ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ক্রান্তিকালের রূপকার

প্রকাশিত: ০৬:৪৪, ৬ মার্চ ২০২০

ক্রান্তিকালের  রূপকার

প্রদোষ শব্দের অর্থ সন্ধ্যার পূর্বাবস্থা, সূযাস্তের কাল, সাঁঝের বেলা বা গোধূলির আলো। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসার ঠিক আগের অস্পষ্ট আলো। উপন্যাসটিতে বাঙালীর প্রদোষকালীন সময় হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে দ্বাদশ শতকের শেষ পাদে রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠিত সেনবংশের সর্বশেষ রাজা লক্ষ্মণসেনের রাজত্বকালের অন্তিম মুহূর্তটিকে। প্রাকৃতজন বলতে মূলত নিচ, অধম, ইতর শ্রেণীর বা নিম্নশ্রেণীর অসহায়, সম্বলহীন, বিত্তহীন মানুষকে বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ ঘনায়মান অন্ধকারের প্রারম্ভে যে হীন, অসহায় শ্রেণীর মানুষদের জীবনে আরও কঠিন থেকে কঠিন ও দুর্বিষহ পরিস্থিতির সম্মুখে এগিয়ে যাচ্ছে, তারই করুণ কাহিনী উপন্যাসে ধারাবাহিক চিত্রিত হয়েছে। বলাবাহুল্য, এ সময়ে বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক, নৈতিক যে স্খলিত অবস্থা বিরাজমান ছিল, তারই একটি শৈল্পিক চিত্র-দলিল বলা যায় এই উপন্যাসটিকে। ঐতিহাসিক উপন্যাস সবসময় ইতিহাসকে আক্ষরিকভাবে ধারণ করে -এ কথা বলা যায় না, এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কথা প্রণিধানযোগ্য, তিনি বলেন, কারও যদি সত্য জানার প্রয়োজন হয়, তবে তিনি যেন সরাসরি ইতিহাস পড়েন আর আনন্দের জন্য পড়েন ঐতিহাসিক উপন্যাস। তবে, প্রদোষে প্রাকৃতজন উপন্যাসে কল্পনার আশ্রয় নেয়া হলেও নামকরণ, বিষয়চরিত্র, সমকালের চিত্র ঐতিহাসিকভাবেও স্বীকৃত বলা যায়। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এই উপন্যাসের চরিত্রগুলো নিয়ে যথার্থই বলেছেন, ‘ইতিহাসে তাদের নাম নেই। হয়ত অন্য নামে তারা বাস করেছে সেই কালে, হয়ত অন্য কালেও।’ এই সময়কালে বাংলার সমাজ-সংস্কৃতির অবস্থার অধঃপতনের পেছনে তৎকালীন মানুষের সমাজ, জাত-বর্ণ এবং অর্থনৈতিক শ্রেণী উভয় দিক হতে স্তরে স্তরে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্তি এবং পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে শত্রুভাবাপন্ন মনোভাব অনেকাংশে দায়ী বলা যায়। দ্বিতীয়ত, তৎকালীন জনজীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রে, ধর্মে, শিল্প-সাহিত্যে দৈনন্দিন জীবনে যৌন অনাচার নির্লজ্জ কামপরায়ণতা, মেরুদন্ডহীন ব্যক্তিত্ব, বিশ্বাসঘাতকতা এবং রুচির অভাব। ধর্মের নামে অধর্ম, সামাজিকতার বদলে অসামাজিকতা, সংস্কৃতির স্থানে অপসংস্কৃতি আচ্ছন্ন করে রেখেছিল এই সময়ের বাংলাকে। প্রদোষ বলতে মুসলিম বিজয়পূর্ব বাংলার সমাজ চিত্রের বর্ণনায় ঔপন্যাসিক শওকত আলী যে ইতিহাস অঙ্কন করেছেন তাতে আর যাই হোক ইতিহাস সমান্তরালেই কাহিনী এগিয়েছে। সমকালীন মানুষ, মানুষের পেশা, জনপদ, গ্রাম-শহর, নদ-নদী, প্রকৃতি এবং চরিত্রের সংলাপ সমস্তের বর্ণনায় যে আবহ সৃষ্টির প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় তাতে মনে হয়, শওকত আলী কল্পনায় হাজার বছর পূর্বের বাংলায় নিয়ে যেতে চেয়েছেন পাঠককে। প্রাচীন বাংলার জনপদগুলোর প্রশাসনিক কেন্দ্রবিন্দু যদিও শহর তথাপি গ্রামীণ জনপদের গুরুত্বও কম ছিল না। প্রাচীন বাংলার প্রাপ্ত নগরের কেন্দ্রবিন্দু ব্যতিরেকে যে পরিসীমার ব্যপ্তি, সাধারণত সমকালীন নাগরিক সুযোগ-সুবিধা যেখানে অনুপস্থিত এ ধরনের অঞ্চলগুলো গ্রাম হিসেবে চিহ্নিত ছিল। প্রাচীন বাংলার গ্রামীণ জীবন একান্তই