ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

জাফর ওয়াজেদ

প্রয়োজন পূর্ণাঙ্গ সঠিক ইতিহাস

প্রকাশিত: ০৯:৫৭, ২৬ মার্চ ২০২০

প্রয়োজন পূর্ণাঙ্গ সঠিক ইতিহাস

বাঙালী জাতির জীবনে মুক্তিযুদ্ধ একটি উজ্জ্বল ইতিহাস। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা বিশ্বের ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচনকারী অধ্যায়। পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য কত কঠিন সংগ্রাম আর আত্মদান করতে হয়েছে, জানে তা বাঙালী। কিন্তু এই অবদানচিত্র ক্রমশ ধূসর হয়ে আসছে। ‘বাঙালীর ইতিহাস নাই’ বলে এককালে সাহিত্য স¤্রাট বঙ্কিমচন্দ্র আক্ষেপ করেছিলেন। আর আজ বাঙালীকে দুঃখ করতে হয়Ñ মুক্তিযুদ্ধের একটি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস ঊনপঞ্চাশ বছরেও রচিত হয়নি। সেই ত্রিশের দশকের বিপ্লবীদের স্মরণে গাওয়া গানের মতো, ‘মুক্তির মন্দিরে সোপান তলে কত প্রাণ হলো বলিদান, লেখা আছে অশ্রুজলে।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতা তথা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কেবলই অশ্রুজলে লেখা। তথ্য ও গবেষণাসমৃদ্ধ তেমন কোন কাজ হয়নি বলে একালের প্রজন্ম জানে না সঠিক ইতিহাস, সঠিক তথ্য। অথচ ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা যাবে না’ বলে রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে বার বার উচ্চারিত হয়। কিন্তু তাদের উপলব্ধিতে আসে না যে, ইতিহাস রচিত হয়নি বলেই বার বার বিকৃতির শিকার হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। ইতিহাস ভুলিয়ে দেয়ার কাজটি হয়েছে দুই যুগের বেশি সময় ধরে। আর সে কারণেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ইতিহাস পৌঁছেনি। রচনার কাজ প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়ে পড়ে। পঁচাত্তর পরবর্তী সামরিক জান্তা শাসক ও তাদের উত্তরসূরিরা একদিকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানার পথটি রুদ্ধ করে দিয়ে বিকৃত এক ইতিহাসকে উপস্থাপন করেছিল। তারা গণহত্যাকারী পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে হানাদার হিসেবে উচ্চারণেও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল, নানা বিভ্রান্তির বেড়াজাল ও বিভ্রমের কুয়াশায় মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ও আদর্শ এবং অঙ্গীকারকে ভূলুণ্ঠিত করে পাকিস্তানী ভাবধারায় দেশকে যেভাবে ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিল, তাতে হানাদারদের দোসর যুদ্ধাপরাধীরাও সমাজ, রাজনীতিতে, ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিল। একাত্তরের পরাজিত শক্তিরা ক্ষমতার বসে জনমত থেকে মুক্তিযুদ্ধের সবকিছু মুছে দিতে পেরেছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের হয়রানি, নির্যাতন, গ্রেফতার, গুম, হত্যা সবই চালিয়েছে সামরিক জান্তা শাসক। স্বাধীনতা পরবর্তীকালের দ্রুতগামী সময়ের প্রেক্ষাপটে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় সুনির্দিষ্ট তথ্যাবলী সংগ্রহ ও বিচার বিশ্লেষণের ক্ষেত্রগুলো নানাভাবে বিপন্ন এবং বিপর্যস্ত হয়েছে। সামরিক জান্তা শাসনামলে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ পরিচয় প্রদানও ছিল বিপজ্জনক। তাই বিস্ময়করভাবে এবং বেদনাদায়কভাবে বাঙালীর ইতিহাস রচনায় সম্ভাবনার ক্যানভাসটিকে কালিমালিপ্ত করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের বহু দলিল-দস্তাবেজ জ্ঞাত অথবা অজ্ঞাতসারে অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। দেশে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ রাজনৈতিক দলের অবস্থান বহাল থাকায় ইতিহাস রচনার কাজ সহজসাধ্য হয়ে উঠছে না। স্বাধীনতার পর পরই ইতিহাস রচনার কাজটি শুরু করা যায়নি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের দিকে সম্পূর্ণ দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকায়, পরবর্তীকালে হাসান হাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা আন্দোলনের দলিলপত্র সংগ্রহ ও গ্রন্থভুক্ত করার কাজ চলে। তারা পনেরো খ-ে যে দলিলগুলো উপস্থাপন করেছেন, তাও সংগৃহীত তথ্যের একটি অংশমাত্র। বাকি হাজার হাজার তথ্য ‘গায়েব’ হয়ে গেছে। জাতীয় জাদুঘরে বস্তাবন্দী সে সবের কিছু উইপোকায় কেটেছে। যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার ও দালালদের অপকর্ম নিয়ে গবেষণারত শাহরিয়ার কবির যেমনটা জানালেন যে, স্বাধীনতার পর থেকে পাকিস্তানপন্থীরাই বেশি সময় দেশের শাসন ক্ষমমতায় থেকে ইতিহাসকে বিকৃত করার চেষ্টা করেছে। ক্ষমতায় এসে মৌলবাদী জামায়াত-বিএনপি প্রকৃত ইতিহাস মুছে ফেলে দেখাতে চেয়েছে পাকিস্তান নয়, ভারতই হলো বাংলাদেশের শত্রু। ইতিহাস না থাকায় এই অপপ্রচার এখনও চলছে। ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের মতে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যখন বর্ণিত হয়, তখন সম্মুখ যুদ্ধগুলোর ওপরই গুরুত্বারোপ করা হয়। গেরিলা যুদ্ধের প্রতি ততটা নয়। এগারোটি সেক্টরে যে যুদ্ধ হয়েছিল অন্তিমে সেটিই হয়ে দাঁড়ায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের কাঠামো। যে ইতিহাস লেখা হয় তাতে মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা থাকে অস্পষ্ট। বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শিক্ষাবিদ ও গবেষক শামসুজ্জামান খান মনে করেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা ইতিহাসবিদ এবং ইতিহাস রচনা সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি চ্যালেঞ্জও বটে। এই ইতিহাস রচনার পদ্ধতি কি হবে সে ব্যাপারেও কোন প্রখ্যাত প-িত এখন পর্যন্ত কোন গ্রহণযোগ্য দিকনির্দেশনা দেননি। এই ইতিহাস যথাযথভাবে তৃণমূল পর্যায়ে থেকে লিখতে হলে এবং এর অনন্য ¯্রষ্টা কৃষক সন্তান ও ব্রাত্যজনের ভূমিকাকে গুরুত্ব দিতে হলে ফিল্ডওয়ার্ক পদ্ধতিতে কাজ করতে হবে। ইতিহাসের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গবেষকরা এ ধরনের কাজ অদ্যাবধি করেননি। প্রয়োজন মাঠ পর্যায়ে বস্তুনিষ্ঠ অনুসন্ধান।’ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শুধু রণাঙ্গনের ইতিহাস নয়। তার আরও অনেক দিক রয়েছে। সে সব উদ্ঘাটনের কাজ অপর্যাপ্ত। সংবাদপত্র এক্ষেত্রে কিছুটা ভূমিকা পালন করে আসছে নব্বই পরবর্তীকাল হতে। দৈনিক জনকণ্ঠ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেছিল মুক্তিযুদ্ধের অনেক তথ্য। যার মধ্যে কুমিল্লার রসুলপুর বধ্যভূমি নিয়ে লেখা প্রকাশের পর সেখানে স্মৃতিসৌধ করা হয়। এই লেখার কাজে জড়িত সাংবাদিক ও গবেষক এবং শিশু সাহিত্যিক মোস্তফা হোসেইন জানান, ‘তথ্য সংগ্রহ করে পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনায় সময় লাগতেই পারে। তবে যেভাবে ধীরগতিতে এবং সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত পর্যায়ে এবং সমন্বয়হীন কাজ হচ্ছে তাতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা শেষ হবে কিনা সে নিয়ে সংশয় রয়েছে।’ একাত্তরের প্রজন্ম ক্ষয়িষ্ণু হওয়ার কারণে এবং অনেকে মৃত্যুবরণ করায় তথ্য সংগ্রহের কাজ দুরূহ হয়ে পড়ছে। যারা বেঁচে আছেন, তাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ দ্রুত করা জরুরী হয়ে পড়েছে। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকতার অভাবে তা করা যাচ্ছে না। অনেক দলিলপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের স্মারকও। মুজিবনগর সরকারের অনেক দলিলপত্র যুদ্ধ শেষে দেশে আনা হয়নি। সামরিক বাহিনীর কোন দলিলও বেসামরিক হাতে দেয়া হয়নি। প্রতিশ্রুতি থাকলেও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক আফসান চৌধুরী শংকিত যে, ‘ইতিহাস চর্চার যে সম্পদ বা রসদ লাগে তার অন্তিমলগ্নে এসে দাঁড়িয়েছি আমরা। এরপর আলোচনা হতে পারে। বিশ্লেষণ হতে পারে। কিন্তু মৌলিক ইতিহাস গবেষণা সম্ভব নাও হতে পারে।’ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যেসব লেখা পাওয়া যায় তার অধিকাংশই যুদ্ধসংক্রান্ত। মুজিবনগর সরকার নিয়ে সে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা এইচটি ইমাম দলিলপত্রসহ বেশ বড়সড় গ্রন্থ লিখেছেন। যা গবেষণার জন্য অত্যন্ত গুরুত্ববহ। শরণার্থী জীবন ও সমস্যা নিয়ে কিছুই লেখা হয়নি। ভারত সরকারের ভূমিকা, যুব শিবির, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের ভূমিকা, প্রবাসী বাঙালীদের তৎপরতা, স্বদেশে আটকেপড়া বাঙালীদের ওপর বর্বরতা, দালালি ইত্যাকার বিষয়গুলো নিয়ে তেমন কোন কাজ হয়নি। আজকের প্রজন্মের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর ইতিহাসের কিছুই জানে না। জানার সুযোগও নেই। শুধু সাতই মার্চের ভাষণ শুনে একটা কাঠামো হয়ত তারা দাঁড় করায়। আমাদের সৌভাগ্য যে, ওই ভাষণে পাকিস্তানের চব্বিশ বছরের ইতিহাসের রূপরেখা পাওয়া যায়। কিন্তু এত বিশাল মুক্তিযুদ্ধের অনেক দিকই তাদের অজানা। যে কারণে একাত্তরের দালাল, রাজাকাররা জনজীবনে মিশে যেতে পারছে। তাদের নামে স্থাপনা হচ্ছে। পরাজিত শক্তিরা মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম ওঠাতে পারছে। পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস যদি থাকত, তবে বিকৃত ইতিহাস তৈরির কাজটি বিএনপি-জামায়াতসহ পরাজিত শক্তিরা করতে পারত না। এমনকি অনেক বিষয় বিদেশী সাংবাদিকরাও অযাচিত মতামত ও মন্তব্য পেশ করতে পারত না। পরাজিত শক্তির সঙ্গে সমঝোতা করার কথা বলা স্বাধীনতার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতারই নামান্তর। বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করতে চায়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসই যদি রচিত না হয় তবে সে সব বাস্তবায়ন অনেকটাই কাগুজে ভাষ্যে পরিণত হতে বাধ্য। দেশ, জাতির স্বার্থে সরকারের উচিত দ্রুত প্রকল্প গ্রহণ, যাতে পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচিত হতে পারে। নতুবা সবই বৃথা আস্ফালনে পরিণত হবে। বীরের জাতির অবস্থান ক্রমশ নিম্নমুখী হবে, ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না। ইতিহাস রচনা যাদের দায়িত্ব, তাদের উদাসীনতা, অবহেলা ক্ষমার অযোগ্য অবশ্যই। আর এক বছর পর স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর। এখনই কাজ শুরু করা যেতে পারে। লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও মহাপরিচালক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)
×