ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ভাষার মর্যাদা

প্রকাশিত: ০৯:৫১, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০

ভাষার মর্যাদা

মহান একুশে ফেব্রুয়ারির দিন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে চার দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখা প্রসঙ্গে বাস্তবতার নিরিখে কিছু তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি যথার্থই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন প্রমিত ও আঞ্চলিক বাংলার সহযোগে শেকড়ের প্রভাব উপড়ে না ফেলে কথ্যভাষার প্রবণতার প্রতি। এই সামান্য মিশ্রণে লজ্জার কিছু নেই। কেননা তা বাংলারই ভাষা, বলা যায় বঙ্গভান্ডারেরই রতন। বাংলা বচন ও বাচনে অথবা ইংরেজী ভাষার বাকভঙ্গি বা এ্যাকসেন্ট আমদানি করা পরনির্ভরশীলতারই নামান্তর। এক অর্থে হীনম্মন্যতা। তাদের জন্য করুণা ছাড়া আর কি থাকতে পারে? খুব খাঁটি কথা। প্রধানমন্ত্রীকে সাধুবাদ। বাঙালী অথচ বাংলা ভাষার প্রতি অবজ্ঞা- এমনটি স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ করা যাবে, সেটি অভাবিত। কিন্তু একশ্রেণীর তথাকথিত ধনী ব্যক্তি এবং তাদের সন্ততিদের মাঝে তেমন প্রবণতাই লক্ষণীয়। এ যেন গর্ভধারিণী জননীকে অস্বীকার করে বিমাতার প্রতি অযাচিত আনুগত্য। ইংরেজী মাধ্যমে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের বাংলা উচ্চারণের দৈন্যদশা নিয়ে হতাশা থাকা স্বাভাবিক। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য অভিভাবক ও শিক্ষকদের সহযোগিতা যে আবশ্যক সে কথাটি আমাদের জোরের সঙ্গে বলতে হবে। এতে কোন সংশয় নেই যে, বিশ্বায়নের এই যুগে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ আন্তর্জাতিক যোগাযোগের জন্য অন্য ভাষা শেখার প্রয়োজন আছে। সে ভাষা যে শুধু ইংরজীই হতে হবে সেটিও বাস্তবসম্মত নয়। এখন ফরাসী, স্প্যানিশ, এমনকি ম্যান্ডারিন ভাষাও বিশ্ব অর্থনীতির বিচারে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সেসব ভাষা বাঙালী শিখবে, চর্চা করবে; তবে সেটা মাতৃভাষাকে বাদ দিয়ে কখনই নয়। স্মরণযোগ্য, একুশে ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পাওয়ার পর ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করা হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট। এই ইনস্টিটিউটে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য একটি ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ভাষা শিক্ষার জন্য ফেলোশিপ চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এই উদ্যোগ সাধুবাদযোগ্য। সেই সঙ্গে আমরা ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যুক্ত সর্বস্তরের কর্মীর কাছে কাজের গতি বাড়ানো ও আন্তরিকতা প্রত্যাশা করি। এখন পর্যন্ত ইনস্টিটিউটটি উল্লেখযোগ্য কোন কাজের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে কি? বাঙালীর ভাষার সংগ্রামের একুশ এখন বিশ্বের সব ভাষাভাষীর অধিকার রক্ষার দিন। বাঙালীর আত্মত্যাগের দিন এখন শুধু আর বাংলার নয়, প্রত্যেক মানুষের মায়ের ভাষার অধিকার রক্ষার দিন। ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ এক আদেশে দেশের সব সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার, গাড়ির নম্বর প্লেট, সরকারী দফতরের নামফলক এবং গণমাধ্যমে ইংরেজী বিজ্ঞাপন ও মিশ্র ভাষার ব্যবহার বন্ধ করার জন্য ব্যবস্থা নিতে বলেছিল সরকারকে। সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে বলা আছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা ভাষা প্রচলন আইন ১৯৮৭-এর ৩ ধারায়ও সব কাজে বাংলার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু এসবের প্রতিফলন আমরা কতটুকু দেখতে পাচ্ছি সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। বাংলা ভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখা এবং সমৃদ্ধির লক্ষ্যে আরাধ্য কাজে সকলকে আত্মনিয়োগ করতে হবে। মাতৃভাষা ছাড়া জ্ঞানচর্চা পূর্ণাঙ্গ হতে পারে না। দুঃখজনক হলেও সত্য, মাতৃভাষার চর্চা ও বিকাশের ক্ষেত্রে আমরা এখনও অনেক পিছিয়ে, যা ভাষা আন্দোলনের চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
×