কৃষিভিত্তিক, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্পনির্ভর, এগুলোর সংখ্যা খুব বেশি ছিল বলা যায় না, আয়তনেও ছিল ছোট ছোট। কৃষিজীবী ক্ষেত্রকর গ্রামীণ মানুষের চাহিদাও ছিল একান্তই কম। উৎপাদনের উপযোগী সুপ্রচুর ভূমি থাকলেও তাদের প্রয়োজন হতো সামান্যই। প্রাচীন বাংলার গ্রাম ও নগর সভ্যতায় আকৃতিগত পার্থক্য যেমন ছিল, ছিল প্রকৃতিগত পার্থক্য, সে সময়ে যারা গ্রামে বাস করত, তারা সাধারণত কৃষিনির্ভর ভূম্যধিকারী, কৃষক, শ্রমিক, ভূমিহীন কৃষি শ্রমিকের সংখ্যাই প্রধান। গ্রামে উৎপাদিত ফল-ফসল চলে যেত শহরের হাটে বাজারে। ফলে সামগ্রিক কারণেই শহরের অধিবাসীরা গ্রামের অধিবাসীদের চেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা ও সুখ ভোগ করতে পারত। প্রাচীন বাংলার অসংখ্য গ্রামের নাম ইতিহাসে দেখা যায়। এ সমস্ত গ্রামের আয়তন যেমন ছোট বড় ছিল, অধিবাসীদের সংখ্যাও ছিল বেশি-কম। ছোট ছোট গ্রামকে বলা হতো বাটক বা পাটক, এর বাংলা অর্থ করলে হয় পাড়া। প্রাচীন লিপিমালায় বৈগ্রামপাট্টলিতে বায়িগ্রামের দুটি ভাগ ছিল যার একটির নাম ছিল ত্রিবৃতা ও অন্যটি ছিল শ্রীগোহলি। এছাড়া ত্রিবৃত বাটক, কপিস্থ বাটক, মধু বাটক ছাড়াও অসংখ্য গ্রাম বা পাড়া খুঁজে পাওয়া যায়। প্রাচীন বাংলার গ্রামীণ সমাজ কৃষিপ্রধান হলেও শিল্পীদের বাসও ছিল এখানে। বাঁশ ও বেতের শিল্প, কাষ্ঠ শিল্প, মৃৎ শিল্প, কার্পাস ও অন্যান্য বস্ত্রশিল্প ইত্যাদিও ছিল গ্রামে। কৃষিকাজের জন্য প্রয়োজনীয় বাঁশ ও বেতের নানা প্রকার পাত্র, ঘর বাড়ি, নৌকা, মাটিনির্মিত হাঁড়ি পাতিল, লোহার দা-কুড়াল, কোদাল, লাঙ্গল, লাঙ্গলের ফলা, খন্তা ইত্যাদি। নিত্য ব্যবহার্য কৃষি যন্ত্রাদি কৃষির প্রয়োজনেই তৈরি হতো গ্রামে। সুতা কাটা দরিদ্র ব্রাহ্মণ গৃহস্থ বাড়ির মেয়েদের একটি অন্যতম কর্ম ছিল। জানা যায়, কাঁসারি শিল্প ও হাতির দাঁতের শিল্পগ্রামে বেশ চালু ছিল। গ্রামে বসবাসকারী প্রধান প্রধান পেশাজীবী ও শ্রেণীর মধ্যে ছিল ব্রাহ্মণ, ভূমির মালিকগণ, ক্ষেত্রকর, ভূমিহীন কৃষিশ্রমিক, কর্মকার, কুম্ভকার, মালাকার, সূত্রধর প্রভৃতি শিল্পীরা। এ ছাড়া কিছু কিছু ব্যবসায়ী এবং গোপ, নাপিত, রজক, নর্তক-নর্তকী এবং নিম্নশ্রেণীর অগণিত মানুষ। প্রাচীন বাংলার নগরকেন্দ্রিক শাসনকার্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য শহর গড়ে উঠেছিল কেন্দ্রীয় সুযোগ-সুবিধা সংবলিত বাংলায়ও। সংশ্লিষ্ট নগরের রাজকর্মচারীরা বাস করত শহরে। রাজকার্যের প্রয়োজনে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ আসা-যাওয়া করত সেখানে। এসব বসতি ও যাতায়াতের পথকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল হাটবাজার। যাতায়াত, গমন-নির্গমন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়ার জন্যশহর-নগর ও নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। শহর-নগরকে কেন্দ্র করে হাটবাজার গড়ে উঠেছিল সাধারণত নদীর তীরে অথবা যাতায়াতের সুপ্রশস্ত রাজপথের পার্শ্বে, কিংবা উভয় সুবিধা সংবলিত স্থানে। রাজা-মহারাজাদের রাজধানী এবং যুদ্ধজয়ের স্মারক জয়স্কন্দাবার এ সমস্ত স্থানে স্থাপিত হয়েছিল, এগুলো গড়ে উঠত নদী অথবা রাজপথকে উপলক্ষ করেই। শওকত আলীর প্রদোষে প্রাকৃতজন উপন্যাসটি যে সময়কে পরিক্রমণ করেছে তা যেমন ভৌগো-প্রাকৃতিকদিক বিবেচনায় জটিলতায় আকীর্ণ, তেমনি আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকেও অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ের মানুষ যে পেশায় সাধারণত জীবিকা নির্বাহ করত, যে চিন্তা চেতনায় ব্যাপৃত থাকত এ উপন্যাসের চরিত্রগুলোর পেশাও