ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ক্যারিয়ারসেরা বোলিং নাঈমের

প্রকাশিত: ১২:০৪, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০

ক্যারিয়ারসেরা বোলিং নাঈমের

মোঃ মামুন রশীদ ॥ অভিষেক টেস্টসহ ক্যারিয়ারে আগের যে ৩ টেস্টে বোলিং করার সুযোগ পেয়েছেন নাঈম হাসান, তাকে সব ম্যাচেই সতীর্থ আরও ৩ স্পিনারের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে। অভিজ্ঞ দুই বাঁহাতি স্পিনার তাইজুল ইসলাম ও সাকিব আল হাসানের পাশাপাশি ডানহাতি অফস্পিনার মেহেদী হাসান মিরাজও ছিলেন তার সঙ্গে একাদশে। অভিষেক টেস্টের প্রথম ইনিংস ৬১ রানে ৫ উইকেট নিয়ে বাকিদের ম্লান করে দিলেও দ্বিতীয় ইনিংসে উইকেটশূন্য ছিলেন। দ্বিতীয় ইনিংসে দুর্দান্ত বোলিং করে ম্যাচের সেরা বোলিং নৈপুণ্য দেখান তাইজুল। পরের ৩ টেস্টেও একাদশে এই তিন স্পিনারের সঙ্গে বোলিংয়ের লড়াইয়ে পারেননি নাঈম। অভিষেকে নিজের সেরা বোলিং নৈপুণ্যকেও ছাড়িয়ে যেতে পারেননি। তবে এবার নিজের সেরা পারফর্মেন্স দেখিয়েছেন। জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে মিরপুর টেস্টে তার প্রতিদ্বন্দ্বী বলতে শুধু তাইজুল ছিলেন। নাঈমের ওপর টিম ম্যানেজমেন্টের যে আস্থা ছিল সেটার প্রতিদান খুব ভালভাবেই দিয়েছেন তিনি। দ্বিতীয় ইনিংসে তাইজুলের সঙ্গে সমানে সমান লড়াই চলছিল, তবে ৫ উইকেট নিয়ে তাইজুলকে (৪ উইকেট) পেছনে ফেলেন নাঈম। প্রথম ইনিংসে নাঈম ৪ ও তাইজুল ২ উইকেট নিয়েছিলেন। ম্যাচে ১৫২ রান দিয়ে ৯ উইকেট শিকার করে ম্যাচের সেরা বোলিং নৈপুণ্য তাই প্রথমবারের মতো দেখাতে পেরেছেন নাঈম। প্রায় দুই বছর আগে অভিষেক ম্যাচেই বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ডানহাতি অফস্পিনার নাঈমের। সফরকারী ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টে তখন মাত্র ১৭ বছর বয়সী এ তরুণের সঙ্গে নেমেছিলেন টেস্ট ক্রিকেটে পরীক্ষিত আরও তিন স্পিনার- সাকিব, তাইজুল ও মিরাজ। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট, সেটিও আবার মর্যাদার দীর্ঘ পরিসরের টেস্টে যাত্রাতেই তবু চমক দেখিয়েছেন নাঈম। ২০১৮ সালের নবেম্বরে চট্টগ্রামে হওয়া সেই টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৬১ রানে ৫ উইকেট শিকার করেন। তবে দ্বিতীয় ইনিংসে আর সেটি ধরে রাখতে পারেননি তাইজুল দুর্বার হয়ে ওঠার কারণে। প্রথম ইনিংসে ম্লান তাইজুল ১ উইকেট নিলেও দ্বিতীয় ইনিংসে ৩৩ রানে ৬ উইকেট নিয়ে ম্যাচের সেরা বোলিং নৈপুণ্য দেখান। সাকিবও প্রথম ইনিংসে ৪৩ রানে ৩ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ৩০ রানে ২ উইকেট নিয়ে নাঈমের ম্যাচ পারফর্মেন্সকে (৫/৯০) পেছনে ফেলেন। সেই সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে নাঈম আরও