ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চীনে কুঁচিয়া রফতানি বন্ধ

প্রকাশিত: ১১:৫৫, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০

চীনে কুঁচিয়া রফতানি বন্ধ

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ করোনাভাইরাসের কারণে চীনের সঙ্গে আমদানি-রফতানি বন্ধ হওয়ায় কোটি কোটি টাকার ব্যবসায়িক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে জেলার আগৈলঝাড়া উপজেলার কুঁচিয়া ব্যবসায়ীরা। কুঁচিয়া সংগ্রহকারী ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কমপক্ষে পাঁচ শতাধিক পরিবার ব্যাংক ঋণ ও দাদন পরিশোধ নিয়ে মহাবিপাকে পড়েছেন। উপজেলার কুঁচিয়া ব্যবসায়ী সুশীল মণ্ডল, জয়দেব ম-ল, অর্জুন মণ্ডল, জহর মণ্ডল, ভীম মণ্ডল ও প্রদীপ বাড়ৈ বলেন, আগৈলঝাড়া থেকে আগে প্রতিমাসে কমপক্ষে চার কোটি টাকার কুঁচিয়া রফতানি হতো বিদেশে। বিশেষ করে রফতানির তালিকায় থাকা চীনেই রফতানি হতো ৯০ শতাংশ কুঁচিয়া। বাকি ১০ শতাংশ রফতানি করা হতো হংকং, তাইওয়ানসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশে। ফলে এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থেকে ভাগ্য বদল করেছিল অনেকেই। তারা আরও জানান, চীনের নাগরিকদের দৈনন্দিক খাদ্য তালিকায় কুঁচিয়া অন্যতম একটি জনপ্রিয় খাদ্য। কিন্তু দেশটিতে সম্প্রতি করোনাভাইরাস মারাত্মক আকারে বিস্তারের কারণে চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি থেকে চীনের সঙ্গে কুঁচিয়া রফতানি সম্পূর্ণ বন্ধ হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন উপজেলার কুঁচিয়া সংগ্রহকারী, ব্যবসায়ী ও রফতানির কাজের সঙ্গে জড়িত আড়তদারসহ প্রায় পাঁচ শতাধিক পরিবার। ব্যবসায়ীরা জানান, তারা আগে মাছ এবং কচ্ছপের ব্যবসা করতেন। আবার অনেকে ছিল বেকার। ব্যবসার জন্য ঢাকা আসা-যাওয়ার সূত্র ধরে যোগাযোগ হয় ঢাকার উত্তরার টঙ্গীর কামারপাড়া ও নলভোগ এলাকার অর্কিড ট্রেডিং কর্পোরেশন, আঞ্জুম ইন্টারন্যাশনাল ও গাজী এন্টারপ্রাইজসহ অন্যান্য কুঁচিয়া রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে তাদের সংগ্রহ করা কুঁচিয়া বিদেশে রফতানি করা হতো। রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় কুঁচিয়া ব্যবসার সম্প্রসারণের জন্য স্থানীয় কুঁচিয়া ব্যবসায়ীদের দাদনে টাকা দিতেন। ওইসকল প্রতিষ্ঠান থেকে আগৈলঝাড়ার কুঁচিয়া ব্যবসায়ীরা পাঁচ থেকে দশ লাখ টাকা পর্যন্ত দাদনে (সুদে বা তাদের কাছে কুঁচিয়া বিক্রির শর্তে) গ্রহণ করতেন। রফতানিকারকদের কাছে কুঁচিয়া বিক্রির মাধ্যমে দাদনের টাকা পরিশোধ করতেন ব্যবসায়ীরা। এভাবেই স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে কুঁচিয়ার বাজারের ক্রমঃবিকাশ ঘটিয়ে কুঁচিয়া শিকারি, মজুদ ও ব্যবসার মাধ্যমে পাঁচ শতাধিক পরিবার সচ্ছলতায় জীবিকা নির্বাহ করে আসছিলেন। সম্প্রতি সময়ে করোনা ভাইরাস মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ায় চীনের সঙ্গে অন্যান্য ব্যবসা বাণিজ্যের মতো কুঁচিয়া রফতানি পুরোপুরি বন্ধ হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন দাদন নেয়া কুঁচিয়া