একই, তাদের চিন্তা-চেতনা, ভাবনা সে সময়কে ধারণ করেছে পুরো মাত্রায়। মমত্ববোধ, সংবেদনশীলতা, আতিথেয়তা, অতিমাত্রায় সচেতনতা চরিত্রগুলোকে কদাচিৎ সময়োত্তীর্ণ করেছে বলে মনে হয়। তবে ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসেবে যে কালের সমাজ, সংস্কৃতি, ঘটনাপ্রবাহ বিধৃত হয়েছে তাতে উপন্যাসটিকে সার্থক ঐতিহাসিক উপন্যাস বলা যেতে পারে। দ্বাদশ শতকের শেষপাদে সেনশাসনে অতিষ্ঠ বাংলার জনপদের আর্থ-রাজনীতি, সমাজ-সংস্কৃতি ও ধর্ম হয়ে পড়েছিল পঙ্গু। বেঁচে থাকাই সে সময়ের মানুষের বড় তাৎপর্যময় ছিল, সে সময়ে ছোট খাটো কিছু প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে উঠলেও সংঘবদ্ধ কোন গণআন্দোলন গড়ে উঠেনি। মানসিক দুর্বলতা ও আর্থ-রাজনৈতিক শোষণ-বঞ্চনা-উৎপীড়ন-নির্যাতনে বিপর্যস্ত হয়ে তারা কেবলই এগিয়ে চলেছে লক্ষ্যহীন পথে। ইতিহাসের সেই প্রদোষকালের জটিল আবর্তে ঘূর্ণায়মান প্রাকৃত নরনারীর জীবনবাস্তবতাই এই উপন্যাসের মূল কাহিনী। এই উপন্যাসে উঠে এসেছে তৎকালীন সমাজ-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক জটিলতার নানা চিত্র, বিধৃত হয়েছে সেই দুষ্কালের মধ্যে পতিত প্রাকৃত জনসাধারণের অত্যাচারিত, শোষিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত, স্বপ্নাহত, আশাহত, পলায়নপর, উদ্বাস্তু জীবনের কাহিনী। প্রদোষে প্রাকৃতজন উপন্যাসটির কাহিনী মোট ছাব্বিশটি পরিচ্ছেদে বিন্যস্ত। অংশ দুটি, প্রধম অংশ প্রদোষে প্রাকৃতজন নামে। এর বিস্তৃতি প্রথম থেকে দশম পরিচ্ছেদ এবং দ্বিতীয় অংশ দুষ্কালের দিবানিশি একাদশ থেকে ছাব্বিশ পরিচ্ছেদ পর্যন্ত বিস্তৃত। ইতিহাসের সঙ্গে সাহিত্যের নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে। রাজনৈতিক শুধু নয়, সামাজিক কিংবা সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সঙ্গেও এই সম্পৃক্ততা লক্ষণীয়। বঙ্কিমচন্দ্র দুর্গেশনন্দিনী দিয়ে বাংলা ঐতিহাসিক উপন্যাসের যাত্রা শুরু করেছিলেন, বলা যায় বাংলা ভাষায় ছিল প্রথম। পরবর্তীকালে তাঁর পথ ধরে মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১১ খ্রিস্টাব্দ), রমেশচন্দ্র দত্ত (১৮৪৮-১৯০৯ খ্রিস্টাব্দ), হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫৩-১৯৩১), ইসমাইল হোসেন সিরাজী (১৮৮০-১৯৩১ খ্রিস্টাব্দ), রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৮৬-১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ) প্রমুখ ঔপন্যাসিকের আগমন। ঐতিহাসিক উপন্যাসে সংযোজিত হয়েছে আরো অনেক বৈচিত্র্য, নতুন নতুন ইতিহাসের বাঁকের প্রেক্ষাপটে রচিত হয়েছে নতুন উপন্যাস। শুধু বাংলা ভাষাকে নয়, এগুলোসমৃদ্ধ করেছে কাহিনীর পারস্পর্য উপস্থাপনাকেও। রঙে, ঢঙে, ব্যাপ্তিতে, সমাজবাস্তবতায় সৃষ্টি করেছে আকর্ষণ ও বৈচিত্র্য। ইতিহাসের বিষয়কে উপজীব্য করে সাহিত্য রচনা করতে গিয়ে অনেক ঔপন্যাসিক প্রাচীন বাংলা ও ইতিহাসের নানা অনুষঙ্গকে বিষয় হিসেবে ধারণ করেছেন উপন্যাসে, উপন্যাসে প্রাচীন বাংলার সমাজ-সংস্কৃতি, রাষ্ট্র-অর্থনীতি, খাদ্য-পোশাক-পরিচ্ছদ, তথা সমকালের নানারূপ চিত্র। প্রাচীন বাংলার সামাজিক ইতিহাসের উপাদানগুলো ব্যবহার করে ঔপন্যাসিকগণ বাংলা ও বাঙালীকে মূলত অনুসন্ধান করেছেন ইতিহাসের অন্তরালে। শওকত আলীর প্রদোষে প্রাকৃতজন উপন্যাসের শুরুটা খুবই মনোরম, মনে হয় শান্তি শান্তি ভাব নিয়ে সূচনা করতে চেয়েছেন। ‘চৈত্রের দাবদাহে অশ্বত্থছায়া বড়ই শ্রান্তিহারক। নতুবা এতো শীঘ্র ক্লান্তি অপনোদন সম্ভব ছিল না। ....শ্যামাঙ্গ অশ্বত্থের ছায়ায় শয়ান অবস্থায় নিমিলিত চোখে নিজ অভিজ্ঞতা স্মরণ করে। ...