ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিশেষায়িত স্কুল ॥ বগুড়ায় শিশুদের মুখে হাসি

প্রকাশিত: ০৮:০০, ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০

  বিশেষায়িত স্কুল ॥ বগুড়ায় শিশুদের  মুখে হাসি

ভাটকান্দি এলাকার রিক্সাচালক তমিজ উদ্দিনের পরিবারের ঘরে যখন প্রথম শিশু এলো স্বজনরা খুব খুশি। কেউ বলল ভাঙা ঘরে চাঁদের আলো। এই আলো ফিকে হতে সময় লাগলো না। বছর না ঘুরতেই ছেলে শিশুর আচরণ আর দশজন শিশুর মতো না হওয়ায় মা কিছুটা বুঝতে পারেন। বাদ সাধে স্বামী। রেগে গিয়ে ধমক দেয়। বয়স বেড়ে গেলে তারা বুঝতে পারে ছেলের কিছু একটা হয়েছে। চিকিৎসকের কাছে গেলে বুঝিয়ে বলা হয় এই সন্তান বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। চিকিৎসায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আনা যায় না। তবে এদের পছন্দমতো প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মক্ষম করে পুনর্বাসন করা যায়। এ ধরনের বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য বগুড়ায় গড়ে তোলা হয়েছে একটি বিশেষায়িত স্কুল। যা গড়তে সহযোগিতা দিয়েছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের কে-২৯ ব্যাচ ফাউন্ডেশনের কয়েকজন চিকিৎসক। যেখানে বর্তমানে ৭৫ জন বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিশুকে বহুমূখী প্রশিক্ষণ দিয়ে পুনর্বাসিত করা হচ্ছে। এইসব শিশুর বেশিরভাগই দরিদ্র দিনমজুর পরিবারের। বাংলাদেশে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিশুদের পুনর্বাসনে কাজ শুরু করে ১৯৮৬ সালে নরওয়ের সুইড নামের একটি সংস্থা। ওই সময় বগুড়া শহরের মালতিনগরে একটি ভাড়া বাড়িতে ছোট্ট পরিসরে কয়েকজন অটিস্টিক শিশু নিয়ে যাত্রা শুরু হয়। ১৯৯৫ সালে সুইড প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার ভার দেশীয়দের হাতে বুঝিয়ে দিয়ে চলে যায়। কিছুদিন পর তা বন্ধ হয়ে যায়। বিষয়টি জানতে পারে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের (ঢামেক) কে-২৯ ব্যাচের (যারা ১৯৭৬ সালে এমবিবিএস পাস করেছেন এবং আরও উচ্চতর ডিগ্রী নিয়েছেন) বগুড়ার কয়েকজন চিকিৎসক। তারা সতীর্থদের সংগঠিত করে একটি ফাউন্ডেশন গঠন করে বগুড়ার অটিস্টিক চিলড্রেনের প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে ‘বগুড়া বুদ্ধি প্রতিবন্ধী স্কুল’ নামকরণ করেন। এরপর শহরের মালতিনগরে একটি ভাড়া বাড়িতে কার্যক্রম শুরু হয়। আশপাশের লোকজনের কাছে খবর পৌঁছে গেলে তারা অটিস্টিক শিশুদের সেখানে ভর্ত্তি করান। প্রতিষ্ঠানটি চলতে থাকে ঢামেক কে-২৯ ব্যাচের চিকিৎসক, বিশিষ্ট চিকিৎসকগণ এবং সমাজের দানশীল ও বিত্তবানদের অর্থ সহযোগিতায়। সকল অর্থ অটিস্টিক শিশুদের সার্বিক কল্যাণে ও প্রশিক্ষণে ব্যয় হয়। ছোট বড় সকল শিশুকে দুপুরে পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিশুর সংখ্যা বেড়ে গেলে প্রয়োজন হয় বড় পরিসরের। এ সময় বগুড়া সদরের নদীর তীরে ভাটকান্দি ব্রিজের কাছে ২০১৫ সালে এলাকার দানশীল আব্দুল গফুর ৫ শতাংশ ভূমি স্কুলের নামে লিখে দেন। এই ভূমিতে স্কুলের নামে ব্যংকে এফডিআর করা ৭ লাখ টাকায় পাকা ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। তারপর ঢামেক কে-২৯ ফাউন্ডেশন, সমাজের ও বিত্তবান মানুষের সহযোগিতা প্রাপ্তিসাপেক্ষে ধীরগতিতে নির্মাণ কাজ চলে। এ বছরের শুরুতে দ্বিতল ভবনের কাজ শেষ হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল না থাকায় বিদ্যমান মাটির সরু রাস্তা কোন রকমে ঠিক করে শিক্ষার্থীদের পৌঁছাবার ব্যবস্থা করা হয়। তারপরও স্কুলে পৌঁছার কিছু আগে নেমে হেঁটে যেতে হয়। পথঘাটের এই দুরবস্থার বিষয়টি পৌর মেয়র ও আশপাশের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে জানানো হয়েছে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক মিতুল বেবি বসাক জানান, কেজি শ্রেণী থেকে ১৮ বছরের বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েদের ভর্তি করা হয়। তাদের পরিবহনে একটি পিকআপ গাড়ি ও কয়েকটি রিক্সা ভ্যান কেনা হয়েছে। তবে তা যথেষ্ট নয়। বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের মানসিক অবস্থা ভাল রাখতে নাচগান ছবি আঁকা ও হাতের কাজ শেখানো হয়। ছেলে ও মেয়েদের কাজের উপযোগী বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এ জন্য চারজন শিক্ষক রয়েছেন। প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের সমবেত করে জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয়। স্কুলে প্রতিদিন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলে সকাল ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত শিশুদের এবং ৯টা থেকে ২টা পর্যন্ত বড়দের। ১৮ বছরের পরে কোন শিশুকে রাখা হয় না। তারা প্রশিক্ষণ পেয়ে কোন স্থানে কাজ খুঁজে পায়। কখনও কাজ পেতে তাদের সহযোগিতা দেয়া হয়। এই স্কুলে ১৯৮৬ সাল থেকে অটিস্টিক শিশুদের শারীরিক অসুখ বিসুখে চিকিৎসা দিচ্ছেন ডাঃ আরশাদ সায়ীদ। বললেন এই শিশুদের একটু যতœ নিলেই সমাজের মূল ¯্রােতে ফিরে আনা যায়। ডাঃ আরশাদ সায়ীদ ঢামেক কে-২৯ ফাউন্ডেশনের একজন সক্রিয় সদস্য। প্রধান শিক্ষক মিতুল বসাক বেবি বললেন গত ক’বছরে এই স্কুলের সাত জন প্রতিবন্ধী মেয়েকে রোজগেরে ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেয়া হয়েছে। তারা স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে আছে। জানালেন অনেক চিকিৎসক ও সমাজের দানশীল ব্যক্তি এই স্কুলের উন্নয়ন কর্মকা-ে সহযোগিতা দিচ্ছেন। তাদের সহযোগিতায় এই শিশুদের মুখে হাসি ফুটছে। তাদের কাছে স্কুল কর্তৃপক্ষ কৃতজ্ঞ। ইচ্ছে আছে শীঘ্রই কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কোর্স শুরু করার। এই শিশুদের মধ্যে অনেক মেধাবিকে পাওয়া যাচ্ছে। শিশুদের সার্বক্ষণিক সেবা ও নজরদারিতে রাখার জন্য আবাসিক কার্যক্রম শুরুর ইচ্ছাও আছে। এ জন্য স্কুলের দ্বিতল ভবনকে আরও বাড়ানো দরকার। -সমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×