ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

মামুনুর রশীদ

অভিমত ॥ নারীর ক্ষমতায়ন ও বঙ্গবন্ধু

প্রকাশিত: ০৮:৪৬, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০

অভিমত ॥ নারীর ক্ষমতায়ন ও বঙ্গবন্ধু

নারী আন্দোলনের অগ্রদূত মহীয়সী বেগম রোকেয়া বলেছিলেন, ‘তোমাদের কন্যাদের শিক্ষা দিয়া ছাড়িয়া দাও, তাহারা নিজেরাই নিজেদের অন্নের সংস্থান করুক।’ বাংলাদেশের নারী যুগ যুগ ধরে শোষিত, অবহেলিত হয়ে আসছে। পুরুষশাসিত সমাজ ব্যবস্থায় ধর্মীয় গোঁড়ামি, সামাজিক কুসংস্কার, কূপমণ্ডুকতা, নিপীড়ন ও বৈষম্যের বেড়াজালে তাকে সর্বদা রাখা হয়েছে অবদমিত। তার মেধা, শ্রমশক্তিকে শুধু সাংসারিক কাজেই ব্যয় করা হয়েছে। সমাজ ও দেশ গঠন কাজে তাকে কখনও সম্পৃক্ত করা হয়নি। তার এ আহ্বানে নারীর অধিকার অর্জনের পন্থা সম্পর্কে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এ দেশের নারী জাগরণে সাড়া পড়েছিল সাধারণত শিক্ষা গ্রহণকে কেন্দ্র করে। এছাড়া ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে নারী তার অধিকার আদায়ে সচেতন হয়ে ওঠে। পাকিস্তান আমলে ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। ১৯৭১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বাংলাদেশ দীর্ঘ প্রত্যাশিত স্বাধীনতা লাভ করে। এ স্বাধীনতা যুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি নারীও অসামান্য অবদান রাখে। যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়াও বিভিন্নভাবে সহায়তা প্রদান এবং স্বামী ও সন্তানকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়ে আমাদের মায়েরা এক বিশাল দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের নিদর্শন রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে আমাদের দুই লক্ষাধিক মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছেন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের এই জঘন্য অপরাধ কখনই ভুলবার নয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে নারী আত্মনির্ভরশীল হতে সচেতন হয়ে ওঠে। শিক্ষা গ্রহণের, কর্মসংস্থানের প্রত্যাশায় নারী সমাজের মাঝে বিপুল সাড়া জাগে। গ্রামে নিরক্ষর নারী সমাজের মাঝেও কাজের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হবার আগ্রহ জাগে। জাতীয় উৎপাদনে নারীর অংশগ্রহণ আবশ্যক হয়ে ওঠে। নারী উন্নয়নে সরকারী ও বেসরকারীভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি নারী সংগঠনগুলোও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে। ফলে নিজেদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় তারা সচেতন হয়ে ওঠে। এতে করে দেশে নারী উন্নয়নে এক বিরাট সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। বর্তমান সরকার দেশের বৃহত্তর নারী সমাজের ভাগ্যোন্নয়ন ঘটিয়ে তাদের পশ্চাৎপদ অবস্থা থেকে তুলে আনতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে নারীর সার্বিক উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ নির্দেশনা পরিলক্ষিত হয়। বিশ্ব প্রেক্ষাপট ও বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সত্তর দশকের প্রথম ভাগ থেকেই তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকার নারী উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। ১৯৭৫ সালে মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব নারী সম্মেলনে বাংলাদেশ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। ফলে দেশের বাইরে নারী উন্নয়নের যে আন্দোলন চলছিল তার মূল স্রোতধারায় বাংলাদেশ যুক্ত হয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু প্রথম থেকেই নারীর ক্ষমতায়নের দিকে নজর দিয়েছিলেন। যে কারণে প্রথম জাতীয় সংসদেই নারীর জন্য সংরক্ষিত আসন রাখা হয়। সে সময় নারী আন্দোলন এতটা শক্তিশালী ছিল না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির সঙ্গে প্রথম থেকেই কিছু নারী নেতৃত্বের নাম লক্ষণীয়। যেমনÑ বদরুন্নেছা, আমেনা বেগম, জোহরা তাজউদ্দীন প্রমুখ। বঙ্গবন্ধুর সময় যারা তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন দলের ভেতরে তাদের অগ্রণী ভূমিকা ছিল। অধিকাংশ নারী নেতৃত্ব বাম দল দ্বারা পরিচালিত হলেও পরবর্তীতে তারা আওয়ামী লীগের মূল ধারার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় বঙ্গবন্ধু নির্যাতিত নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাবে ভূষিত করেছিলেন। ‘বীরাঙ্গনা’ অর্থ ‘বীর নারী’। তিনি এভাবে নারীদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ‘নারী পুনর্বাসন বোর্ড’। নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসন এবং আবাসনের জন্য এ বোর্ড গঠিত হয়। নারী পুনর্বাসন বোর্ডের দায়িত্ব ও কার্যপরিধি ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৯৭৪ সালে বোর্ডকে পুনর্গঠিত করে সংসদের একটি এ্যাক্টের মাধ্যমে নারী পুনর্বাসন ও কল্যাণ ফাউন্ডেশনে রূপান্তর করা হয়। এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের পথ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময় নারী উন্নয়নের জন্য জেলা ও মহকুমায় ভৌত অবকাঠামো গড়ে তোলা, নারীর ব্যাপক কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান, নারীকে উৎপাদনমুখী কর্মকা-ে নিয়োজিত করে প্রদর্শনী ও বিক্রয় কেন্দ্র স্থাপন করা, উৎপাদন ও প্রশিক্ষণ খাতে নিয়োজিত নারীদের জন্য দিবাযতœ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের চিকিৎসা এবং তাদের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য বৃত্তিপ্রথা চালু করা হয়। এ কর্মসূচীগুলো বর্তমানে মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের অধীনে ‘দুস্থ মহিলা ও শিশুকল্যাণ তহবিল’ নামে পরিচালিত হচ্ছে। বাংলার নারীদের সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম নারী সংগঠন মহিলা সংস্থার ভিত্তি রচনা করেন। শিশু ও কিশোরীদের আত্মমর্যাদাবোধ প্রতিষ্ঠা, দেশপ্রেম ও নৈতিকতার শিক্ষায় শিক্ষিত করতে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তান গার্লস গাইড এ্যাসোসিয়েশনকে ঢেলে সাজান। স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলাদেশ গার্লস গাইড এ্যাসোসিয়েশনকে পুনর্গঠিত করার জন্য বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে দায়িত্ব দেন। বঙ্গবন্ধুর সরকারের আমলে গৃহীত প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নারীদের অর্থকরী কাজে নিয়োজিত করার উদ্দেশ্যে সর্বপ্রথম আন্তঃখাত উদ্যোগ নেয়া হয়। মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, প্রথম পঞ্চবার্ষিক (১৯৭৩-৭৮) পরিকল্পনায় স্বাধীনতা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা, সমাজকল্যাণমূলক বিভিন্ন কর্মসূচী গৃহীত হয়। নারী উন্নয়নকে গুরুত্ব দেয়ার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর সরকার এই খাতে অর্থ বরাদ্দ করে। বঙ্গবন্ধু জরিপের মাধ্যমে সঠিক তথ্য আহরণ করে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন, যুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের বিভিন্ন বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান করা, বীরাঙ্গনা নারীসহ যেসব পরিবারের উপার্জনক্ষম পুরুষ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন সেসব পরিবারের নারীদের চাকরি ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। রাজনীতি ও প্রশাসনে নারীর প্রশাসনিক ক্ষমতায়ন, সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়ে উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় নারীকে সম্পৃক্ত করার প্রথম উদ্যোগ ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকার গ্রহণ করে। সরকারী চাকরিতে মেয়েদের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে দিয়ে সকল ক্ষেত্রে মেয়েদের অংশগ্রহণ অবারিত করে দশভাগ কোটা সংরক্ষণ করা হয়। ১৯৭৩ সালে দুজন নারীকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং ১৯৭৪ সালে একজন নারীকে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক নিয়োগ করা হয়। ক্ষমতায়নের সেই অবারিত প্রবাহ ধরে রেখেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা ও ১৬ কোটি মানুষের হৃদয়ের স্পন্দন দেশরতœ শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন অর্জনে গণতান্ত্রিক বিশ্বে একটি অনন্য নজির স্থাপন করেছে। সরকারপ্রধান, সংসদ নেতা, সংসদ উপনেতা, সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা এবং সংসদের স্পীকার- সবাই নারী। নারীরা এখন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রসহ সমাজের সকল স্তরে একটি নেতৃত্বশীল ভূমিকা পালন করছে। তারা কৃষি উন্নয়নে আরও বেশি ফলপ্রসূ অবদান রাখছে। আজ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের অসমাপ্ত সোনার বাংলা সারাবিশ্বে নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। লেখক : এমফিল গবেষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় [email protected]
×