প্রৌঢ় লোকটি ওই সময় কাছে এসে জানতে চাইলেন, এখন সুস্থ বোধ করছেন তো?’ এই কয়েকটি লাইনের মধ্যে শওকত আলী গোটা গল্পের প্রেক্ষাপট তৈরি করে ফেলেছেন, বাকি গল্প পরের পুরো একশ সাতানব্বই পৃষ্ঠাজুড়ে রয়েছে। শ্যামাঙ্গ প্রদোষকালীন বাংলার প্রতিনিধিত্বকারী একজন মৃৎশিল্পী, যে স্বাধীনভাবে মনের মাধুরি মিশিয়ে কল্পনার মূর্তি উৎকীর্ণ করতে চায়, কিন্তু সমাজের গণ্যমান্য ও পুঁজিপতি ব্যক্তি তথা সুধীমিত্রের অপছন্দ হওয়ায় তাঁর প্রভু বসুদেব তাকে তিরস্কৃত ও লাঞ্ছিত করে। প্রদোষ বলতে বাংলার সেন বংশীয় শাসনের শেষের দিকের স্খলনের যুগকে বোঝাতেই ব্যবহৃত হয়েছে, অর্থাৎ মুসলমানদের আগমনের ঠিক পূর্বে বাংলার আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার চিত্র উপন্যাসে এঁকে উপস্থাপনের চেষ্টা হয়েছে। শ্যামাঙ্গ বিল্বগ্রাম থেকে উত্তর বাংলার নওগাঁর আত্রাই নদীর মোহনায় রজতপটে তার বাসস্থলে যেতে চায়, কিন্তু হঠাৎ অসুস্থ বোধ করলে থমকে যেতে হয়। পরিচয় হয় মায়াবতী ও স্বামী পরিত্যক্ত নারী লীলাবতীর সঙ্গে। রাতে শ্যামাঙ্গ মায়াবতীর বাসস্থল উজুবট গ্রামে আশ্রয় নেয়। মায়াবতীর অনুরোধে তার বাড়িতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। মায়াবতীর পিতা সুকদেব অন্যদের সঙ্গে গল্প করে বৌদ্ধদের অবস্থা এবং মাঝে মাঝে যবন তথা মুসলমানদের সম্পর্কেও কিছু কিছু তথ্য পায়। হিন্দুদের হাতে বৌদ্ধদের নিগ্রহের ঘটনা এখানে প্রায়শই ঘটে, শ্যামাঙ্গের জানা ছিল। কথায় কথায় যবন তথা মুসলমানদের প্রার্থনার নিয়ম-কানুন এবং তাদের খবরাখবরও জানতে পারে শ্যামাঙ্গ। ইতোমধ্যে তারা মগধ দেশের পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলের প্রায় রাজ্যই জয় করে শক্তিশালী হয়েছে, শ্যামাঙ্গের কাছে নতুন তথ্য। অধিক রাতে মায়াবতী শ্যামাঙ্গকে ভ্রাতা সম্বোধন করে লীলাবতীর স্বামী অভিমন্যু দাসের খোঁজ নেয়ার অনুরোধ করে। এভাবেই ধীরে ধীরে নানা ঘটনা, দুর্ঘটনা ও পরিস্থিতিতে এক সময় শ্যামাঙ্গ লীলাবতী জড়িয়ে পড়ে প্রণয়সম্পর্কের বন্ধনে। লীলাবতীর স্বামী লীলাবতীকে ত্যাগ করলেও স্বামী হিসেবে দাবি তখনও একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে হয়নি। অন্তত স্ত্রী যখন অন্য পুরুষের সঙ্গে সংলগ্ন তখন লীলাবতীর স্বামীর আত্মমর্যাদাবোধ ভীষণ টনটনে হয়ে ওঠে। স্বামী হিসেবে দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের অনুভূতি না থাকলেও স্ত্রীকে লাঞ্ছনা ও বঞ্চনার নতুন নতুন উপায় উদ্ভাবন নিত্য স্বেচ্ছাভ্যাস হয়ে দাঁড়ায়।এদিকে সমকালীন সমাজও লীলাবতী ও শ্যামাঙ্গের এই সম্পর্কের স্বীকৃতি দেয় না। অথচ লোলুপ মানুষের লালসার উপযুক্ত কঠোর শাস্তির দায়িত্ব সমাজ গ্রহণ বা বহন করতে অসমর্থ, বলা যায় অসহায়তার ছদ্মাবরণে নীরব হয়ে থাকে। শ্যামাঙ্গ লীলাবতীর পাশে দাঁড়াতে চাইলেও সামাজিক কঠোর দুর্লঙ্ঘনীয় দুর্বিপাক তাদেরকে প্রতিনিয়ত তাড়িত করে, অথচ ধান্দাবাজরা নারীলোভে উচ্চনীচ যাচাই করার কসরত করত না। নিম্নশ্রেণী এড়িয়ে চলাই হিন্দু উচ্চশ্রেণীর একটি সংস্কার। সামাজিক সম্পর্ক তো দূরের কথা নিম্নশ্রেণীর হিন্দুদের ছায়া পর্যন্ত না মাড়ানো হিন্দু ব্রাহ্মণ্যগোষ্ঠীর প্রকৃত চেহারা হলেও গোপনে সে চরিত্র কোথায় উবে যেত লালসায় কিংবা নিষ্ঠুর উদ্ধত আস্ফালনে। উচ্চশ্রেণীর অভিজাত হিন্দুরা নিম্নশ্রেণীর ডোম্বীনীর সঙ্গে বিবাহ বহির্ভূত রতিক্রিয়ায় মিলিত হতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করত না। শওকত আলী সে সময়ের সামাজিক ইতিহাসকেই অবিকল চিত্রিত করেছেন দক্ষ চিত্রকর হয়ে নিপুণ তুলির আঁচড়ে। চর্যাপদে এ সময়ের চিত্র ফুটে ওঠে। ‘নগর বাহিরিরে ডোম্বী তোহোরি কুড়িআ, ছোই ছোই যাই সো বামহন নাড়িআ।’ অর্থাৎ ডোম্বীনীর সঙ্গে মিলিত হবার আশায় ব্রাহ্মণরা তাদের ঘরের আশপাশে সময়ে অসময়ে ঘুরে বেড়াত কামতাড়িত হয়ে। (দ্র: অতীন্দ্র মজুমদার, চর্যাপদ, কলকাতা : নয়াপ্রকাশ, ৬ষ্ঠ মুদ্রণ, ১৯৯৫), পৃ: ৩৫। ধোয়ী তাঁর পবনদূত কাব্যেও কামচরিতার্থতার অবাধ লীলা অত্যন্ত সাড়ম্বরপূর্ণভাবে বিচ্ছুরিত করেছেন। লীলাবতীকে নিয়ে চিন্তিত তার মাতুল যোগী সিদ্ধপাও লীলাবতীর বাবা হরকান্তকে একই কথা শোনায়, বলে, ‘যুবতী মেয়েরা ক্রমেই অরক্ষণীয়া হয়ে পড়ছে- তোমার সৌভাগ্য যে, রাজপুরুষদের দৃষ্টি তোমার কন্যাটির উপর পড়েনি।’ লীলাবতীর ভাগ্যেও একই ধরনের পরিণাম কোমল হৃদয় শিল্পী শ্যামাঙ্গকে ভাবিয়ে তুলেছিল ভীষণভাবে। তারা একসঙ্গে জীবনের স্বপ্ন দেখতে চেয়েছিল, কিন্তু তারা চাইলেই হবে না। কুলীন কঠোর সমকালের হিন্দু সমাজ মানবীয় হয়ে ওঠেনি। কৌলিন্য রীতির প্রবর্তক কঠোর কুলীন প্রথার প্রতিষ্ঠাতা বল্লাল সেনের এই সমাজ ডোমনীকে ভোগ করে, প্রাপ্য পারিশ্রমিক না দিয়ে এক সময় তাকে অনায়াসে খুন করতে দ্বিধা করে না। কারণ উচ্চ শ্রেণীর তকমা তাদের শরীরে সাঁটানো, তারা রাজপুরুষ। নারীকে গণিকা, সেবাদাসী করার শত সহস্র পথ খোলা, সম্মান জানানোর রাস্তা একটিও অর্গলমুক্ত নয়। এই বাংলায় গৃহস্থের তখন ঘোর দুর্দিন। পথে পথে দস্যু-তস্করের আনাগোনা, সবখানে লুণ্ঠন আর অরাজকতা। আর এ ধরনের প্রেক্ষাপটে বখতিয়ার খলজির মত একজন কাক্সিক্ষত বীরপুরুষের আগমনের প্রেক্ষাপট রচিত হয়ে যায়। লীলাবতীর ছেড়ে যাওয়া স্বামী অভিমন্যু দাস রাজ অমাত্য হবার সুবাদে সৈন্যদের মাধ্যমে লীলাবতী ও শ্যামাঙ্গকে তাড়া করে ফেরে। লীলাবতীকে রক্ষা করতে প্রেমিক শ্যামাঙ্গ ছুটে বেড়াচ্ছে নানা জায়গায়, অলি-গলি, অন্দরে। কখনও ঘরে না তুললেও নিজস্ত্রীর অন্য পুরুষের সঙ্গে জীবন-যাপন অভিমন্যু দাস মানবে না। শ্যামাঙ্গ ও লীলাবতীকে খুঁজছে রাজার সৈন্যরা। এ পলায়নপর পরিস্থিতিতে তাদের মাঝে মানসিক সম্পর্ক দৃঢ় হয়, এক সময় শারীরিক সম্পর্কে গড়ায়, লীলাবতী তখন অন্তঃসত্ত্বা। এ অবস্থায় আগমন ঘটে তুর্কি বীর বখতিয়ার খলজির। সার্বিক স্খলনের সে বৈরি যুগে বসন্ত দাস কিংবা মিত্রানন্দের মতো লোকদের ভূমিকা থাকে, যদিও তাদের করার থাকে না কিছুই। মিত্রানন্দ বর্তমান অবস্থার অবসান চায়, কারণ এছাড়া জীবনের বিকাশ সম্ভব নয়। সে চায়, মানুষ স্বপরিচয়ে উঠে দাঁড়াক, নতজানু দাসত্বের বেড়াজাল ছিন্ন করে বেরিয়ে আসুক। কিন্তু কিভাবে? জানা নেই, তার কথায়, ‘বর্তমান অবস্থার অবসান হওয়া উচিত- না হলে জীবনের বিকাশ অসম্ভব। আমরা মানুষকে স্বপরিচয়ে উত্থিত হতে বলছি, নতজানু দাসত্বের জড়তা থেকে মুক্ত হতে বলছি- আমি এ পর্যন্ত জানি- এর অধিক আমার জানা নেই।’ অন্তঃসত্ত্বা লীলাবতী আরব হতে আগত এক সুফির আশ্রয়ে থেকে চিকিৎসা গ্রহণ করে। নৈরাজ্য ও অরাজকতার অনিবার্য করুণ পরিণতির হাত থেকে সম্ভ্রম ও জীবন রক্ষার উদ্দেশ্যে লীলাবতীকে সেখানেই রাখে শ্যামাঙ্গ, যখন ফিরে আসে লীলাবতী তখন নিজের প্রাণ, শ্যামাঙ্গ ও অনাগত সন্তানের জীবন বাঁচাতে মরিয়া। বলে, ‘শ্যামাঙ্গ! চলো, আমরা যবনধর্ম গ্রহণ করি।’ লীলাবতী আরো বলে, ‘আমি ওদের মন্ত্রটা শিখেছি। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদার রসুলুল্লাহ।’ লীলাবতী আসলে নতুন ধর্ম গ্রহণ করে জীবনের এক নতুন আস্বাদ পেতে চায়, চায় নিরাপত্তার জীবন। শ্যামাঙ্গ সেখানে অসহায়তা আর অবিশ্বাসের যাতনায় পরিশ্রান্তক্লিষ্ট। লীলাবতীকে সে বুঝাতে চায়, পিতৃ পুরুষের ধর্মে যতই অনাচার থাক, অন্যায় থাক আর ভুল থাকুক সে ধর্মই যে মৃত্তিকার ধর্ম। বলে, ‘এই ধর্ম আমাদের মৃত্তিকার ধর্ম লীলাবতী। এই ধর্ম পরিত্যাগ করলে আমরা আমাদের শেকড় থেকে বিচ্যুত হব।’ শ্যামাঙ্গের কথায় লীলাবতী যুক্তি খুঁজে পায় না। তার বার বার মনে হয়, যে ধর্ম তাদের মানুষের মতো করে বাঁচতে দেয় না, অনবরত চরকার ঘুঁটির মতো ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ায়, চরম হতাশার মাঝে থাকতে হয় সর্বক্ষণ, যেখানে জীবনের কোন সম্মান নেই, মূল্য নেই, নিরাপত্তা নেই, নেই ভালবাসার আশ্রয়, কি করে মৃত্তিকার ধর্ম হতে পারে? তাই সে শ্যামাঙ্গের উত্তরে জানায়, সে এত কথা বুঝবে না। তাকে বাঁচতে হবে। সে ঘর-সংসার-সন্তান চায়। বলে, ‘আমি তো বুঝি না। সত্য সত্যই আমার ধর্ম বলে কোন বস্তু ছিল কি না। যদি ছিল ধরে নিই, তাহলে সে ধর্ম আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। এমন বিবাহ দিয়েছে, যা আমি চাইনি- যে ধর্ম আমার জীবনকে বিপন্ন করেছে, যে ধর্ম আমাকে পিতৃহীন করেছে- বলো, তাকে আমি ধর্ম বলবো?’ শ্যামাঙ্গকে মেনে নিতে হয় লীলাবতীর যুক্তি। শেষপর্যন্ত শ্যামাঙ্গ বাঁচতে পারে না। লীলাবতীর স্বামী অভিমন্যু দাস শ্যামাঙ্গকে বাঁচতে দেয় না। যুগের বাস্তবতায় কেউ সুযোগসন্ধানে যবনধর্ম গ্রহণ করেছে, অভিমন্যু দাসও সে দলের লোক। তুর্কিদের তথা যবনদের ধর্ম গ্রহণ করে বেশ শক্তি অর্জন করে শেষ পর্যন্ত শ্যামাঙ্গকে হত্যা করে। শওকত আলী বলেন, শ্যামাঙ্গকে বাঁচিয়ে রাখার কোন উপায় ছিল না। আসলে শিল্পী আর পরোপকারী শ্যামাঙ্গদের এভাবেই মরতে হয়, জীবনের চেয়ে তাদের মৃত্যুদৃশ্যেই সকলে আনন্দ পায়, পায় স্বস্তি, শওকত আলীও সেখানেই কাহিনীর শেষ দৃশ্য এঁকেছেন। শওকত আলীর প্রদোষে প্রাকৃতজন যে সময়ের গল্প নিয়ে রচিত, সে সময়ের কাহিনী নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র রচনা করেছেন ‘মৃণালিনী’ উপন্যাস আর শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায় রচনা করেছেন উপন্যাস ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘ’, ‘গৌড়মল্লার’ কিংবা ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’। তবে ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘ’ উপন্যাসটির বিস্তৃতিপ্রদোষে প্রাকৃতজনের অনেকটা কাছাকাছি সময়ের ইতিহাসকে অবলম্বন করে। পাল বংশের শাসক নয়পালের আমলের কিছু ঘটনাকে উপজীব্য করে এই উপন্যাস রচিত। ‘বখতিয়ারের তলোয়ার’ নামে শফীউদ্দীন সরদারও একটি অনন্যসুন্দর ঘটনাসমৃদ্ধ উপন্যাস রচনা করেছেন একই ঘটনার বাতাবরণে। প্রত্যেকটি উপন্যাসই আপন আপন বৈশিষ্ট্যে অনন্য। শফীউদ্দীন সরদার বখতিয়ারের তলোয়ারে সমকালীন সরল রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ ও কল্পনার রোমান্টিকতার সংমিশ্রণে প্রোজ্জ্বল উপস্থাপনায় পাঠককে সে সময়ের রাজনৈতিক অবস্থার সার্বিক চিত্র রসসমৃদ্ধ উপস্থাপনায় মগ্ন করেছেন দক্ষতার সঙ্গে। সেখানে সমকালীন আর্থ-রাজনৈতিক অবস্থার কিছু চিত্র থাকলেও সামাজিক অবস্থার বর্ণনা অনেকাংশেই অনুপস্থিত রয়েছে, রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারাক্রম রক্ষিত হলেও, কল্পনার প্রাচুর্যে পাঠক রসসিক্ত; প্রকৃত ইতিহাসের আস্বাদ গ্রহণ ও পূর্ণমাত্রায় উপভোগ থেকে হয়েছে বঞ্চিত। তবুও সরাসরি বখতিয়ার খলজিকে উপন্যাসের নায়ক করে সরল ধারায় রচিত উপন্যাসটি পাঠককে ভাবাতে ও রসাস্বাদনে যথেষ্ট মেধার পরিচয় দিয়েছেন কথানির্মাতা। শরদিন্দুর ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘ’ উপন্যাসে পাল রাজত্বের শেষে