ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শুধু বসন্তে নয় সারা বছর ফুটবে ফুল, মরুর দেশে পাথরেও

প্রকাশিত: ১০:০৯, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০

 শুধু বসন্তে নয় সারা বছর ফুটবে ফুল, মরুর দেশে পাথরেও

সমুদ্র হক ॥ বসন্ত ও ফাল্গুনে শুধু নয় সারাবছর ফুটবে ফুল। এমনকি মরুর দেশে পাথরের মধ্যেও ফুল ফোটানো যাবে। বিজ্ঞানীরা ফুল ও ফুল গাছের পরাগায়ন, এপিজেনেটিক ও ডিএনএর বিশেষ ধরনের প্রজনন প্রক্রিয়ায় এমন সাফল্য এনেছেন। বছর কয়েক আগে রাজশাহী ও বগুড়ায় এডেনিয়াম নামে যে ফুল ফুটেছে তার পরিচিতি মরু গোলাপ। মরু গোলাপের অন্তত এক শ’ উদ্ভাবিত হয়েছে। প্রাচীন ইতিহাসের দ্বিগি¦জয়ী বীর নেপোলিয়ান রাজ্য জয় করে যেখানে ফুল ফুটত না সেখানেও ফুল ফুটিয়েছেন। বলেছেন যে ভূমিতে ফুল ফোটে না সেই ভূমি মনুষ্য বসবাসের অনুপোযগী। বিংশ শতকের বাঙালী কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত’ পঙক্তি চিরন্তন উপমা। ঋতুরাজের রানী অবগুণ্ঠন খুলবে আর ফুল ফুটবে না তা কি হয়! বিজ্ঞানীরা সারাবছর ফুলের পাপড়ি মেলে দিয়েছেন। ফুল ফোটানো ঋতু বসন্তের গর্ব আর থাকছে না। উদ্ভিদ ডিএনএর বিশেষ ধরনের প্রোটিন ফুল ফোটাবেই। গত দশ বছরে নার্সারির মালিকরা দেশে অনেক ধরনের ফুল ফুটিয়েছেন। যেমন গ্লাডিওলাস। এই ফুল বুকে (ফুলের ছোট বড় তোড়া) বানাতে গোলাপ রজনীগন্ধা গাঁদা ও অন্যান্য ফুলের মোড়ক হয়ে সুন্দরের প্রলেপ আনে। এক সময় বিশেষ দিন ও সামাজিক অনুষ্ঠানে ফুলের কদর ছিল। ফুলের কদর প্রণয়ের মানুষের প্রাচীনকাল থেকেই চিরন্তন। মিসরের অনেক মমির পাশে ঝরাপাতা ও ফুল পাওয়া যায়। প্রেম হবে আর ফুল থাকবে না এটা অসম্ভব! বরেন্য অভিনেতা হুমায়ূন ফরিদী (প্রয়াত) জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে প্রণয় থেকে পরিণয়ে অভিষিক্ত হয়ে নববধূকে বরণ করেছিলেন শুধু ফুলের মালা দিয়ে, সোনার গয়না দিয়ে নয়। ফুলের মর্যাদায় বিয়ের বিষয়টি সেদিন প্রশংসা পেয়েছিল যা আজও নীরবে প্রণয়ের ইতিহাস হয়ে আছে। দেশে সারাবছরই কোন না ফুল ফোটে। গ্রামের পথেপ্রান্তরে নদী তীরের বনে ঝাউবনে অনাদরে কত না হাজার ফুল ফুটে ঝরে যায় অনাদরে! বর্ষায় নদী তীরের বনের ধার দিয়ে হাঁটলে দূর থেকে ভেসে আসে কেয়া ফুলের সুবাস। কামিনী ফুলও এভাবে সুবাস ছড়ায়। অথচ এসব ফুল চোখে পড়ে কম। মহুয়া ফুল এখন শুধুই কাব্যে। মহুয়া গাছে বড় হওয়ায় কুঠারের কোপ পড়ে সবার আগে, হারিয়ে যায়। কাঁঠালচাঁপা ফুল কোথায় তাও জানা হয় না অনেকের। এমন বহু ফুল এই দেশেই ফুটছে কোন না কোনসময়ে। নার্সারি মালিক ও উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা হাতেগোনা কয়েকটি ফুলের চারা তৈরি করছেন। বিজ্ঞানীরা ফুলের গবেষণা করছেন মার্কিন মুল্লুকের ক্যালিফোর্নিয়ায়। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ ও বিজ্ঞান বিভাগের সঙ্গে কয়েকটি দেশের গবেষণায় ফুল ফোটার নতুন তথ্য ও ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। উদ্ভিদ প্রকৃতি থেকেই পরিবেশগত চাপ সামলে ঋতু অনুযায়ী শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। এই ক্ষেত্রে ডিএনএ ও এপিজেনেটিক্স বিষয়টি কাজ করে। ফুল গাছের জেনেটিক্স বিষয়গুলো ফুল ফোটাতে বড় ভূমিকা রাখে। জেনেটিক্স গুণাবলির পরিবর্তনে একই ফুলের ভিন্ন রং হয়। যেমন গোলাপের অনেক রং লাল গোলাপী, হলদেটে সাদা বেগুনি কালো। বসন্তে বেশি ফোটে লাল গোলাপ। অন্য রঙের গোলাপ ফোটে বসন্তের