ি বছর ধরে এত টাকা জমে উঠল কেমন করে? আমরা মানছি সরকারের তদারকির দুর্বলতা আছে কারণ নতুন নিয়মের প্রয়োগে সরকার সাধারণত কিছুটা শিথিল থাকে, কিন্তু এই কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসা নীতির দায়ের অঙ্গীকার থেকে তো সরে যেতে পারে না। ডিজিটাল প্রযুক্তির সকল সেবা প্রদানের জন্য সরকার যেমন পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে তেমনই নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ভাল-মন্দের উপযোগিতা বিচার করেই সরকার জনবান্ধব নীতিমালা ও যথাযথ আইন প্রণয়ন করেছে, প্রয়োজনে সেগুলো যুগোপযোগী করে দিচ্ছে, আর যে কোন নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান সেসব বিধিবিধান মেনে চলতে বাধ্য। ফলে আমাদের আশঙ্কা, মোবাইল ফোন দিয়ে যে বিশাল আর্থিক লেনদেনের বাজার তৈরি হয়েছে যেহেতু তা সম্পূর্ণতই এই প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল আর তার অপারেটরেরা যদি সরকারী নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা না করে, সেবার জন্য জনগণ যে আর্থিক মূল্য দেয় তার সরকারী অংশ যদি তারা আত্মসাতের জন্য ব্যস্ত থাকে শেষে না আমরা আরও বড় কোন বিপদে পড়ি। আমরা লক্ষ্য করেছি মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর তদারকি সংস্থা হিসেবে বিটিআরসি যখন শক্তভাবে আইন অমান্যের কারণে ব্যবস্থা নিতে শুরু করল তখন অপারেটরেরাও কিন্তু বসে থাকেনি। কল ড্রপ বাড়িয়ে বা নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও এর কোন প্রতিকার না করে, বিভিন্ন প্যাকেজের নামে ফাঁকিজুকি করে গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা আদায়ে বুদ্ধি আঁটতে শুরু করল। সবচেয়ে বিপদ হলো যখন কোন উপায়েই এদের শায়েস্তা করা যাচ্ছিল না তখন বিটিআরসি এদের জন্য বরাদ্দ ব্যান্ডউইথ সীমিত করতে নির্দেশ দিল প্রকারান্তরে যার সব চাপ গিয়ে পড়ল নিরপরাধ গ্রাহকের ওপর। শেষ পর্যন্ত সর্বোচ্চ আদালতের কাছে গিয়েও এখনও এসব অনিয়মের সুরাহা হয়নি, হবে আমরা আশা করছি। দেশের মোবাইল ব্যাংকিং যেহেতু এই প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল আমাদের ভাবতে হবে ভবিষ্যতে কোনভাবেই যেন এইসব অপারেটরেরা গ্রাহককে জিম্মি করে কোন ফন্দি আঁটতে না পারে। দেশের ক্রমবর্ধমান গৃহস্থালি পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া এই ব্যাংকিং সেবা ইতোমধ্যে আকৃতির কারণে বিশ্ব অর্থনৈতিক দরবারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী মোবাইলে লেনদেন করেন এমন নিবন্ধিত গ্রাহক সংখ্যা বর্তমানে ৮ কোটির কাছাকাছি। এই সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। বিশেষ করে গ্রামেগঞ্জে এর জনপ্রিয়তা বেশি। নিম্নবিত্ত আয়ের মানুষের পারিবারিক ও ব্যবসায়িক লেনদেন ছাড়াও বিদেশ থেকে রেমিটেন্স বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে এই সেবার নিরাপত্তা নিয়েও কোন সংশয়ের জন্ম হয়নি। কিন্তু সব আয়োজন ব্যর্থ হবে যদি আমরা একটি সমন্বিত উদ্যোগ না নেই যেখানে মোবাইল অপারেটরেরা যেমন আইন মান্যে বাধ্য থাকবে তেমনই এই সেবা দেশের সর্বোচ্চ আর্থিক বাজারের পূর্ণ স্বীকৃতি ও সমর্থন পাবে। আর তা নিশ্চিত হতেই হবে যেন ডিজিটাল বাংলাদেশের অগ্রগতি, সম্মান ও অর্জনকে কেউ প্রশ্নবিদ্ধ করতে না পারে। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম গবেষণা প্রকল্প [email protected]
×