ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নেত্রকোনার হরিজন পল্লী

প্রকাশিত: ০৮:০০, ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০

নেত্রকোনার হরিজন পল্লী

শহরে বাস করলেও শহর জীবনের কোন ছোঁয়া লাগেনি নেত্রকোনার হিন্দু হরিজন পল্লীতে। প্রতিদিন রাত পোহাবার আগেই যারা শহরকে পরিচ্ছন্ন করে- তারা নিজেরাই বাস করছে দুর্গন্ধযুক্ত, আবর্জনাময়, নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। খুপড়ি ঘরে, ঘিঞ্জি পরিবেশে অত্যন্ত মানবেতর জীবন-যাপন করছে তারা। পাচ্ছে না মৌলিক চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তা। নেত্রকোনা শহরের পূর্ব চকপাড়া এলাকায় এ হিন্দু হরিজন পল্লী অবস্থিত। সেখানে মোট ৩৬টি হরিজন পরিবারে আড়াই শতাধিক মানুষ বাস করে। এছাড়াও শহরের পুরাতন হাসপাতালের পিছনে, কুড়পারে এবং সাখুয়া এলাকায় আর কিছু হিন্দু হরিজন পরিবার রয়েছে। সরেজমিনে পূর্ব চকপাড়ার হরিজন পল্লীতে গিয়ে দেখা গেছে, থাকার ঘরগুলো ছোট ছোট খুপড়ির মতো। একেকটি ঘরে স্বামী-স্ত্রী, বাবা-মা এবং ছেলে-মেয়েসহ ৭-৮জন মানুষ গাদাগাদি করে বাস করছে। পাকিস্তান আমলে পৌরসভার পক্ষ থেকে ১৯টি পরিবারের জন্য ১৯টি পাকা কক্ষ নির্মাণ করে দেয়া হয়েছিল। এসব কক্ষের ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ছে। কক্ষগুলো পুরনো ও জরাজীর্ণ হয়ে গেছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে তারা। বাকি ১৭টি পরিবার নিজে উদ্যোগে পরিত্যক্ত জায়গায় ছোট ছোট ঘর নির্মাণ করে থাকছে। ঘর বলতে আসলে একেকটি খুপড়ি। বেশিরভাগ ঘরের চাল, বেড়া এবং দরজা-জানালা ভাঙ্গা। সামান্য বৃষ্টি হলেই চালের ছিদ্র দিয়ে পানি পড়ে। ঘিঞ্জি ঘরগুলোর আশপাশের যত্রতত্র পড়ে আছে ময়লা-আবর্জনা। ময়লা ফেলার জন্য তাদের নির্দিষ্ট কোন জায়গা নেই। বছরের পর বছর ধরে এমন দুর্ভোগের মধ্যে বাস করছে তারা। পল্লীর সর্দার রতন বাসফোর এবং আরেক বাসিন্দা শুকলাল বাসফোর জানান, ‘হরিজনপল্লীর সবচেয়ে বড় সঙ্কটÑ থাকার জায়গা। অন্যান্য শহরে হরিজনদের জন্য আবাসিক ভবন নির্মাণ করা হলেও আমাদের ভাগ্যে তা জোটেনি।’ এ হরিজনপল্লীতে আজও পৌরসভার পানি সরবরাহ চালু হয়নি। একটি নলকূপ ছিল। সেটিও এখন নষ্ট। এনজিওর উদ্যোগে স্থাপিত একটি বিদ্যুৎচালিত মোটরের পানি দিয়ে ৩৫টি পরিবার চলে। ফলে পানির জন্য সারাক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। ৩৫টি পরিবারের জন্য টয়লেট আছে মাত্র ৩টি। সেখানেও ভোর থেকে লাইন লাগে। কোন গোসলখানা নেই। পুরুষদের কেউ কেউ নিউটাউন এলাকার একটি পুকুরে গিয়ে গোসল করেন। পায়েল বাসফোর নামে এক কিশোরী জানান, ‘পানির অভাবে আমরা মেয়েরা অনেক সময় গোসল করতে পারি না।’ হরিজনপল্লীর পাশে পৌরসভার একটি এবং রেলওয়ের জমিতে আরেকটি পুকুর ছিল। পৌরসভার পুকুরটিকে ভাগাড় বানিয়ে অনেক আগেই ভরাট করা হয়েছে। অন্যদিকে রেলওয়ের পুকুরটিও ইজারা নিয়ে ভরাট করে ফেলেছেন এক ব্যক্তিÑ যদিও তা বেআইনী। এ কারণে প্রকট পানি সঙ্কটে ভুগছেন তারা। এদিকে পৌরসভার পুকুরে জমা করা ময়লা আবর্জনা থেকে সবসময় দুর্গন্ধ ছড়ায়। বাতাস শুরু হলে দুর্গন্ধে টেকা যায় না। হরিজনপল্লীর চারপাশে কোন বেষ্টনী নেই। এর ফলে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে থাকতে হয় তাদের। হরিজনরা নিজেদের জন্য চোলাই মদ তৈরি করে। বাঙালী মাদকসেবীরা সন্ধ্যার পর সেখানে ভিড় জমায়। ঝরনা বাসফোর নামে এক নারী জানান, ‘সন্ধ্যার পর বহিরাগত মদ্যপরা মদ খাওয়ার উদ্দেশ্যে হরিজন পল্লীতে চলে আসে। আমরা মদ খেতে না দিলে তারা আমাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। জিনিসপত্র চুরি করে নিয়ে যায়। ঘরের ওপর ঢিল ছুঁড়ে। মেয়েদের উদ্দেশ্যে অশালীন গালিগালাজ করে। এ কারণে মেয়েদের নিয়ে সব সময় আমাদের উৎকণ্ঠায় থাকতে হয়। আবার যখন বহিরাগত মদ্যপরা আসেÑ তখন পুলিশ হানা দেয়। আমাদের লোকদের ধরে নিয়ে তাদের ওপর মামলা দেয়।’ এ হরিজনপল্লীর অনেকের নামে মাদক বেচার মামলা রয়েছে বলে জানিয়েছেন তারা। হরিজনরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। পৌরসভার পরিচ্ছন্নকর্মী হিসেবে কাজ করে মাত্র ৩৯ জন। তারা প্রতি শিফটের পারিশ্রমিক বাবদ মাসে মাত্র ১ হাজার টাকা করে বেতন পান। বলার অপেক্ষা রাখে নাÑ চাহিদার তুলনায় এ পারিশ্রমিক খুবই সামান্য। তাই নিরূপায়ে তারা শহরের বাসিন্দাদের বাসাবাড়িতে ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারের কাজ করে করেন। কাজ না পেলে অনেকের উপোস থাকতে হয়। ওদিকে হিন্দু হরিজন পল্লীর মাত্র তিনজন নারী পৌরসভার ঝাড়ুদারের কাজ করেন। বাকি প্রত্যেকে বেকার। তাদের অভিযোগ, পৌরসভায় ঝাড়ুদার হিসেবে যেসব নারীদের নিয়োগ দেয়া হয়েছেÑ তাদের বেশিরভাগ বাঙালী এবং মুসলিম ধর্মাবলম্বী। হিন্দু হরিজন সম্প্রদায়ের নারীরা এ ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। এদিকে হরিজন পল্লীর অনেক কিশোর-যুবক বেকার থাকলেও তারা পৌরসভায় বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে কাজ পাচ্ছেন না। বাঙালিদের মধ্য থেকে পরিচ্ছন্নকর্মী নিয়োগ দেয়ায় তাদের বেকারত্ব বাড়ছে বলে দাবি করেন তারা। হরিজন পল্লীতে অনেক বিধবা এবং বৃদ্ধ বাসিন্দা রয়েছেন। তাদের অনেকের পরিবারে উপার্জনক্ষম মানুষ নেই। কিন্তু সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর নানা সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। রানী বাসফোর, ছটিয়া বাসফোর, নূরী বাসফোর, মিরা বাসফোর, অমলি বাসফোর, সুন্দরী বাসফোর, ছায়া রানী বাসফোর, মায়া রানী বাসফোর, গীতা রানী বাসফোরসহ অনেকে জানান, তারা বিধবা হওয়া সত্ত্বেও কোন ভাতা পাচ্ছেন না। অন্যদিকে জয়রাজ বাসফোর, অনিল বাসফোর, মতিলাল বাসফোরের মতো ষাটোর্ধ বৃদ্ধরাও ভাতার আওতায় আসেননি। একটি আশার কথা হচ্ছেÑ নানা অভাব অনটন এবং শত প্রতিকূলতা থাকা সত্ত্বেও হরিজন পল্লীর কিছু ছেলেমেয়ে এখন পড়ালেখা করছেÑ যদিও তা শতভাগের কাছাকাছি পৌঁছায়নি। সিমবায়োসিস নামে একটি উন্নয়ন সংস্থা ওই পল্লীতে একটি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র পরিচালনা করছে। সেখানে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের পর ছেলেমেয়েরা শহরের অন্যান্য স্কুলে গিয়ে ভর্তি হচ্ছে। কিন্তু বেশিরভাগ শিক্ষার্থী এসএসসি পাশ করার আগেই দারিদ্র্যের কারণে ঝরে যায়। তারা পৈত্রিক পেশায় জড়িয়ে যায়। ফলে তাদের শিক্ষাজীবন মাঝপথে থেমে যায়। এ পল্লীতে রাসেল বাসফোর, পায়েল বাসফোর এবং পিয়া বাসফোর নামে মাত্র তিনজন শিক্ষার্থী এসএসসির গ-ি পেরিয়ে উচ্চমাধ্যমিকে পড়ালেখা করছে। এরাই হরিজন পল্লীর সর্বোচ্চ শিক্ষিত ছেলেমেয়ে। তবে ভবিষ্যতে চাকরি পাবে কি না তা নিয়েও সন্দিহান তারা। হিন্দু হরিজন পল্লীর নানা সমস্যা এবং অভাব-অভিযোগ প্রসঙ্গে নেত্রকোনা পৌরসভার মেয়র নজরুল ইসলাম খান জানান, হরিজন পল্লীর বাসস্থান সঙ্কট দূর করার জন্য স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের উদ্যোগে ‘পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্য আবাসিক ভবন নির্মাণ’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় প্রায় ছয়কোটি টাকা ব্যয়ে ছয়তলা বিশিষ্ট আবাসিক ভবন নির্মাণ করার পরিকল্পনা রয়েছে। ৭৫ শতক ভূমির ওপর এ ভবনে অন্তত ১৬০টি পরিবার থাকার সুবিধা পাবে। প্রতিটি পরিবারকে ২টি কক্ষ, একটি রান্নাঘর, বারান্দা এবং দুই পরিবারের জন্য একটি করে টয়লেট বরাদ্দ দেয়া হবে। শীঘ্রই প্রকল্পের দরপত্র আহ্বান করা হবে। এছাড়া হরিজনদের বেতনভাতা বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়েও ভাবা হচ্ছে বলে জানান তিনি। -সঞ্জয় সরকার, নেত্রকোনা থেকে
×