আগে, পরে। বিজ্ঞানীরা জানান, যে গাছে সময়ের আগেই ফুল ফোটে সেখানে প্রজননে ঝুঁকি থাকে। অনেকটা গাইনিকোলজির ‘মিস ক্যারেজের’ মতো। এক্ষেত্রে উদ্ভিদের জিন বদলের কৌশল তৈরি হয়েছে, যা ফুল ফোটানোর সময় নিয়ন্ত্রণ করে। এক উদ্ভিদ বিজ্ঞানী তার এক লেখায় বলেছেন, ফুল গাছের কোষে উৎপন্ন জৈব রাসায়নিক পদার্থ নিজে পরিবর্তিত না হয়ে অনুঘটকের (ক্যাটালিস্ট) ভূমিকা নিয়ে অন্য পদার্থের পরিবর্তন ঘটিয়ে ফুল ফোটায়। এই এনজাইম প্রক্রিয়া সক্রিয় হয় বিশেষ তাপমাত্রায়, যার সক্রিয়তায় কৃত্রিমভাবে বছরের যে কোন সময় ফুল ফোটে, ফোটানো যায়। এতকিছুর পরও বিজ্ঞানীরা বলছেন উদ্ভিদের এই প্রক্রিয়ার এনজাইম বেশি সক্রিয় থাকে বসন্তেই। যেজন্য বসন্তবেলায় বেশি ফুল ফোটে দেশে দেশে। এরপর বর্ষা। এখন বলা হচ্ছে সারাবছর ফুল ফোটনো যায় বিকল্প প্রক্রিয়ায়। যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার বিজ্ঞানীরা পথেরধারে অনাদরে জন্মানো ইউরোশিয়ার সাদা রঙের আগাছা ধরনের এরাবিডোপসিস থালিয়ানো নামে একটি ফুল নিয়ে গবেষণা করেছেন। এই ফুলের চারটি বৃত্তাংশ, চারটি পাপড়ি ও ছয়টি পুংকেশর। তারা দেখলেন বিষয়টি এপিজেনেটিক (বা ডিএনএ পরিবর্তন) ফুল ফোটার সময় নির্ধারণে প্রধান ভূমিকা রাখে। এই পরিবর্তন হয় ডিএনএ ও ডিএনএর সঙ্গে সংযুক্ত প্রোটিনের রাসায়নিক সংশোধনের (কেমিক্যাল মডিফিকেশন) মাধ্যমে। এই পরিবর্তন জিনের অভিব্যক্তি প্রকাশ নিয়ন্ত্রণ করে। এরা সঙ্কেত দেয় বছরের কোন সময়ে ফুটতে হবে। তবে ডিএনএর পরম্পরা পরিবর্তন হয় না। এসিলাইটেশন হলো একটি নির্দিষ্ট রাসায়নিক সংশোধন প্রক্রিয়া, যা হিস্টোন নামে ডিএনএ সংযুক্ত প্রোটিনে ঘটে। প্রক্রিয়াটি নির্দিষ্ট কিছু প্রোটিনে কমবেশি হয়। বিজ্ঞানীরা এরাবিডোপসিস উদ্ভিদে ১৮ প্রোটিন পেয়েছেন। আবিষ্কার করেছেন ফুল ফোটানোর সময় কাল নির্ধারণ করে রাসায়নিক সংশোধন প্রক্রিয়ার সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে এসব প্রোটিন। কিছু প্রোটিন জৈবিক প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। অনেক গাছে আগেভাগেই ফুল ফোটে, বড় হয়। ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবের এক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জানান, বসন্তের তাপমাত্রায় ফুল ফোটাবার এক ধরনের প্রোটিনের আধিক্য ঘটে। যে কারণে বসন্তেই অধিকাংশ ফুল ফোটে। মরু গোলাপ নামের একটি ফুল ফোটে বসন্তের পরও। এই ফুলকে কেউ বলেন কিন্নরী। গাছ বেশ শক্ত। মাটি ছাড়াও পাথরকুচির মধ্যেও বাঁচতে পারে। এই ফুল প্রথম ফোটে রাজশাহী উপশহরের এক কৃষিবিদের বাড়ির ছাদের টবে। এখানে মরু গোলাপের প্রায় ৭০ জাত আছে। চারা লাগানোর মাস চারেক পর ফুল ফোটে। এই ফুলের বীজ থেকে চারা হয়। এই চারা বগুড়ার কয়েকটি নার্সারিতে বিক্রি করা হয়। বীজের চারার বদলে গ্রাফ্্টিং বা কলম করলে মরু গোলাপের চারা বৈশিষ্ট্য অবিকল থাকে। মরুগোলাপের ইংরেজি নাম ডেজার্ট রোজ। বৈজ্ঞানিক নাম এডিনিয়াম ওবেসাম। আদিনিবাস আফ্রিকার মরু অঞ্চলে। ওখান থেকে উষ্ণ অঞ্চলে গাছটি ছড়িয়ে পড়েছে। বিজ্ঞানীরা ফুল নিয়ে যে গবেষণা শুরু করেছেন তাতে চেনা ফুল ছাড়াও অনেক অচেনা ফুলের বহু জাত সারাবছর মিলবে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ফুলের বাণিজ্যিক চাষ শুরু হয়েছে। নিকটঅতীতে যশোরের গোদখালি ছিল ফুলের রাজ্য। ফুলের রাজ্য এখন ছড়িয়ে পড়েছে দেশের প্রতিটি প্রান্তে। বিজ্ঞানীদের গবেষণায় সারাবছরের ফুল রফতানির পথ সৃষ্টি করে দিয়েছে।
×