অনুজ্জ্বল হয়ে যান মিরাজের দাপটে। প্রথম ইনিংসে ৭ উইকেট নেয়ায় মিরাজ দ্বিতীয় ইনিংসেও ৫ উইকেট শিকার করে বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসেই ম্যাচসেরা বোলিং নৈপুণ্যের নজির গড়েন। ম্যাচে ১১৭ রানে ১২ উইকেট নিয়েছিলেন তিনি। প্রথম ইনিংসে উইকেটশূন্য নাঈম দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ১ উইকেট নিতে সক্ষম হন। ম্যাচে সাকিব ৪টি ও তাইজুল ৩টি উইকেট নিয়েছিলেন। ক্যারিয়ারের তৃতীয় টেস্টে প্রায় ১ বছর পর গত সেপ্টেম্বরে আফগানিস্তানের বিপক্ষে খেলতে নামেন নাঈম। প্রথম ইনিংসে ৪৩ রানে ২ এবং দ্বিতীয় ইনিংসে ৬১ রানে ২ উইকেট নিতে পেরেছিলেন। ম্যাচের সেরা নৈপুণ্য তাইজুলের- প্রথম ইনিংসে ১১৬ রানে ৪ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ৮৬ রানে ২ উইকেট শিকার করে। এছাড়া সাকিবও ৫ উইকেট নিয়েছিলেন ম্যাচে। অর্থাৎ সবমিলিয়ে ৩ টেস্টে মাত্র ১০ উইকেট নাঈমের ঝুলিতে জমা হয়। গত নবেম্বরে কলকাতায় ভারতের বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্টে নাঈম ফিরেছিলেন। অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী মিরাজ ইন্দোরে প্রথম টেস্ট খেললেও তার কারণে একাদশের বাইরে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্য প্রসন্ন হয়নি তার। প্রথম ইনিংসে ব্যাট করার সময় মাথায় বল লাগলে আর বোলিং করতে পারেননি, মিরাজই শেষ পর্যন্ত কনকাশন সাব হিসেবে জায়গা করে নেন। সর্বশেষ পাকিস্তানের বিপক্ষে রাওয়ালপিন্ডি টেস্টেও জায়গা পান নাঈম, মিরাজ ছিলেন না। সেখানে অবশ্য খেলা হয়নি নাঈমের। অবশেষে ফিরেছেন জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে একমাত্র টেস্টের একাদশে। মিরাজ স্কোয়াডে থাকলেও ছিলেন দর্শক। সাকিবও অনুপস্থিত। তাই লড়াইটা ছিল শুধু তাইজুলের সঙ্গে তার। প্রতিদ্বন্দ্বী কমে গেলেও সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ ছিল এবারের উইকেট। মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সাধারণত স্পিননির্ভর উইকেট দেখা যায়। টেস্ট ক্রিকেটে অবধারিতভাবেই তেমনটা থাকে স্বাগতিক বাংলাদেশ দলের সুবিধা বাড়াতে। তবে জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে একমাত্র টেস্টে স্পিনারদের জন্য তেমন সুবিধা ছিল না। কিন্তু এমন উইকেটেও ৩ টেস্ট পর বোলিং করার সুযোগ পেয়ে ঘূর্ণির ক্যারিশমা দেখিয়েছেন নাঈম হাসান। তাইজুল যেখানে ম্লান সেখানে প্রথমদিনই নাঈম ৪ উইকেট তুলে নেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তাইজুলও ২ উইকেট পেয়েছিলেন। তবে দ্বিতীয় ইনিংসে জ¦লে ওঠেন এ দুই স্পিনার। শুরুটা করেছিলেন নাঈম আগেরদিন পড়ন্ত বিকেলে জিম্বাবুইয়ে ব্যাট করতে নামার পর প্রথম ওভারেই। জোড়া উইকেট তুলে