ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ফুটবলার আশার মনে অনেক আশা...

প্রকাশিত: ০৯:৩৯, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০

ফুটবলার আশার মনে অনেক আশা...

আশা বসে আছে কাঠের খাঁচায়/জীবনের জলসাঘরে কেবলই নাচায়/কখনও ঘৃণা, কখনও ভালোবাসায়/এই আশাই আজও মোরে বাঁচায়/জীবন কেটে যায় আশায় আশায় ...’ মানুষ বাঁচে একরাশ আশা নিয়ে। আশা নিয়েই জীবনের পথচলা তার। সেই পথ চলতে গিয়ে অনেকেই শুরুতে মুখ থুবড়ে পড়ে। খায় হোঁচট। কিন্তু যারা তাতে হতাশায় আচ্ছন্ন না হয়ে উঠে দাঁড়ায়, আবারও আশায় বুক বেঁধে সামনের পানে এগিয়ে চলে, তারাই একসময় সফলতার মুখ দেখে। এমনই সফলতার মুখ দর্শন করতে চান যিনি, কাকতালীয়ভাবে তার নামটিও আশা, আশা কর্মকার! দীর্ঘ ছয় বছর প্রতীক্ষার পর ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে বহুল আলোচিত মহিলা ফুটবল লীগের তৃতীয় আসর। ঢাকার কমলাপুরের বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোহাম্মদ মোস্তফা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত উদ্বোধনী ম্যাচে ফেবারিট বসুন্ধরা কিংস মুখোমুখি হয় ঢাকার উত্তরার ক্লাব বেগম আনোয়ার স্পোর্টিং ক্লাবের। খেলার আগেই ফলটা অনুমেয় ছিল, বড় ব্যবধানেই জিততে যাচ্ছে বসুন্ধরাই। হয়ও তাই, তারা আনোয়ারাকে শোচনীয়ভাবে বিধ্বস্ত করে। দেয় এক ডজন গোল! এই ম্যাচে আনোয়ারার হয়ে খেলেন আশা কর্মকার। যদিও খেলার শুরুতে প্রথম একাদশে ছিলেন না তিনি। একাদশে গোলরক্ষক ছিলেন তাহেরা খাতুন। ২০ মিনিট পর যখন বেগম আনোয়ারা স্পোর্টিং ক্লাবের কোচ জহির ইকবাল তাকে মাঠ থেকে তুলে নেন, ততক্ষণে প্রতিপক্ষ বসুন্ধরা কিংস ৩-০ গোলে এগিয়ে। খেলায় বসুন্ধরা প্রচুর আক্রমণ করে। গোলপোস্টে অনেক শট নেয়। এগুলোর মধ্যে ৯টি গোল হয়েছে, আর ১২-১৩টি শট দারুণভাবে প্রতিহত করেন আশা। অথচ ফুটবল খেলায় কোন অভিজ্ঞতা নেই তার! তাদের আক্রমণগুলো ঠেকাতে কেমন লেগেছে? আশার সাবলীল জবাব, ‘ভালই লেগেছে। আমি কিন্তু খেলতে গিয়ে মোটেও নার্ভাস ছিলাম না। আমি মনের আনন্দেই খেলার চেষ্টা করেছি।’ সাবিনা খাতুন, কৃষ্ণা রানী সরকার, মারিয়া মান্দাদের নিয়ে গড়া বসুন্ধরা কিংস যেন অনেকটা জাতীয় দলের মতোই। এই দলের হয়ে খেলছেন জাতীয় দলের মোট ১৯ ফুটবলার। অথচ অবাক করা বিষয় হলো, সাবিনা-কৃষ্ণা-মারিয়াদের নাম এর আগে কখনই শোনেননি আশা, দেখা তো দূরে থাক! এ প্রসঙ্গে পঞ্চদশী এই কিশোরীর ভাষ্য, ‘আমি তাদের নাম কখনও শুনিনি। দেখিওনি। এই প্রথম তাদের দেখলাম। খেলার আগে জেনেছি তারা জাতীয় দলে খেলেন। তবে তাদের সঙ্গে খেলে খুব ভাল লেগেছে। খেলার আগে আমাদের কোচ বলেন, তোমরা যাদের সঙ্গে খেলবে, তারা সবাই জাতীয় দলের ও বিকেএসপির খেলোয়াড়। অনেক গোল খাবে ঠিকই, কিন্তু তাই বলে ভয় পেও না। কোন চাপ নিও না। যে যার নিজের খেলাটা খেলো। আরও ভাল লেগেছে এখানে ঢাকায় খেলে। এখানকার পরিবেশ খুবই ভাল।’ এক ডজন গোল হজম করে আনোয়ারা স্পোর্টিং হেরেছে তাদের প্রথম লীগ-ম্যাচে। এই গোলগুলোর মধ্যেই ৯টিই হজম করেছে বদলি গোলরক্ষক আশা। দল এত বেশি গোলে হারায় বা নিজে এতগুলো গোল খাওয়ায় কি খেলা শেষে মন খারাপ হয়েছে? আশার সপ্রতিভ জবাব, ‘আরে না স্যার, এটা কোন কথা না, কি যে বলেন, খারাপ লাগবে কেন? খেলার মধ্যে তো হার-জিত থাকবেই।’ আশার দেশের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের জামতলায়। বঙ্গমাতা প্রাথমিক স্কুল ফুটবলে খেলেছেন রাজশাহীর বিরুদ্ধে, ২০১৮ সালে। ওটাই ছিল তার প্রথম ফুটবল খেলা। তার মানে মাত্র এক বছর ধরে গোলরক্ষক হিসেবে খেলছেন আশা! অনুর্ধ-১৭ বঙ্গমাতা ফুটবলে ২০১৮ সালে মাত্র ৩টি ম্যাচ খেলেছেন। এক ম্যাচে সর্বোচ্চ ২টির বেশি গোল হজম করেননি তিনি। ওই আসরে তার দল চাঁপাইনবাবগঞ্জ চ্যাম্পিয়নও হয়। ফুটবলীয় অভিজ্ঞতা বলতে এতটুকুই। আশাকে দেখেই প্রথম যেটা মনে হয়, মেয়েটা তো বেশ লম্বা! এ নিয়ে আশার কথা, ‘আমি যখন ক্লাস সিক্সে ভর্তি হলাম, মাসুদুল হক ইনস্টিটিউটে। তখন আমার উচ্চতা দেখে স্কুলের স্যার-ম্যাডামরা সবাই অবাক হয়ে বললেন, তুমি এত লম্বা, অথচ সিক্সে কিভাবে পড়ছ? আমি বলতাম, স্যার, আমি লম্বা ঠিকই, কিন্তু বয়স অনেক কম। আমার জন্ম ২০০৫ সালে। সহপাঠীরা বলত, কিরে, তুই এত লম্বা, পড়াশোনাটা ঠিকমতো করিস। আমি পড়াশোনায় অবশ্য ভালই। এখন নবম শ্রেণীতে পড়ি।’ আগামীতে জাতীয় দলের গোলরক্ষক হিসেবে নিজের নামটি পাকা করার স্বপ্ন দেখেন আশা। জাতীয় দলে খেললে ভাল অংকের অর্থ উপার্জন করে সংসারের অভাব ঘুচবে বলে মনে করেন তিনি। আশার বয়স যখন মাত্র দেড় বছর, তখন তার বাবা বিশ্বনাথ কর্মকার মারা যান। আশারা পাঁচ ভাই-বোন। মা শুরুতে কষ্ট করে সংসার চালালেও পরে কর্মক্ষম হওয়ায় আশার ভাইয়েরা এখন সংসার চালাচ্ছে। বড় ভাই সেলুনে কাজ করেন। বাংলাদেশ তো বটেই, বিশ্ব ফুটবলের কোন গোলরক্ষককেও চেনেন না বলে আশার কোন আদর্শ নেই। না, একজনকে চেনেন, ‘মেসিকে চিনি। ও স্ট্রাইকার হলেও ওর খেলা আমার ভীষণ ভাল লাগে।’ লাজুক উচ্চরণ আশার। আশার কোচ জহির ইকবাল বলেন, ‘আমি ১৫ বছর ঢাকায় ফুটবল খেলেছি। খেলাটি খারাপ বুঝি না। কিন্তু এই লীগ নিয়ে অনেক অসঙ্গতি আমার চোখে ধরা পড়েছে, যা না বললেই নয়। লীগের ফিকশ্চার যথাযথ হয়নি। তাছাড়া আমরা অন্য সব ক্লাব বাফুফের কাছে আবেদন করেছিলাম লীগ শুরুর আগে আমাদের খেলোয়াড়দের অনুশীলন করার পর্যাপ্ত সময় দেয়া হোক। কিন্তু বাফুফে সেটা দেয়নি। ফলে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।’ লীগের প্রথম ম্যাচে দল ডজন গোল ও নিজে নয় গোল হজম করলেও গোলরক্ষক হিসেবে ঠিকই নিজের দক্ষতা প্রমাণ করেছেন আশা, যা নজর কেড়েছে সবার। গ্যালারিতে তার খেলা দেখে মুগ্ধ হয়েছেন জাতীয় দলের কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনও। তার একটি খাতা আছে। লীগে যেসব খেলোয়াড়রা ভাল খেলবে (জাতীয় দলের খেলোয়াড় বাদে), তাদের নাম খাতায় টুকে রাখবেন তিনি। উদ্দেশ্য, পরবর্তীতে জাতীয় দলের ট্রায়ালে ডেকে তাদের পরখ করা। আশার নামটিও খাতায় লিখে রেখেছেন তিনি। তবে সেই সঙ্গে এটাও বলেছেন, ‘লীগ হচ্ছে লম্বা রেস। এখানে এক ম্যাচ ভাল খেলে পরের ম্যাচগুলো খারাপ খেললে কোন লাভ নেই, তার নাম ঠিকই তখন কাটা যাবে। কাজেই আশাকে এবং তার মতো অন্য সবাইকেও লীগের বাকি ম্যাচগুলোতেও এই নৈপুণ্যের ধারাবাহিতা বজায় রাখতে হবে। তাহলেই কপাল খুলতে পারে। নয়তো নয়।’ আশা কি পারবেন এই শর্ত পূরণ করে আগামীতে জাতীয় দলে ডাক পেয়ে নিজের আশা পূরণ করতে?
×