সংগ্রহকরী ও ব্যবসায়ীরা। ফলে বেকার হয়ে পড়েছেন কুঁচিয়া ধরা শ্রমজীবী লোকজন। কিছুদিন আগেও রফতানিযোগ্য কুঁচিয়া সংগ্রহ ও রফতানি জন্য যে আড়তগুলো ছিল কর্মচঞ্চল আজ সেখানে শুধু শূন্যতা। জনশূন্য হয়ে পড়েছে কুঁচিয়ার আড়তগুলো। কাজ না থাকায় অলস শ্রমিকদের বেতনের জন্য আড়তদারদের গুনতে হচ্ছে মাসিক বেতন। আগামী এক মাসের মধ্যে চীনে রফতানি কার্যক্রম পুনঃরায় শুরু না হলে ব্যবসায়ীদের মজুদ করা কুঁচিয়া সম্পূর্ণ মারা যাওয়ার আশঙ্কা করছেন আড়তদাররা। রফতানি বন্ধ থাকায় কুঁচিয়া সংগ্রহকারীদের কাছ থেকে কুঁচিয়া কিনতে চাচ্ছেন না আড়তদাররা। যে কারণে বেশিরভাগ গরিব জেলে এখন কুঁচিয়া ধরা বন্ধ করে দিয়েছেন। অর্থিক অনটনের মধ্যে জীবন-যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে ওইসকল পরিবারের লোকজন। সূত্রমতে, নবেম্বর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত কুঁচিয়ার মৌসুম থাকলেও জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি দুইমাস কুঁচিয়ার প্রাপ্তির ভরা মৌসুম। কিন্তু ভরা মৌসুমের শুরুতেই করোনাভাইরাসের কারণে কুঁচিয়া ব্যবসায় পুরোপুরি ধস নামায় মহাবিপাকে পড়েছেন কুঁচিয়া ধরা শ্রমিক, ব্যবসায়ী, আড়তদারসহ সংশ্লিষ্ট আড়তের শ্রমিকরা। কুঁচিয়া সংগ্রহকারী রাজিহার গ্রামের সুশীল রায় জানান, আগে আড়তদারদের কাছ থেকে দাদন নিয়ে প্রতিদিন পুকুর, ডোবা-নালা, খাল-বিল থেকে কুঁচিয়া ধরে আট শ’ থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করতেন। বর্তমানে রফতানি বন্ধ হওয়ায় কোন আড়তদার কুঁচিয়া কিনতে চাইছে না। তাই তাদের সংসার চালানো এখন খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। উপজেলা সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা রোজিনা আকতার বলেন, করোনা সংক্রমণের জন্য চীনে কুঁচিয়া আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। যে কারণে এলাকার কুঁচিয়া ব্যবসায় ধস নেমেছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার চৌধুরী রওশন ইসলাম বলেন, উপজেলার বহু মৎস্য চাষীরা কুঁচিয়া চাষ করার পাশপাশি মজা পুকুর, ডোবা-নালা, খাল থেকে কুঁচিয়া সংগ্রহ করে আড়তে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছিলেন। যে কারণে এখানে কুঁচিয়া চাষের একটি পাইলট প্রকল্প চালু করেছিল সরকারের মৎস্য অধিদফতর। সিডরের কারণে ওই মাস্টার প্রকল্প বাতিল হয়ে যায়। তারপরেও কুঁচিয়া সংগ্রহ, রক্ষণাবেক্ষণ ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত থেকে অসংখ্য মানুষ কর্মজীবনের মাধ্যমে আর্থিক সচ্ছলতায় দিন যাপন করতেন। সম্প্রতি চীনে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় কুঁচিয়া রফতানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে কারও কিছু করার নেই। তারপরেও আমরা আশা করছি এটি একটি সাময়িক সমস্যা। আমরা ধারণা করছি অচিরেই এ সমস্যাটি দূর হয়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, মজুদকৃত কুঁচিয়া আমাদের দেশীয় বাজারে বিক্রি করা সম্ভব হলে একটু হলেও লোকসানের হাত থেকে রক্ষা পাবে কুঁচিয়া সংগ্রহকারী জেলে ও আড়তদাররা।
×