নেন তিনি সেই ওভারে। চতুর্থদিন আরও ৩ উইকেট তিনি নিয়েছেন, তবে ৪টি পেয়েছেন তাইজুল। প্রথম ইনিংসে ৭০ রানে ৪ এবং দ্বিতীয় ইনিংসে ৮২ রানে ৫ উইকেট নিয়ে ম্যাচে ১৫২ রানে ৯ উইকেট নিয়ে শেষ করেন নাঈম। আর তাইজুল প্রথম ইনিংসে ৯০ রানে ২ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ৭৮ রানে ৪ ম্যাচে ১৬৮ রানে ৬ উইকেট। এবার ফ্ল্যাট উইকেটে বোলিংয়ে নেমেও তাইজুলকে পেছনে ফেলেছেন, সঙ্গে সঙ্গে নিজের সেরা পারফর্মেন্সকেও পেছনে ফেলেছেন। ম্যাচে ৯ উইকেট এর আগে পাননি। আগের ৩ টেস্টে সেরা ম্যাচ পারফর্মেন্স ছিল ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে ২০১৮ সালে চট্টগ্রামে অভিষেকে ৯০ রানে ৫ উইকেট। জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে নিজেকেই ছাড়িয়ে গেছেন। এর আগে টেস্টে বাংলাদেশের পক্ষে এক ম্যাচে ৯ উইকেট বা তার বেশি পেয়েছেন ৮ বোলার ১২ বার। ৯ম বোলার হিসেবে ১৩তম ঘটনা নাঈমের। তবে এর মধ্যে ম্যাচে ১০ উইকেট বা তার বেশি পেয়েছেন বাংলাদেশের ৪ বোলার মোট ৬ বার (মিরাজ ২, সাকিব ২, তাইজুল ও এনামুল হক জুনিয়র)। ম্যাচে ৯ উইকেট নেয়ার ঘটনা বাকি ৭টি। নাঈমের এমন পারফর্মেন্সের পর অধিনায়ক মুমিনুল হক বলেন, ‘দেখুন নাঈম মাত্র ক্যারিয়ার শুরু করল। আমি এটা নিয়ে খুব বেশি বলতে চাই না। সে অনেক ভাল বোলিং করেছে মাশাআল্লাহ। আশাকরি আরও ভাল করবে। এটা নিয়ে আমি খুব বেশি বলতে চাই না, মানে আউটস্ট্যান্ডিং টাইপ কিছু বলতে চাই না। ওর অনেক কিছু করার বাকি আছে। ধীর ধীরে সে উন্নতি করবে, আরও করতে হবে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শুরুতে বোঝা যায় না। আমার কাছে মনে হয় ওকে আরও উন্নতি করতে হবে।’ নিজের পারফর্মেন্সে যে উন্নতি ঘটিয়েছেন তাতে সন্দেহ নেই। পরিসংখ্যানই নাঈমের পক্ষে কথা বলছে। তবে মিরাজের সঙ্গেও তার প্রতিদ্বন্দ্বিতাটা জমে উঠেছে। দু’জনই ডানহাতি অফস্পিনার এবং কলকাতার পর এবার মিরপুরেও মিরাজকে একাদশের বাইরে ঠেলে নিজে খেলার সুযোগ করে নিয়েছেন নাঈম। প্রমাণও করেছেন নিজের সেরা পারফর্মেন্স দেখিয়ে। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে মুমিনুল বলেন, ‘সবসময় গুরুত্বপূর্ণ (এমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা)। বিশ্বের সব বড় বড় দলগুলোতেই কিন্তু এ জিনিসটা আছে। এ রকম হেলদি প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকা ভাল, দলের পারফর্মেন্সের জন্য ভাল। আর নাঈমের ব্যাপারে দেখেন সে কিন্তু অনেকদিন থেকেই লাইনআপে ছিল এবং ভাল বোলিং করছে। এর মানে মিরাজ খারাপ বোলিং করছে এমনটা না। নাঈমকে একটু সুযোগ দেয়া হয়েছে।’ যেভাবেই হোক নাঈম সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন তাতে কোন সন্দেহই নেই মিরপুর টেস্টের পর।
×