ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ দোয়া ইউনুসের প্রকৃষ্টতা

প্রকাশিত: ০৮:৩৯, ২৭ মার্চ ২০২০

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ দোয়া ইউনুসের প্রকৃষ্টতা

হযরত ইউনুস ‘আলায়হিস্্ সালাম আল্লাহ্্র নবী ছিলেন। কুরআন মজিদের ১০ নম্বর সুরার নামকরণ তাঁর নামেই করা হয়েছে। তিনি দরিয়ায় নিক্ষিপ্ত হলে একটি প্রকা- মাছ তাঁকে গিলে ফেলে, কিন্তু আল্লাহ্র রহমতে ওই মাছ তাঁকে হজম করতে তো সমর্থই হয়নি, এমনকি তাঁর দেহের সামান্যতম অংশেও কোনরূপ ক্ষতের সৃষ্টি করতে পারেনি। সেই মাছের উদর-অন্ধকারে বসে আল্লাহ্্র নবী হযরত ইউনুস ‘আলায়হিস্ সালাম অত্যন্ত কাতর স্বরে যে দোয়াখানি পড়েছিলেন তা দোয়া ইউনুস নামে বহুল পরিচিত, আর সেই দোয়াখানি হচ্ছে : লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুব্হানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজ্ জলিমীন। কুরআন মজিদে হযরত ইউনুস ‘আলায়হিস্ সালামের নামে যেমন একটি সুরা রয়েছে তেমনি ইউনুস নামটিও অন্ততপক্ষে পাঁচ স্থানে উল্লিখিত হয়েছে। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : আমি তো আপনার নিকট ওহী প্রেরণ করেছি, যেমন ওহী প্রেরণ করেছিলাম নুহ্ ও তাঁর পরবর্তী নবীগণের নিকট এবং ওহী প্রেরণ করেছিলাম ইব্রাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব ও তাঁর বংশধরগণের নিকট এবং ‘ঈসা, আইয়ুব, ইউনুস, হারুন ও সুলায়মানের নিকটও (সুরা নিসা : আয়াত ১৬৩)। আর হিদায়াত দান করেছিলাম ইসমা’ঈল আল-ইয়াসা’আ, ইউনুস ও লুতকে এবং শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছিলাম বিশ্ব জগতের ওপর প্রত্যেককে এবং তাদের পিতৃপুরুষ, বংশধর ভাইদের কতককে। আমি তাদের মনোনীত করেছিলাম এবং সহজ সরল পথে পরিচালিত করেছিলাম (সূরা আন’আম : আয়াত ৮৬-৮৭)। ইউনুসও ছিলেন রসুলদের একজন (সুরা সাফ্ফাত : আয়াত ১৩৯)। সূরা ইউনুসের ৯৮ নম্বর এবং সাফ্ফাতের ১৪৫ নম্বর আয়াতে কারিমাতেও ইউনুস নামের উল্লেখ আছে। হযরত ইউনুস ‘আলায়হিস্ সালামের পরিচিতিমূলক নাম হিসেবে কুরআন মজিদে তাঁকে যুন্নূন, সাহিবুল হূত নামে অভিহিত করা হয়েছে। যুন্নূন শব্দের অর্থ মাছের সঙ্গে সম্পৃক্ত আর সাহিবুল হূত শব্দের অর্থ মৎস্য সহচর। তাঁর পিতার নাম মুত্তা। বাইবেলে ইউনুস (আ)-কে জোনাহ নামে অভিহিত করা হয়েছে। হযরত ইউনুস ‘আলায়হিস্ সালাম নিনেভা নামক জনপদের পথভ্রষ্ট জনগণকে সত্য পথের দিশা দেয়ার জন্য প্রেরিত হন। কিন্তু নিনেভার লোকজন তাঁর আহ্বানে সাড়া না দেয়ায় তিনি তাদের আল্লাহর গজবের খবর দিয়ে আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষা না করে নিনেভা ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যাওয়ার জন্য রওনা হন। পথিমথ্যে দরিয়া