বাংলার ইতিহাসে যে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল তারই পূর্ববর্তী বাংলার আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট উপন্যাসের পটভূমি হিসেবে স্থান পেয়েছে। এ সময়েও ভেতরে ভেতরে সামাজিক অবক্ষয় তৈরি হচ্ছিল। আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে সমগ্র রাজ্য ভেতর থেকে ভেঙে পড়ছিল। সমগ্র ভারতবর্ষব্যাপী ঘনিয়ে আসা মহারাত্রির অন্ধকারে নিমজ্জমান বাংলার ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন দীপঙ্কর। এইভাবে বহু ঐতিহাসিক ও অনৈতিহাসিক চরিত্রের সমাবেশের এই উপন্যাসটিও পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে যথেষ্টই, ইতিহাস হয়েছে গল্পময়। ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসেবে যতটা, তার চেয়ে সমকালীন সমাজচিন্তা ও জটিল অবস্থার প্রেক্ষিতে সংস্কারচিন্তার আবহ নির্মিত হয়েছে উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে। সমকালের ঘটনা পরিপ্রেক্ষিত ও চরিত্র চিত্রণে শরদিন্দু যথেষ্টই স্বকীয়তার পরিচয় দিয়েছেন। এ উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে তাঁর অসাধারণ কল্পনা ও উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। বঙ্কিমচন্দ্রকে বলা যায়, বাংলা ভাষায় ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনার নায়ক। তিনি ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে পারিবারিক রোমান্সের দুটি এবং সরাসরি ঐতিহাসিক তিনটি উপন্যাস রচনা করেছেন। এগুলো হলো যথাক্রমে, ‘কপালকু-লা’ ও ‘চন্দ্রশেখর’,এবং ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘মৃণালিনী’ ও ‘রাজসিংহ’। প্রদোষে প্রাকৃতজন যে সময়কে ঘিরে রচিত বঙ্কিমের মৃণালিনীও সে সময়ের কাহিনী অবলম্বন করেই আবর্তিত। যদিও শেষপর্যন্ত বঙ্কিমচন্দ্র মৃণালিনীকে ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চাননি কিন্তু বখতিয়ারকে উপন্যাসে তিনি একটি চরিত্ররূপে এনেছেন। এই উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র পশুপতিকে ভিলেনের ভূমিকায় রেখে যবন তথা মুসলমানদের সঙ্গে গোপন চুক্তির ফলস্বরূপ অত্যল্পসংখ্যক সৈন্যের মাধ্যমে বাংলা বিজয়ের ষড়যন্ত্রের আবিষ্কর্তা হিসেবে সয়ম্ভুত হয়েছেন। তিনি বখতিয়ার খলজিকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বাংলা দখলকারী ও নিপীড়ক হিসেবে তুলে ধরে ইতিহাসের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন। অথচ বাংলার দুর্দিনে বাঁচবার জন্য সে সময়ের সাধারণ মানুষ যে আকুতি করেছে সে ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গিয়ে ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় বলেছেন, ‘একটা বৃহৎ গভীর ব্যাপক সামাজিক বিপ্লবের ভূমি পড়িয়াই ছিল, কিন্তু কেহ তাহার সুযোগ গ্রহণ করে নাই। মুসলমানেরা না আসিলে কীভাবে কী উপায়ে কী হইত বলিবার উপায় নাই।’ (বাঙালীর ইতিহাস, আদি পর্ব, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ, দ্বিতীয় সংস্করণ, বাংলা ১৪০২, পৃ: ৭২১-৭২২)। নীহাররঞ্জন রায় আরও বলেন, ‘বখতিয়ারের নবদ্বীপ বিজয় এবং একশ’ বছরের মধ্যে সারা বাংলাদেশ জুড়ে মুসলমান রাজশক্তির প্রতিষ্ঠা মোটেই আকস্মিক ঘটনা নয়, সেন আমলে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধোগতিরই পরিণাম।’ বখতিয়ারের চরিত্র বিশ্লেষণে তাঁকে নিপীড়ক, নির্যাতনকারী কিংবা অপহারক বলা একান্ত সাম্প্রদায়িক চিন্তা থেকেই উৎসারিত তা নীহাররঞ্জন রায়ের উক্ত উক্তিগুলোতেই প্রমাণিত। আর এটিও ভাবা সমীচীন নয় যে, মাত্র সতেরো জন মুসলিম যোদ্ধা ভীত-সন্ত্রস্থ রাজপুত যোদ্ধাদের তলোয়ারের জোরে কুপোকাত করে বাংলা বিজয় করেছে। এক্ষেত্রে অদিতি ফাল্গুনীর বিশ্লেষণ ও উপস্থাপনা যৌক্তিক। তিনি বলেছেন, ‘বঙ্কিমচন্দ্র যতই বলতে চান না কেন যে সতেরো জন অশ্বারোহী নিয়ে বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয়ের গল্প যে বাঙালী বিশ্বাস করে সে কাপুরুষ, শুধু বর্বর তরবারির জোরে ইসলাম বাংলা বিজয় করেছে এই বাক্যেও প্রতীতী রাখা কঠিন। বর্ণাশ্রমের কঠোরতা, সমাজে নারীর শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থানের জায়গায় জাত-পাতহীন, নারীর জন্য বিবাহ বিচ্ছেদ ও পুনর্বিবাহের অধিকার দাতা ইসলাম সেই সময়ের প্রেক্ষিতে নির্ঘাৎ একটি ‘মুক্তিদাতা’ ধর্ম হিসেবেই দেখা দিয়েছিল। এ কথা মানতে বাংলার হিন্দু যতই কুণ্ঠা বোধ করুক, বুক তার পুড়ে গেলেও তথ্যটা মিথ্যা হয় না বা হবে না। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, সিন্ধুতে ইরাকী সেনাপতি বিন কাশিমের অভিযানের সময় রাজা দাহিরের হাতে দলিত জাঠরা শঙ্খধ্বনি দিয়ে বিদেশী সেনাপতিকে অভিবাদন করেছিলেন।’ (অদিতি ফাল্গুনী, প্রদোষে প্রাকৃতজন : মহাকালের প্রশ্ন, ওয়েবসাইট)। রিজিয়া রহমানের ‘বং থেকে বাংলা’ একটি জীবন্ত দিকনির্দেশক ঐতিহাসিক উপন্যাস বলা যায়। এই বৃহৎপরিসর উপন্যাসের পঞ্চম ও ষষ্ঠ অধ্যায়ে প্রদোষে প্রাকৃতজন উপন্যাসের সময়কালকে ব্যাপ্ত করে আছে। আগে এবং পরে সম্পূর্ণ বাংলার ইতিহাসকেই ধারণ করার চেষ্টা করেছেন ঔপন্যাসিক নিজস্ব কলা-কুশলতায়। পাল আমল ও সেন আমলের নিত্যদিনের হাহাকার দুর্বিষহ যন্ত্রণার চিত্র, মানবীয় প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হাজারো কাহিনী উপন্যাসে সুন্দরভাবে চিত্রিত করেছেন রিজিয়া রহমান। এখানে বৌদ্ধ-ব্রাহ্মণ-হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের রসায়নকে ইতিহাসসম্মত দ্বান্দ্বিক, মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক মনোভাবে বিশ্লেষণ করেছেন তিনি। এখানেও ক্ষুধার জ্বালায় ক্লিষ্টনিম্নগোত্রীয় ডোমনীর কষ্টে ঔপন্যাসিক মানবিক হয়ে ওঠেন, ‘আশপাশে তাকালাম। ডোমনী মেয়েরা যারা দেহ বেঁচে পেটের ভাত জোগায় তাদের দুচোখে জলের ধারা নেমেছে। সহজিয়া তন্ময় হয়ে গাইছে, আমি ডোমনীরে..., টালের উপর ভাঙা ঘর মোর পাড়া পড়শী নাই। শূন্য হাঁড়ি ভাত জোটেনা নিত্যি উপাস যাই’- তখন প্রদোষে প্রাকৃতজনের মূল আবেদনটিই হয় বিধৃত। প্রদোষের প্রাকৃতজনদের নিয়ে রচিত উপন্যাসগুলোর মধ্যে বলা যায় সাহিত্যিক শওকত আলী সম্পূর্ণ এবং সার্বিক কাজ করেছেন, শওকত আলী সেই মহোত্তম লেখকদের একজন যিনি শ্যামাঙ্গ-লীলাবতী-অভিমন্যু দাস, মায়াবতী-বসন্তদাস-মিত্রানন্দ, নিরঞ্জন, যোগী সিদ্ধপা, দীনদাস, যোগমায়া, মনোহর দাস কিংবা চন্দ্রদাস, হরিসেন অথবা কুসুম ডোমনীকে এনে এক কাল্পনিক যুগের অবতারণা করেছেন। সেখানে জীবন আছে কিন্তু আনন্দ নেই হাসি নেই, নেই বিশ্বাস আর ভালবাসা। সেখানেও শ্যামাঙ্গ কিংবা লীলাবতীদের বেঁচে থাকার ইচ্ছে আছে, কেউ বেঁচে যায় কেউ পারে না। ইতিহাসের নির্মম জীবাস্ম হয়ে বেঁচে থাকে চরিত্রগুলো। এই স্খলিত যুগকে সামনে এনে নাটক মঞ্চস্থ করে শওকত আলী বীরদর্পে এগিয়ে গেলেন ইতিহাসের পথেই। ঔপন্যাসিকের শেষ বার্তাটির অনুরোধে বারবার আপ্লুত হই, ‘লীলাবতীকে খুঁজতে খুঁজতে যদি কখনও পল্লী বালিকার হাতে মৃৎপুত্তলির সন্ধান পাওয়া যায়, তবে সেটি নিশ্চয় বুঝে নিতে হবে, ওটি শুধু মৃৎপুত্তলি নয়, বহু শতাব্দী পূর্বে লীলাবতীর জন্য শ্যামাঙ্গ নামক এক হতভাগ্য মৃৎশিল্পীর মূর্ত ভালবাসাও।’
×