পড়লে তা পাড়ি দেয়ার জন্য একটি জাহাজে ওঠেন। জাহাজটি মধ্য দরিয়ায় গিয়ে ঘূর্ণিপাকে পড়ে। তখন জাহাজের চালক ধারণা করে যে, জাহাজে কোন অপরাধী আছে, যে কারণে জাহাজটি বিপাকে পড়েছে। সেকালের নিয়ম অনুযায়ী লটারিতে বার বার হযরত ইউনুস ‘আলায়হিস্ সালামের নাম ওঠে। তখন বাধ্য হয়ে তাঁকে দরিয়ায় ফেলে দিলে জাহাজটি বিপাক থেকে রক্ষা পায়, আর একটি বিরাট মাছ হযরত ইউনুস ‘আলায়হিস্ সালামকে গিলে ফেলে। কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : ইউনুসও ছিল রসূলদের একজন। স্মরণ কর, যখন সে পালিয়ে বোঝাই নৌযানে পৌঁছল, অতঃপর সে লটারিতে যোগদান করল এবং পরাভূত হলো। পরে এক বৃহদাকার মাছ তাঁকে গিলে ফেলল। তখন সে নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগল। সে যদি আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা না করত, তাহলে তাকে উত্থান দিবস পর্যন্ত ওটার উদরে থাকতে হতো (সূরা সাফ্ফাত : আয়াত ১৩৯-১৪৪)। এখানে উত্থান দিবস বলতে বোঝানো হয়েছে কিয়ামত দিবস তথা রোজ হাশর বা পুনরুত্থান দিবসকে। ইউনুস ‘আলায়হিস্ সালাম অক্ষত অবস্থায় ৪০ দিন সেই বৃহদাকার মাছের উদরে বসে তসবিহ-তাহলীল, তওবা-ইস্তিগ্ফার করেছিলেন এবং আল্লাহর বিনানুমতিতে স্বদেশ ত্যাগ করার জন্য অনুশোচনা ব্যক্ত করে কান্নাকাটি করেছিলেন। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : এবং স্মরণ কর যুন্নূনের কথা যখন সে রেগেমেগে বের হয়ে গিয়েছিল এবং মনে করেছিল আমি তাকে পাকড়াও করব না (সূরা আম্বিয়া : আয়াত ৮৭)। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : ফানাদা ফিজ্ জুলুমাতি আল লাইলাহা ইল্লা আন্তা সুব্হানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজ্ জলিমীনÑ অতঃপর সে (ইউনুস) অন্ধকার হতে আহ্বান করেছিল : আপনি ছাড়া কোন ইলাহ্ নেই, আপনি পবিত্র সুমহান। নিশ্চয়ই আমি জালিমদের (অপরাধীদের, সীমা লঙ্ঘনকারীদের) অন্তর্ভুক্ত (সূরা আম্বিয়া : আয়াত ৮৭)। আল্লাহ জাল্লা শানুহু বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নবীকে পরীক্ষা করেছেন। আমরা দেখি হযরত ইব্রাহীম ‘আলায়হিস্ সালামকে পুত্র কোরবানি করতে উদ্যত হয়ে আল্লাহ্্ প্রেমের পরীক্ষা দিতে, হযরত আইয়ুব ‘আলায়হিস্ সালামের দীর্ঘদিন ধরে রোগ যন্ত্রণা ভোগ করে, সহায়-সম্পদ সবকিছু হারিয়ে আল্লাহর প্রেমের পরীক্ষা দিতে। মাছের উদরের সেই নিকষকালো অন্ধকারে ৪০ দিন ভীষণ কষ্টের মধ্যে থেকে হযরত ইউনুস ‘আলায়হিস্ সালাম আল্লাহ্ প্রেমের এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : তখন আমি তার (ইউনুসের) ডাকে সাড়া দিয়েছিলাম এবং তাকে উদ্ধার করেছিলাম দুশ্চিন্তা থেকে এবং আমি মু’মিনদের নাজাত দিয়ে থাকি (সুরা আম্বিয়া : আয়াত ৮৮)। (চলবে...)
×